অশোক সেনগুপ্ত
আমাদের ভারত, ১৭ মে: “সেই ১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দেই রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘প্রকৃত বাংলা ব্যাকরণ একখানিও প্রকাশিত হয় নাই। সংস্কৃত ব্যাকরণের একটু ইতস্তত করিয়া তাহাকে বাংলা ব্যাকরণ নাম দেওয়া হয়। বাংলা ব্যাকরণের অভাব আছে, ইহা পূরণ করিবার জন্য ভাষাতত্ত্বানুরাগী লোকের যথাসাধ্য চেষ্টা করা উচিত।’
আসলে বাংলা ভাষাকে যথাযথরূপে বিশ্লেষণ করে আজ অবধি কোনো ব্যাকরণ বই লেখা হয়নি। যা আছে তা, হয় সংস্কৃত ব্যাকরণের ছায়ানুসারী, নয়তো ইংরেজি ব্যাকরণের ভাবানুবাদ। জয়া ফারহানা বলেছেন, ‘প্রমিত বাংলা মুদ্রণের জন্য বর্ণমালা ও বানানের যে প্রমিতকরণ দরকার ছিল সেটা হয়নি। বানানে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে প্রতিদিনই নতুন করে তৈরি হচ্ছে বিশৃঙ্খলা।’ ড. সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে রবীন্দ্রনাথই প্রথম বাঙালি ব্যক্তিত্ব যিনি বাংলা ভাষা সমস্যার বিষয়টি বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করেছেন।
প্রশ্ন হচ্ছে, প্রমিত ভাষা কী। বাংলা একাডেমি তার প্রমিত বাংলা ব্যবহারিক ব্যাকরণে প্রমিত ভাষার যে সংজ্ঞা দিয়েছে তা হচ্ছে, ‘… অধিকাংশ বক্তা বলে বা শোনে এমন একটি মুখের ভাষাও আছে, যা স্থানবিশেষে আবদ্ধ নয় এবং সমাজের শ্রেণি বা গোষ্ঠীতেও আবদ্ধ নয়। তারই নাম প্রমিত ভাষা’ (পৃ. ৩)। ভাষার উচ্চারণ কিছু দূর পর-পর বদলে যায়। ভাষাবিদরা গবেষণা করে দেখিয়েছেন যে, প্রতি ১৩ মাইলে উচ্চারণ বদলে যায়। আর ম্যাক্সমুলারের মতে প্রতি পাঁচ মাইল অন্তর ভাষা বদলে যায়। পাশে অন্য ভাষা থাকলে তার ব্যাপক প্রভাবও পড়ে। ফলে একই ভাষার অন্তর্গত হলেও এক অঞ্চলের মানুষের কথা অন্য অঞ্চলের মানুষের পক্ষে অনেক সময় বুঝে ওঠা কঠিন হয়ে পড়ে। আমরা যেমন সিলেট বা চট্টগ্রামের লোকের কথা বুঝতে সমস্যায় পড়ে যাই। অনেক ক্ষেত্রে মোটেই বুঝতে পারি না।
এ কারণে প্রমথ চৌধুরী বলেছিলেন, ‘বাংলা ভাষা আহত হয়েছে সিলেটে, আর নিহত হয়েছে চট্টগ্রামে।’ ফলে আছে একটি প্রমিত ভাষা—যা ভিন্ন-ভিন্ন অঞ্চলের লোক একসঙ্গে হলে ব্যবহার করে। পড়াশুনা লেখালেখিও সাধারণত প্রমিত ভাষাতেই হয়ে থাকে—যদিও প্রমিত বাংলা বেশির ভাগ মানুষের মুখের ভাষা নয়। ভাষা শহীদরা এই প্রমিত বাংলার জন্যই রক্ত দিয়েছে। কোনো বিশেষ অঞ্চলের বাংলাকে তারা বোঝেননি। সাধু ভাষাকে যখন পিছনে ফেলে চলিত ভাষায় লেখালেখি শুরু হল, তখনই প্রমিত ভাষা সামনে চলে আসল। সাধু ভাষা একটি কৃত্রিম গদ্যভাষা—যা কখনই মুখে বলা হয়নি।
বাংলা একাডেমির ব্যাকরণ ও অভিধানেই তো বলা হলো—এই প্রমিত উচ্চারণে ই ঈ এবং তার কার, উ ঊ এবং তার কার, ঙ ং, জ য, ণ ন, ত ৎ, শ ষ স এর ধ্বনি অভিন্ন। ঞ এর উচ্চারণ প্রতিবেশ অনুসারে কখনো ন, কখনো ঙ, কখনো অনুনাসিক স্বরধ্বনি হয়ে শেষপর্যন্ত য় হয়। ব-ফলা, ম-ফলা, য-ফলা দ্বিত্ব বর্ণ হিসেবে ব্যবহার হয়। এটাও বলা হলে, বাংলা ভাষার উচ্চারণ পদ্ধতির বৈশিষ্ট্যই হলো হ্রস্ব মাত্রার উচ্চারণ। ব্যাকরণ বইতে এটাও স্বীকার করা হলো যে, উৎস ভাষা থেকে আসা শব্দের উচ্চারণ অব্যাহত থাকে না; তৎসম (অর্থাৎ সংস্কৃতের সমান) বলা হয় নিছকই লেখায় সমরূপের জন্য—বাস্তবে উচ্চারণে এই সমতা নেই বললেই হয়। এটাও বলা হয়েছে যে, অন্য ভাষা থেকে গৃহীত হলে তা সেই ভাষারই শব্দ হয়ে যায়, তা ফেরত দেওয়ার প্রশ্ন ওঠে না। ফেরত না দেওয়ার কথাটি পবিত্র সরকারের। এতে স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে, যদি সংজ্ঞা অনুসারে প্রমিত বাংলার ব্যাকরণ ও অভিধান তৈরি করতে হয়, তাহলে যা বলি-না বা শুনি-না তা নিয়ে কেন তথাকথিত প্রমিত ব্যাকরণ রচনা করা হলে, কেন তাতে সংস্কৃত বানানের নিয়ম-কানুন ঢুকিয়ে দেওয়া হলো, কেন প্রমিত অনুযায়ী ব্যাকরণ অভিধান তৈরি করা হল না, কেন সংস্কৃত অনুসরণ করে ব্যাকরণ অভিধান তৈরি করে তাকে প্রমিত নাম দিয়ে বাংলা একাডেমি ধোঁকা দিল? একাডেমির অভিধানেই তো স্বীকার করা হয়েছে যে, অভিধানে বানান বা লিপি সংস্কার করা হয়নি, কেবল বানানকে অভিন্ন ও প্রমিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রমিত ভাষা অনুযায়ী বানান না করা হলে তা আবার প্রমিত হয় কীভাবে?
বলা হয়ে থাকে, বাংলা ভাষার উচ্চারণ বর্ণভিত্তিক। সে কারণে বাংলার উচ্চারণে কোনো গোলযোগ নেই। আর তাই বর্ণের সংখ্যা বেশি। একথা সত্য যে, ইংরেজি বা অনেক ভাষার চেয়ে বাংলার উচ্চারণ অনেক বেশি বর্ণভিত্তিক, গড়মিল কম। তাই বলে কি সম্পূর্ণ বর্ণভিত্তিক। আসলে কোনো ভাষার উচ্চারণই সম্পূর্ণ বর্ণভিত্তিক নয়। রবীন্দ্রনাথ এটা লক্ষ করে এ নিয়ে বেশ কিছু আলোচনা করেছেন। বাংলা একাডেমির ব্যাকরণ বইতেও এ নিয়ে অনেক কথা বলা হয়েছে। এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা না করে কয়েকটি উদাহরণ দিলেই বিষয়টি মোটামুটি বুঝা যাবে। যেমন জল, কল, বল, অভাব, কপাল, হর ইত্যাদি শব্দের উচ্চারণ সম্পূর্ণ বর্ণভিত্তিক। একে বলা হয় বিবৃত স্বর। কিন্তু যখন লিখি অতি, তা পড়ি ওতি; লিখি কলু পড়ি কোলু; লিখি মন/মণ পড়ি মোন; এভাবে বন হয় বোন, জন হয় জোন, এক হয় এ্যাক, বড় হয় বড়ো, অনুজ হয় ওনুজ, গদ্য হয় গোদ্দো, সভ্য হয় শোবভো, জন্য হয় জোন্নো, তত হয় ততো, অতুল হয় ওতুল, অসুর হয় ওসুর, গর্দভ হয় গর্ধোব, সহ্য হয় সোজঝো, পবন হয় পবোন, ব্যয় হয় ব্যায় ইত্যাদি। একে বলা হয় সংবৃত স্বর। এ রকম হাজারো উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। বাংলা একাডেমির বানান-অভিধানে যদিও শব্দ সংখ্যা কত আছে বলা নেই, তবে আমার মনে হয় কমবেশি ৬৫ হাজার হবে। এ অভিধানে শব্দ ও তার উচ্চারণ দেওয়া আছে। তাতে দেখা যায়, প্রায় প্রত্যেকটি শব্দের উচ্চারণ লেখা থেকে ভিন্ন।
এখানে বলে রাখা প্রয়োজন, অনেক ক্ষেত্রেই অ যদিও ও-এর মতো উচ্চারিত হয়, অন্যান্য বর্ণের উচ্চারণেরও পরিবর্তন হয়, তবে এই পরিবর্তনের মাত্রা সর্বত্র একই রকম নয়। কোনো জায়গায় বেশি মাত্রায়, কোনো জায়গায় কম মাত্রায় অ হয় ও। অন্যান্য বর্ণের পরিবর্তনেও একই কথা খাটে। সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে বাংলায় স্বরবর্ণের দীর্ঘ উচ্চারণ স্বয়ংসিদ্ধ এবং স্বতন্ত্র নয়। বাক্যের মধ্যে শব্দের অবস্থান প্রভৃতির উপর স্বরধ্বনির দৈর্ঘ্য নির্ভর করে। কাজী সিরাজ সঠিকভাবেই বলেছেন, ভাষা তার আপন গতিতেই ধ্বনির হ্রস্বতা কিংবা দীর্ঘতা সৃষ্টি করে থাকে। একথা শুধু ধ্বনির ক্ষেত্রেই নয়, শব্দের অর্থের ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য। বাংলা একাডেমির ব্যাকরণে বলা হয়েছে, ‘শব্দের কোন্ অর্থ কোথায় তৈরি হবে, তা পুরো বাক্যটির উপর নির্ভর করে। বাক্যে ব্যবহৃত না হলে শব্দের অর্থ একটি বায়বীয় ধারণা মাত্র, বাক্যে ব্যবহার হলেই তার অর্থের সমস্ত সম্ভাবনার মধ্য থেকে একটি বা দুটি (দ্ব্যর্থকতার ক্ষেত্রে) অর্থ স্পষ্ট হয়।’ উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, এখন আমার হাত খালি—এই বাক্যটির মধ্যে ‘হাত খালি’র আক্ষরিক অর্থটা প্রধান নয় (প্রমিত বাংলা ব্যবহারিক ব্যাকরণ পৃ. ৩০৭)। আবার দেখুন বিভিন্ন বাক্য কীভাবে ‘চাল’ শব্দটির বিভিন্ন অর্থ নির্ধারণ করে। ঘরে চাল বাড়ন্ত, খাবে কী?; ফুটো চাল দিয়ে বৃষ্টির জল পড়ে; তার চাল-চলন মোটেই ভালো নয়; চাল-চুলার ঠিক নেই, তোমাকে মেয়ে দেবে কে?; সে কুট-চাল দিতে পারদর্শী; দাবা খেলায় শেষে সে ঘোড়ার চাল দিল তাতেই কিস্তি মাত হলো। এভাবে ‘চাল’ শব্দটি বিভিন্ন বাক্যে বিভিন্ন অর্থ-প্রকাশ করল। দেখুন ‘মাথা’ শব্দটি কতভাবে ব্যবহৃত হতে পারে। অঙ্কে তার মাথা নেই, সে মাথামোটা মানুষ, মেয়েটির মাথায় একরাশ চুল, তোমার কথার আগামাথা কিছু বুঝলাম না, আমার মাথায় অনেক বোঝা, এই রাস্তার মাথায় তার বাড়ি, এটা না করলে আমার মাথা খাও, রহিম মাতবর গ্রামের মাথা, সে মাথায় কিছু রাখতে পারে না, ট্রেন ছাড়ার মাথায় সে স্টেশনে পৌঁছল, সে সুটকেসটা মাথায় বয়ে আনলো ইত্যাদি। আবার যদি বলা হয় ‘আপনি এই কাজটি করুন।’ অথবা ‘সে এক করুণ অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে’। এখানে দুই ক্ষেত্রে করুন শব্দটি দুই অর্থে ব্যবহৃত হচ্ছে। এই করুন বানানে ণ বা ন ব্যবহার করা হয়েছে তা মুখ্য নয়। বাক্যই তার অর্থ ঠিক করে দিয়েছে। এভাবেই শব্দের ভিন্নার্থক প্রয়োগ হয়ে থাকে।
যাহোক, উল্লিখিত আলোচনা হতে একথা পরিষ্কার যে, আমাদের উচ্চারণ সম্পূর্ণ বর্ণভিত্তিক নয়। কাজেই বর্ণভিত্তিক উচ্চারণের জন্য বর্ণসংখ্যা বেশি করা হয়েছে তা সত্য নয়। আসলে বর্ণবাদী মানসে সংস্কৃতকে সেবা করতেই তা করা হয়েছে।“
সূত্র— ফেসবুকে ‘অক্ষর শুদ্ধ বানান ও ভাষাচর্চা’ গ্রুপে গরিব নেওয়াজের লেখা।