অশোক সেনগুপ্ত
আমাদের ভারত, ২১ মে: “বেলা যে পড়ে এলো, জলকে চল।“
ফেসবুকে ‘শুদ্ধ বানান চর্চা’ গ্রুপে এই বাক্যটির বিশ্লেষণ করে দেওয়ার অনুরোধে ১৩৩টি মন্তব্য এসেছে। এর মধ্যে তিনটি গ্রহণযোগ্য উত্তর এখানে দিলাম। কৌশিকি সেনগুপ্ত লিখেছেন, “বাক্যটি বাংলার আঞ্চলিক উপভাষা ‘ঝাড়খন্ডী’-র উদাহরণ। বেলা পড়ে এসেছে, অর্থাৎ বিকেল হয়ে এসেছে প্রায়। তাই অল্পবয়সী মেয়েটি তার সখীকে জল আনতে যাবার জন্য ডাকতে এসেছে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘বধু’ কবিতার অংশ এটি। গ্রাম বাংলার সহজ সরল জীবনে অভ্যস্ত অল্পবয়সী মেয়েটি বধূ হয়ে এসেছে শহরের গলিতে মোড়া একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারে। এখানে বধুটির জীবন অনেক নিয়মের গন্ডীতে বাঁধা। মেয়েটি তার বিবাহপূর্ববর্তী গ্রাম্য সরল জীবনের কথা মনে করছে, সে কথা বোঝাতে গিয়ে কবি উপরোক্ত উক্তিটির অবতারণা করেছেন।“
নিমা সহেলি লিখেছেন, “জল কে চল— এই বাক্যে ‘কে’ বিভক্তি নিমিত্ত অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। এর সহজ অর্থ হচ্ছে জলের জন্য চল বা জলের নিমিত্তে চলো। এখানে ব্যবহৃত বিভক্তিটি দ্বিতীয়া বিভক্তি নয়, চতুর্থী বিভক্তির (তৎপুরুষ সমাসে) উদাহরণ।“
শাহিন আখতার লিখেছেন, “এটা রবীন্দ্রনাথ রচিত, সঞ্চয়িতা গ্রন্থের “বঁধু” কবিতা হয়, তাহলে এটি নিঃসন্দেহে নিছক জল সংগ্রহ নয়। বরং অসীমের আহবান এবং সে আহবানে সাড়া দেওয়ার পাথেয় সম্পর্কে ইংগিত করা হয়েছে। যেখানে মৃত্যু পরবর্তী জীবনের ডাক কে বুঝানো হয়েছে।“
রাজদীপ মাহাতো লিখেছেন, “অধিকাংশ ব্যকরণ বইয়ে ‘ঝাড়খণ্ডী উপভাষা’ -র রূপতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যে নিমিত্ত এবং অধিকরণ করকে -কে বিভক্তির উদাহরণ হিসেবে লাইনটি দেওয়া হয়েছে। যা এই উপভাষার ক্ষেত্রে সঠিক। কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর কবিতায় এই অর্থেই ব্যবহার করেছেন। আবার ‘কুমিরডাঙা’ খেলায় ‘কুমির’কে উত্যক্ত করতে বারবার ” কুমির তোর জলকে (জলে, অধিকরণ) নেমেছি!” বলা হয়। (কেন্দ্রীয় রাঢ়ী উপভাষা অঞ্চলে) তাই একটা বিতর্কের জায়গা থেকেই যাচ্ছে!“
এ প্রসঙ্গে আনন্দবাজার পত্রিকার প্রাক্তন উপ বার্তা সম্পাদক শম্ভু সেনের ব্যাখ্যা, “রবীন্দ্রনাথের ‘মানসী’ কাব্যগ্রন্থের ‘বধূ’ কবিতার প্রথম লাইন ‘বেলা যে পড়ে এল, জলকে চল্’। এ ব্যাপারে উপরে যে মন্তব্যগুলো পড়লাম, তার সব ক’টিই ঠিক। স্বাভাবিক ভাবেই এই ছত্রটির দু’টি অর্থ আছে – একটি, ওপর ওপর পড়ে যে অর্থ মনে হয়, আর দ্বিতীয়টি, অন্তর্নিহিত অর্থ। বেলা যে পড়ে এল, জলকে চল্ – এটি গ্রামবাংলা, বিশেষ করে রাঢ়বাংলার কথ্য ভাষা। এর মোদ্দা অর্থ – দিনের আলো পড়ে যাচ্ছে অর্থাৎ দিন শেষ হয়ে আসছে, পুকুরে চল। তখনকার দিনে বিদ্যুৎ ছিল না, গ্রামে তো নয়ই। গ্রামের বধুরা সংসারের যাবতীয় কাজ দিনের আলোর মধ্যে সেরে ফেলতেন। তার পর সন্ধে নামার আগে দল বেঁধে পুকুরে গিয়ে সেখানে নেয়ে (স্নান করে) কলসিতে জল ভরে কাঁখে নিয়ে ফিরতেন। কলসিকাঁখে বধূরা একটা ছবি সৃষ্টি করতেন। সে অন্য প্রসঙ্গ। জল নিয়ে ফিরে তার পর বাড়িতে সন্ধে দেওয়ার পালা। তাই সখী ডাক দিচ্ছে – দিনের আলো শেষ হয়ে এল, পুকুরে (নদীতে বা অন্য জলাশয়ে) চল। এখানে ‘জলকে’-র অর্থ ‘জলে’, অর্থাৎ জলাশয়ে যাওয়ার ডাক। ঠিক যেমন, কুমির তোর জলকে নেমেছি, অর্থাৎ কুমির তোর জলে নেমেছি (যেমনটি বলেছেন রাজদীপ)। আর অন্তর্নিহিত অর্থ সম্পর্কে শাহিন আখতার যা বলেছেন তা-ই। ‘বেলা যে পড়ে এল’ অর্থাৎ জীবন তো শেষ হয়ে এল। জলকে চল্ – জল তো অসীম। এ বার অসীমের আহ্বানে সাড়া দেওয়ার পালা।“
বাংলা সাহিত্যর গবেষক সুমন চন্দ্র দাস প্রতিক্রিয়ায় এই প্রতিবেদককে জানিয়েছেন, “রবীন্দ্রনাথের বঁধু কবিতার লাইন। এখানে আভিধানিক অর্থ ‘জলকে চল ‘ কেবল জল আনতে যাওয়া যা গ্রাম্য লৌকিক কথা বলার অবকাশ মাত্র।কিন্তু এর লক্ষণ্যা হল পুকুর বা নদীতে জল আনতে যাওয়ার কথা। আর ব্যঞ্জনা হল বেলা শেষ হয়ে আসছে জীবন আয়ুর কাল সীমারেখা অতিক্রম করে রূপ থেকে অরূপের পথে যাত্রা। কালের প্রবাহে অন্তত পথে যাত্রা।”
***