ড. কল্যাণ চক্রবর্তী।_
আমাদের ভারত, ২৭ জুলাই: অনেকেই ‘শব্দে শব্দে বিয়ে দেয়’, তবুও ‘সবাই কবি নয়/কেউ কেউ কবি’। অনেক কবি কবিতা লিখতে-না-লিখতেই কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করে ফেলেন, বিন্দুমাত্র তর সয় না আর! অলকা বন্দ্যোপাধ্যায় তেমন ‘ধরো তক্তা মারো পেরেক’ গোছের কবি নন। দীর্ঘ জীবনযুদ্ধের পরতে পরতে যে অভিজ্ঞতা সুযোগ পেলেই তিনি ডাইরিতে লিখে রেখেছেন এ এযাবৎকাল, অবসর গ্রহণের পর তা থেকেই বাছাই করে কিছু কবিতা দুই মলাটের মধ্যে একত্রিত করেছেন। তারই নাম ‘একান্তে মেঘ’; “মেঘের রঙে কালো হয়ে পথ চলা।”
বাংলায় নানান মেঘের নাম পাওয়া যায়। তারই একটি অলক মেঘ, কোথাও তার অন্যতর রূপ ‘ঊর্ণা মেঘ’, ‘কুন্তল মেঘ’। ‘অলক’ অর্থে পেঁজা তুলো। কেশগুচ্ছের মতো, ভেড়ার লোমের মতো যে মেঘ, তাই অলক মেঘ। ইংরেজিতে এই মেঘকে বলা যেতে পারে ‘Cirrus’. সেই কুঞ্চিত-কেশ অলক মেঘের বালিকা হতে চেয়েছেন অলকা? এটি কী এক মেঘ বালিকার কাব্য? “রোদ কিছুতেই এল না আমার ডাকে/একটুও সাহায্য করল না।/অগত্যা ঝুলিভরা মেঘ নিয়েই চলতে থাকি।” এই একান্তের সঙ্গেই কবির দীর্ঘ পথচলা, তাঁর গৃহস্থালি। মোট ৫৪ টি কবিতা এই গ্রন্থে সন্নিবিষ্ট হয়েছে। বইটির দাম ৭৫ টাকা।
আনন্দবাজার পত্রিকার প্রয়াত সাংবাদিক প্রফুল্লকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের কন্যা অলকা। সরকার পোষিত গ্রন্থাগারে সহকারী হিসাবে কাজ করে অবসর নিয়েছেন বছর আটেক আগে; থাকেন রহড়ার মিশনপাড়ায়। ছোটোবেলায় ‘মঙ্গলি দি’ বলেই ডাকতাম। কাব্যগ্রন্থ ‘একান্তে মেঘ’, প্রকাশক ‘ইসক্রা’। ২০১৫ সালের জুন মাসে বইটি প্রকাশিত হয় এবং ওই সময়েই মঙ্গলি দিদির কাছ থেকে বইটি সংগ্রহ করি। এটিই তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ। আমি ওনার সংগ্রামের জীবন ছোটোবেলা থেকেই জানি। বইয়ের প্রচ্ছদেও লেখা হয়েছে মহিলাদের প্রতি মধ্যযুগীয় অনুশাসনের প্রতিবাদে তিনি পাকাপাকি দাম্পত্য জীবনযাপন করেননি। নিজের পায়ে দাঁড়াতে মরিয়া সংগ্রাম করেছেন।
তাঁর কবিতায় প্রকৃতি, মানবিক সম্পর্ক, ভালোবাসা — সহজ সরল ভাষায় এক ভিন্ন ব্যঞ্জনায় পরিবেশিত হয়েছে। তিনি পিতামহী প্রয়াতা অন্নদা সুন্দরী দেবীকে বইটি উৎসর্গ করেছেন। গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা লিখে দিয়েছেন রহড়ার এক নামী সাহিত্যিক ও বর্তমানে প্রয়াত অপূর্ব কুমার সাহা। অপূর্ব বাবু ‘জাগরী’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। তিনি গ্রন্থের মধ্যে কবিতার এক একটি বিরল মুহূর্তে আবিষ্কার করেছেন আধ্যাত্মিক আনন্দের অন্তরঙ্গ ঝলক, যা কাব্যগ্রন্থের প্রাণধর্ম রচনা করেছে — “চলার পথই তোমার পরিচয়/অস্তিত্বই হারিয়ে যাবে তোমার/আত্মার সাথে পরমাত্মার হবে আলিঙ্গন” (নদীর কথা)। অথবা “ছিলে রুদ্র রূপে/কঠিনে কোমলে, উঁচুতে গ্রন্থিত/আমার সাধ্য কি তোমাকে বোঝার” (বীক্ষণে মেঘদূতের দেশ)। দুর্দিনে, অবক্ষয়ে, জীর্ণতায় তিনি অসুর বিনাশিনী মহাদুর্গাকে জাগিয়ে তুলতে চেয়েছেন প্রবলভাবে, বলেছেন, “নয়টি রূপে জাগো নবদুর্গা/সংহারে জাগো অসুর বিনাশিনী” (মাতৃ প্রণাম)।
কাব্যগ্রন্থের পরতে পরতে রয়েছে কবি অলকার আলো-আঁধারির জীবনদর্শন, গোপন ঘরের কথার মালা। “পারিনি দিতে পৃথিবীকে আমার ফলভার” (পৃথিবী তোমাকে); তাই এই কাব্যমালা তিনি পৃথিবীকে দিতে চান, দিতে চান কঠিন পথে একা হেঁটে যাওয়ার কাব্য। দিতে চান পথের কথা, পাতায় পাতায় সাজিয়ে। শিশুকাল থেকে কবি হেমন্তের দিনে কেঁদেছেন; মনের কোটরে তৈরি হয়ে গেছে চির হেমন্তবাসা। অথচ আনন্দগান, শঙ্খরবেই ছিল তার আস্থা “কাশের বনে নদীর কূলে/খুশির হাওয়ায় দুলে দুলে/সবার মনের দুয়ার খুলে/সোনার আলো ছড়িয়ে দিয়ে/সে যে আসে, আসে” (আগমনী)। সে এসেছিল। তবু “দশমীর রাত থেকেই শুরু/কেমন যেন হিমেল বিষণ্ণতা/আনন্দ শেষের বিষাদ”। কোথায় যেন নিজের বিবাহের দিনটি দুর্গাপূজায় মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে কবির জীবনে। তারপর দশমীর বিদায়বেলা, চির বিচ্ছিন্না হয়ে ধরা দিয়েছে, নিজের কাছে।
এই জীবন নিয়েই একান্ত মেঘে ভেসে চলেছেন তিনি ‘অলক মেঘ’ হয়ে। ফলভারহীন আজ এই শেষ বেলায়, এই সত্যিকারের হেমন্ত ভালোই লাগে তার। “…বাইরে ভিতরে সামনে/নেই কোনও চাওয়া, না পাওয়ার বেদনা/আশা নেই, নেই আশাভঙ্গের জ্বালা।/… দিনগুলি আজ এই আসল হেমন্ত/করেছ আমাকে ধীর স্থির ও প্রশান্ত” (হেমন্ত দিনের ভাষ্য)। কাব্যগ্রন্থ জুড়ে তাঁর বন্ধনহীন পথ চলার গল্প — “আটকে যাওয়া ট্রেন/অখ্যাতনামা কোনও এক স্টেশনে/বনের মাঝে ঘনিয়ে আসা মেঘের ছায়াতলে/বেদুইনের সংসার।” কবি অলকা স্বীকার করেছেন প্রকাশক ইসক্রা-র স্বীকৃতি, তাঁর বিচ্ছিন্নতার জ্বালা ভুলিয়ে দিয়েছে ইসক্রা বইখানি প্রকাশ করে — “স্ফুলিঙ্গের উজ্জ্বলতা ধরে থেকো/যুগ যুগ ধরে/ইসক্রা।”