বাংলা বানান, শব্দের উৎস, প্রবাদের নানা কথা, সংকলন দ্বিতীয় পর্ব – অশোক সেনগুপ্ত

সূচি
২৬। ই, ঈ
২৭। ন্ড ণ্ড(ক্রমশ)/ মারি তো গন্ডার লুঠি তো ভান্ডার।
২৮। ন্ড ণ্ড (২য় অংশ)
২৯। ন আর ণ
৩০। বাংরেজি
৩১। ক্রিয়াপদের শেষে ও-কার
৩২। য– ফলা
৩৩। নির্দেশক— টি, টা, টুকু, খানি, খানা প্রভৃতি
৩৪। ‘ধানক্ষেত’ না কী ‘ধানখেত’?
৩৫। শব্দের উৎপত্তি
৩৬। রেফ এর প্রয়োগ
৩৭। ‘রেফ’-এর ঝামেলা
৩৮। হ্রস্ব ই আর দীর্ঘ ই
৩৯। উ ঊ
৪০। দুরবস্থা/ দুরাচার
৪১। বুদ্ধিজীবী, ই, ঈ
৪২। বোমাবাজি, ই, ঈ
৪৩। জাতীয়, ই, ঈ
৪৪। ভূত, কিন্তু ভুতুড়ে, উ ঊ
৪৫। হয়তো, সে তো
৪৬। নির্জন, নীরব
৪৭। ‘স্ট’ এবং ‘ষ্ট’ ব্যবহার
৪৮। সসেমিরা মানে কী?
৪৯। সমাসবদ্ধ পদ ও বহুবচন রূপী শব্দ
৫০। মন্ত্রী কিন্তু মন্ত্রিত্ব? তবে কি মন্ত্রিসভা, মন্ত্রিপরিষদ?

আমাদের ভারত, ২০ জুন:
২৬।
ই, ঈ

ছোটবেলার দীঘা, চীন—হ্রস্ব ই হয়ে গেছে। বিভ্রান্তি সূচি/সূচী, আগামি/আগামী, শহীদ/শহিদ, হীরক/ হিরক— এ রকম বেশ কিছু বানান নিয়ে। মাঝে মাঝে ভিন্ন বানান দেখি। আনন্দবাজার পত্রিকার প্রাক্তন উপ বার্তা সম্পাদক শম্ভু সেনের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, এগুলো কী হওয়া উচিত?

শম্ভুদা জানান, “শুধু দীঘা, চীন কেন, ছোটোবেলার অনেক কিছুই তো ই-কার হয়ে গিয়েছে – বাড়ী, মাসী, পিসী, কাকীমা, জেঠীমা, বাঙালী – আরও কত শব্দ! এর যথেষ্ট যুক্তিসংগত কারণ আছে। যে উদাহরণগুলো রয়েছে সেগুলির সঠিক বানান হল সূচি, শহিদ, আগামী, হীরক। বাংলাভাষায় ই-কার ও ঈ-কারের প্রয়োগ নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে। ভাষা তো স্থবির নয়, সব সময়েই গ্রহণ, বর্জন, সংশোধনের প্রক্রিয়া চলে। যে শব্দগুলো অবিকৃত অবস্থায় সংস্কৃত থেকে বাংলা শব্দ ভাণ্ডারে যোগ হয়েছে, সেগুলো তৎসম শব্দ। তৎসম মানে তার সমান। এখানে তার বলতে কী বোঝাচ্ছে? তার বলতে সংস্কৃতকে বোঝাচ্ছে।

এখন প্রশ্ন হল, কোথায় ই-কার হবে আর কোথায় ঈ-কার হবে? এ নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করা যায়। কিন্তু সংক্ষেপে বলি, অ-তৎসম শব্দের ক্ষেত্রে ই-কার হবে। আগামী, হীরক এগুলো তৎসম শব্দ তথা সংস্কৃত শব্দ। তাই ঈ-কার হবে। কিন্তু হীরক থেকে হবে ‘হিরে’ বা ‘হিরা’, কারণ ‘হিরে’ বা ‘হিরা’ তো আর তৎসম শব্দ নয়। তাই ‘হিরে’, ‘হিরা’ ই-কার। ঠিক সে ভাবেই গৃহিণী – তৎসম শব্দ। তা থেকে গিন্নি – অ-তৎসম শব্দ।

সূচি, শহিদ, বাড়ি, মাসি, পিসি, কাকিমা, জেঠিমা, বাঙালি – সব অ-তৎসম শব্দ। তাই ই-কার।

আর ‘দিঘা’, ‘চিন’ – এগুলোও যে সংস্কৃত তথা তৎসম শব্দ নয়, তা আমরা ভালোই জানি। সুতরাং দীঘা, চীন নয়; দিঘা, চিন। বিদেশি শব্দের ক্ষেত্রে কখনোই ঈ-কার হবে না, সে যতই তার বানানে ‘ee’ থাকুক। যেমন Leeds (ইংল্যান্ডের শহর), আমরা লিখব লিডস্।

এখানে একটা কথা মনে করিয়ে দিই। যদি কোনো বিদেশি বা অ-তৎসম শব্দের সঙ্গে সংস্কৃত ঈয় প্রত্যয় যোগ হয়, তা হলে ঈ-কার হবে। যেমন অস্ট্রেলিয়া থেকে অস্ট্রেলীয়, আলজিরিয়া থেকে আলজিরীয়, এশিয়া থেকে এশীয় ইত্যাদি।”
***

২৭।
ন্ড ণ্ড(ক্রমশ)

মারি তো গন্ডার লুঠি তো ভান্ডার। গন্ডার, ভান্ডার বানানদুটো ঠিক আছে কি? নাকি ভাণ্ডার গণ্ডার? প্রশ্নটায় যে কোনও বঙ্গসন্তানকে ঘাবড়ে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ঠ। কোথায় ন্ড, আর কোথায় ণ্ড হবে, তা আগ্রহীদের সহজ করে বুঝিয়ে দেওয়ার আর্জি রেখেছিলাম আনন্দবাজার পত্রিকার প্রাক্তন উপ বার্তা সম্পাদক শম্ভু সেনের কাছে।

তিনি জানিয়েছেন, “কোথায় ‘ণ্ড’ হবে আর কোথায় হবে ‘ন্ড’, এটিও নির্ভর করছে শব্দটি কী জাতীয় – অর্থাৎ তৎসম নাকি অ-তৎসম শব্দ তার উপর। তৎসম শব্দের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হচ্ছে সংস্কৃত ণত্ব-বিধান। অর্থাৎ শুধুমাত্র তৎসম শব্দের ক্ষেত্রেই ‘ণ্ড’ হবে – কাণ্ড, কুণ্ড, কুণ্ডলী, খণ্ড, গণ্ড, চণ্ড, চণ্ডী, চণ্ডালী, তণ্ডুল, দণ্ড (এবং দণ্ড দিয়ে যত শব্দ হয় – যেমন দণ্ডাজ্ঞা, দণ্ডনীয়, দণ্ডকারণ্য, দণ্ডাদেশ ইত্যাদি), পণ্ড, পণ্ডশ্রম, পণ্ডিত, প্রচণ্ড, মণ্ডল, মণ্ডলী, মুণ্ড, মুণ্ডপাত ইত্যাদি।

তৎসম নয়, এমন সব শব্দের ক্ষেত্রে অর্থাৎ বাংলা, দেশি, বিদেশি সব শব্দের ক্ষেত্রে ‘ন্ড’ হবে। যেমন – গন্ডার (ভুল করে অনেকেই গণ্ডার লেখেন), ঝান্ডা, ঠান্ডা (ভুল করে অনেকেই ঠাণ্ডা লেখেন), মুন্ডা, মুন্ডারি, কান্ডারি, লন্ডভন্ড, লন্ডন ইত্যাদি।
গণ্ডগোল – এই শব্দটির দু’টি ভাগ – গণ্ড আর গোল। গণ্ড সংস্কৃত শব্দ, বিশেষণ। এর আদত অর্থ হল শ্রেষ্ঠ, প্রধান, অত্যধিক ইত্যাদি। তাই ‘গণ্ডগোল’ শব্দের অর্থ অত্যধিক গোলমাল। এই প্রসঙ্গে আরও একটি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করি – কালে কালে কী ভাবে শব্দের অর্থ পালটে যায়। আমরা অজ পাড়াগাঁ বোঝাতে লিখি গণ্ডগ্রাম। কিন্তু আদতে গণ্ডগ্রাম শব্দের অর্থ হল প্রধান গ্রাম।“

আগামীকাল থাকবে এই বিষয়ে বাড়তি আলোকপাত।
***

২৮।
ন্ড ণ্ড (২য় অংশ)

কখন ন্ড আর কখন ণ্ড হওয়া উচিত, গতকাল এ ব্যাপারে অভিজ্ঞ শম্ভু সেনের মতামত আমরা দেখেছি। ফেসবুকে ‘শুদ্ধ বানান চর্চা’ (শুবাচ) গ্রুপে শুভাশিস চিরকল্যাণ পাত্র (২০১৭, ২৪ জুন) এ বিষয়ে অনেকটা আলোকপাত করেছেন।

তিনি লিখেছেন, “ ‘ব্যান্ডেল’-এ গণ্ডগোল! অণ্ড, কাণ্ড, মণ্ড, প্রকাণ্ড, ভণ্ড ইত্যাদি শব্দে ণ্ড হয়; ন্ড হয় না। প্রশ্ন : তাহলে Bandel (পশ্চিমবঙ্গের হুগলী জেলার একটি শহর) শব্দটি বাংলায় লেখার সময় ব্যাণ্ডেল লিখব, না ব্যান্ডেল লিখব? এই ব্যাপারে আমার মনে হয় যে অণ্ড, ভণ্ড ইত্যাদি শব্দের মতো এই ক্ষেত্রেও ণ্ড ব্যবহার করলে সমস্যা হয় না।

কিন্তু আজকাল অনেকেই ণ্ড-এর বদলে ন্ড ব্যবহার করে শব্দটিকে ‘ব্যান্ডেল’ লিখছেন। এর পিছনে ওদের যুক্তি হল Bandel শব্দটি একটি বিদেশী শব্দ এবং বিদেশী শব্দে ণ্ড ব্যবহার করা চলবে না। আমার কিন্তু মনে হয় অণ্ড, কাণ্ড প্রভৃতি শব্দের মতো ব্যাণ্ডেল শব্দেও ণ্ড ব্যবহার করলে সবরকম শব্দের ক্ষেত্রে একই রকম বানানরীতি বজায় থাকে, যা সুবিধাজনক। প্রসঙ্গত, ব্যাণ্ডেল স্টেশনের পুরনো বোর্ডগুলিতে আজও ব্যাণ্ডেল বানান লেখা আছে, হাল আমলের নতুন বোর্ডগুলিতে ‘ব্যান্ডেল’ বানান লেখা হয়েছে। প্রশ্ন : বিদেশী শব্দের ক্ষেত্রে ণ্ড ব্যবহার করলে দোষ কোথায়?

আরও প্রশ্ন : Bandel, band, pendulum ইত্যাদি শব্দে যদি ন্ড ব্যবহার করা হয় (যেটা অধুনা অনেকেই করছেন) তবে অণ্ড, ভণ্ড, পণ্ডিত ইত্যাদি শব্দে ন্ড ব্যবহার করা যাবে না কেন? পণ্ডিত, অণ্ড ইত্যাদি শব্দের ণ্ড-এর সঙ্গে Bandel-এর nd এর উচ্চারণের তফাৎ কতটা? এখানে মনে রাখতে হবে যে আমাদের যেখানে ন, ণ দুটি বর্ণ আছে সেখানে ইংরাজীতে শুধু n আছে। আমাদের কোথায় ণ, কোথায় ন হবে তার নির্দ্দিষ্ট নিয়ম আছে। বর্তমান ক্ষেত্রে ণ ও ড একই বর্গের (ট ঠ ড ঠ ণ) বলে ণ্ড (ণ +ড) হওয়াই বাঞ্ছনীয় বলে আমি মনে করি।

প্রসঙ্গত, শ্রীজ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের ‘বাংলা ভাষার অভিধান’ গ্রন্থে ‘ব্যাণ্ড’ বানান আছে, ‘ব্যান্ড’ নয়। আমার মতে এটা উনি ঠিকই করেছেন। কিছুকাল আগে বাঁকুড়া শহরের ভৈরবস্থানের কাছে ‘লিজেণ্ড’ নামে একটি বিউটি পার্লারের বিজ্ঞাপন দেখেছিলাম। তারা ইংরেজী Legend শব্দের লিপ্যান্তর করেছেন ‘লিজেণ্ড’ এবং আমার মতে সেটা ঠিকই করেছেন।

অধুনা আমাদের বাংলা একাডেমি যে বিদেশী শব্দে ণ ব্যবহার না করার কথা বলে তা আমি জানি। কিন্তু একাডেমির এই বিধির পিছনে যথেষ্ট সুযুক্তি আছে কিনা তা নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। আমার তো বারে বারে মনে হয় যে বাংলা একাডেমি বাংলার নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিতে পারছে না এবং ভাষার ক্ষেত্রে আমরা আজও ইংরেজির দাসত্ব করে চলেছি। আমি তাই বানানের ক্ষেত্রে শ্রীহরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ও শ্রীজ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস মহাশয়ের অভিধান অনুসরণ করতে শুরু করেছি। ঐ দুই অভিধানে প্রদত্ত বাংলা বানানগুলি ব্যাকরণ ও নিরুক্তের বিচারে যুক্তিপূর্ণ বলে আমার মনে হয়েছে।

বানান যে সর্ব্বদা উচ্চারণ অনুসারী হতে হবে তা কিন্তু নয়। যেমন আমরা লিখি ‘বলছি’, কিন্তু উচ্চারণ করি ‘বোলছি’। লেখা হয় pneumonia, কিন্তু উচ্চারণ করা হয় নিউমোনিয়া (p বাদ)। তেমনি পণ্ডিত, পণ্ড, খণ্ড ইত্যাদি শব্দগুলিতেও ণ-এর সঠিক উচ্চারণ না হলেও শব্দগুলি ওইরকম লেখা হয় এবং সেটা দোষের নয়।

একইভাবে উচ্চারণ ‘ব্যান্ডেল’ (বা তার কাছাকাছি) করলেও বানান ‘ব্যাণ্ডেল’ লিখলে তা দোষের হয় না, বরং পণ্ডিত, খণ্ড ইত্যাদি শব্দগুলির সঙ্গে একত্রে স্থান পেয়ে তা আমাদের ব্যাকরণ ও নিরুক্তের রীতিকে ধরে রাখে। এছাড়া ভাষায় ভাষায় গভীর সম্পর্ক থাকে এবং শেষ বিচারে কোনো ভাষাই বিদেশী নয়। তাই শব্দের দেশি-বিদেশি জাতপাত বিচার না করে প্রাচীনদের মতো একরকম বানানবিধি চালু রাখার কথা আমরা বিবেচনা করতেই পারি। সেটা করলে অধুনা বানান নিয়ে যেসব বিশৃঙ্খলা হচ্ছে সেগুলি দূর করার একটা ভালো উপায় পাওয়া যায়।“

এ প্রসঙ্গে অভিজ্ঞ অধ্যাপক তথা প্রাক্তন উপাচার্য ডঃ অচিন্ত্য বিশ্বাসের মন্তব্য, “পুরোন সাহিত্যে -এর রূপ (morph) একালের পণ্ডিতরা বোঝেননি। ষ্ণ-এর morph -ও তাই। আসলে সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত ণ লেখা হত ল-এর মত। ণ্ড ষ্ণ -এর বোঝায় সেই ইতিহাস রয়ে গেছে। একে অন্য ভাবে লেখা ঠিক নয়। তাতে পুরোন সাহিত্যের সঙ্গ বিচ্ছেদ হতে বাধ্য। বিদেশি শব্দে ন্ড হলে আপত্তি নেই।“
***

২৯।
ন আর ণ

বানানে ন আর ণ-এর গন্ডগোল নিয়ে আলোচনা করেছি। ‘ণত্ববিধির কায়কারবার’ শিরোনামে ফেসবুকে ‘অক্ষর শুদ্ধ বানান ও ভাষা চর্চা’ গ্রুপের অ্যাডমিন বাংলার অভিজ্ঞ শিক্ষক ঝলক দাস লিখেছেন, “অঙ্গন কিন্তু প্রাঙ্গণ। একই প্রকৃতির দুটি শব্দের বানান দু-রকম। প্র+অঙ্গন = প্রাঙ্গণ। অঙ্গন-এর সঙ্গে ‘প্র’ যোগ হলে দন্ত্য-ন মূর্ধন্য-ণ হয়ে যায়। এর ব্যাখ্যা কী? আসলে এটি ণত্ববিধির কারবার।

শব্দ দুটির বর্ণবিশ্লেষণ : অঙ্গন = অ+ঙ্+গ+ন, প্রাঙ্গণ = প্+র+আ+ঙ্+গ+ণ। সরলভাবে বললে প্রাঙ্গণ শব্দে ‘র’ আছে, এজন্য এখানে মূর্ধন্য-ণ হয়েছে। অঙ্গন শব্দে ‘র’ নেই, তাই এখানে দন্ত্য-ন হয়েছে। উল্লেখ্য, র-এর পরে স্বরবর্ণ বা ক-বর্গের বর্ণব্যবধান থাকলে তারপর মূর্ধন্য-ণ হবে।

প্রধান কিন্তু প্রমাণ
এ দুটি শব্দের বর্ণবিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, প্রধান = প্+র+ধ+আ+ন, এবং প্রমাণ = প্+র+ম+আ+ণ। লক্ষণীয়, এখানে উভয় শব্দে ‘র’ আছে, অথচ প্রধান শব্দে দন্ত্য-ন, কিন্তু প্রমাণ শব্দে মূর্ধন্য-ণ হয়েছে। কারণ র-এর পরে প-বর্গের (প ফ ব ভ ম*) বর্ণ থাকলে মূর্ধন্য-ণ এবং ত-বর্গের (ত থ দ ধ* ন) বর্ণ থাকলে দন্ত্য-ন হবে।“
***

৩০।
বাংরেজি

আমাদের কথ্য ভাষায় ইংরেজি শব্দের আধিক্যের ব্যধি ঢুকে পড়েছে পোর্টাল এবং অনলাইনের সংবাদেও। তাই মেধাতালিকা, মর্যাদা লিখতে কষ্ট হয়। মাথায় প্রথমেই আসে মেরিট লিস্ট, স্ট্যাটাস-এর মত শব্দ। এই তালিকা অত্যন্ত দীর্ঘ।

বাংলা ভাবনায় এই দীনতা ফুটে ওঠে গড় বাঙালির লেখায়। কিন্তু বাংলায় সাংবাদিকতার সময় আমরা কেন সতর্ক এবং যত্নবান হব না? অভিজ্ঞ সাংবাদিক সুমন চট্টোপাধ্যায় তাঁর মত করে সুন্দর আলোচনা করেছেন ইউ টিউবে। বিষয়— ‘দ্বিভাষিক বাঙালির পুনর্জন্মের প্রয়োজন’।

অনেকে দাবি করেন, অনেক ইংরেজি কথার সঠিক ভাব বাংলায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। আমি বলি, এটা অজুহাত। অবস্থা বুঝে অবশ্যই করা সম্ভব। যেমন, রামের অবস্থা খুব সিরিয়াস। না বলে আমরা বলতে পারি না রামের অবস্থা উদ্বেগজনক বা চিন্তার? পড়াশোনার ব্যাপারে রাম খুব সিরিয়াস না বলে আমরা বলতে পারি না, খুব যত্নবান বা মনোযোগী?আমি সিরিয়াসলি বলছি না বলে দায়িত্ব নিয়ে বলছি বলতে পারি না?

টেবিলকে চৌপায়া, চেয়ারকে কেদারা লিখলে পাঠকের চোখে লাগবে। কিন্তু থ্রি রুম না বলে তিন কক্ষের, বেড-কে শয্যা বা বিছানা, এয়ারপোর্টে বিমানবন্দর না লেখার যুক্তি কোথায়? সামাজিক মাধ্যমের খবরগুলো পড়তে পড়তে প্রতি পদে প্রশ্ন ওঠে এ নিয়ে।
***

৩১।
ক্রিয়াপদের শেষে ও-কার

সাধারণভাবে অনুজ্ঞা ছাড়া অন্যান্য ক্রিয়াপদের শেষে ও-কার ব্যবহার নিয়ে প্রায়ই বিভ্রান্তি দেখা যায়। যাব না যাবো? খাব না খাবো?

প্রবীন শিক্ষক এবং ফেসবুকে ‘অক্ষর শুদ্ধ বানান ও ভাষাচর্চা‘ গ্রুপের স্বপন ভট্টাচার্যের মতে, “এই ও-কারের ব্যবহারের বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করেছে পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি এবং ঢাকা বাংলা একাডেমি এবং সেই মতো নির্দেশ‌ও তাদের পক্ষ থেকে জারি করা হয়েছে। এই নির্দেশে আপত্তিকর কিছু নেই বলেই আমার ধারণা। কিন্তু সেই সঙ্গে আবার বলা হল যে সমস্ত ক্ষেত্রে অর্থ বিভ্রাটের সম্ভাবনা আছে সেখানে ক্রিয়াপদের শেষে ও-কার দেওয়া যেতে পারে। যেমন: ‘হলো’, ‘হতো’। এই বিকল্প ব্যবস্থাটিই আমার মতে আপত্তিকর।

অসংখ্য বাংলা শব্দ আছে (ক্রিয়া এবং অন্যান্য পদ) যেখানে অর্থ বিভ্রান্তির সম্ভাবনা থাকেই। সেই সব জায়গায় পুরো বাক্যে সেই শব্দের প্রয়োগ দেখে তার অর্থ নির্ধারণ করতে হয়। অনেক সময় পুরো বাক্যটি পড়েও সেই শব্দের সঠিক অর্থ বোঝা যায় না। পুরো অনুচ্ছেদ বা পুরো লেখাটা পড়ার পরেই সেই শব্দের অর্থ বোধগম্য হয়।

‘ঘরে চাল নেই’। এই বাক্যে ‘চাল’ শব্দের অর্থ কী? ঘরে ‘ছাদ’ নেই না কি ঘরে ‘তণ্ডুল’ নেই? তাহলে কি একটা ‘চাল’ আর অন্যটা ‘চাল্’ লিখতে হবে? এছাড়াও ‘চাল’ শব্দে আচরণ বা দানও বোঝায় (দাবার চাল)। ক্রিয়াপদ হিসেবেও কিন্তু ‘চাল’ শব্দের ব্যবহার আছে।

আর নিম্নলিখিত ক্ষেত্রেই বা আমরা বিভ্রান্তি এড়াতে কী করব?
১. তুই বল
২. তুমি বল
৩. আমার শরীরে বল নেই
৪. বল খেলতে হলে মাঠে যাও

অথবা
১. তুই কর
২. তুমি কর
৩. সময়মতো কর দাও
৪. করমর্দন কর
এই রকম আরও অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়। তাই আমার মতে শুধু হল আর হত শব্দে ও-কার লাগানোর নিয়মের আদৌ কোন‌ও প্রয়োজন নেই।“

বাংলার গবেষক সুমন চন্দ্র দাস এই মতকে সমর্থন করেছেন। আনন্দবাজার পত্রিকার প্রাক্তন উপ বার্তা সম্পাদক শম্ভু সেনের মতে, “আমি স্বপনবাবুর সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত। অভিন্ন বানানের কারণে বাংলা ভাষায় অর্থ বিভ্রাটের সম্ভাবনা বহু ক্ষেত্রে হতে পারে। কিন্তু হয় না। পুরো বাক্য পড়ে বা পুরো অনুচ্ছেদ পড়ে অর্থ ধরতে হয়। সুতরাং অর্থ বিভ্রাট হতে পারে, এই ভেবে ‘হলো’ বা ‘হতো’ লেখার যুক্তি নেই।“

প্রাক্তন উপাচার্য তথা বাংলার অভিজ্ঞ অধ্যাপক ডঃ অচিন্ত্য বিশ্বাস প্রতিক্রিয়ায় জানিয়েছেন, “বাংলা ভাষার নিজস্ব উচ্চারণ-বিধি আছে। বিদেশিদের পক্ষে অসুবিধাজনক। কলকাতা যে ‘কোল্ কাতা’ তা লিখে দেখাবার দরকার পড়ে না। শব্দের সূচনায় আমরা কখনো কখনো ‘অর্ধ বিবৃত অ-ধ্বনি (ইংরেজি got-র o-এর মত)’ উচ্চারণ করি।

অধিকাংশ মধ্যবর্তী ও শেষের অ-স্বরের শব্দে আমরা হলান্ত উচ্চারণ করি। এগুলোতে হসন্ত দিতে গেলে আঙুলে ব্যথা হবে!

‘বেলা যে পড়ে এল জলকে চল’-এর শেষের ল দুটিতে হসন্ত না দিলেও বাঙালি ভুল করবে না। তবু কিছু শব্দে দু’ধরনের বানান চলছে। এগুলো নিয়ে বিস্তৃত অনুপুঙ্ক্ষ আলোচনা চাই।“
***

৩২।
য– ফলা

অত্যধিক/অত্যাচার, ব্যবস্থা/ব্যাখ্যা— ‘বানানের টিপস্’ কলমে স্বপন ভট্টাচার্য লিখেছেন, “উপরের শব্দগুলোর বানান লক্ষ করে দেখুন। প্রথম শব্দে ‘ত্য’ থাকলেও পরের শব্দটায় কিন্তু ‘ত্যা’ আছে। কেন? এর কারণ হচ্ছে সন্ধির একটা নিয়ম। কী সেই নিয়ম?

যদি কোন‌ও শব্দের শেষে ই-কার বা ঈ-কার থাকে আর পরের শব্দটা (শব্দ না হয়ে প্রত্যয়‌ও হতে পারে) কোন‌ও স্বরবর্ণ দিয়ে শুরু হয় তবে ই বা ঈ বদলে গিয়ে য-ফলা হয়ে যায়। আর পরের স্বরবর্ণটা ‘কার’ চিহ্ন হয়ে ওই য-ফলার পরে বসে। (সূত্র: ই/ঈ+ ই/ঈ ছাড়া অন্য স্বর = য-ফলা+স্বর।)

উপরের দুটো শব্দ নিয়েই প্রথমে আলোচনা করা যাক। অতি+অধিক = অত্যধিক এবং অতি+আচার = অত্যাচার। প্রথম শব্দে ই-কার বদলে য-ফলা হল বটে কিন্তু তার পরে আছে ‘অ’। আর ‘অ’-এর কোন‌ও ‘কার’ চিহ্ন নেই তাই য-ফলার সঙ্গে কোন‌ও ‘কার’ চিহ্ন এল না। শব্দটা হয়ে গেল ‘অত্যধিক’। আর দ্বিতীয় শব্দে ই-কার বদলে য-ফলা তো হল‌ই তার পরের ‘আ’ বর্ণটা আ-কার হয়ে য-ফলার সঙ্গে জুড়ে গেল আর শব্দটা হয়ে গেল ‘অত্যাচার’।

আর আমাদের উচ্চারণের দোষেই হোক বা অত্যাচার জাতীয় শব্দের অনুষঙ্গেই হোক আমরা অনেক সময় ‘অত্যাধিক’ লিখে ফেলি। তাই এখন থেকে আমরা মনে রাখব ,
অতি+অন্ত = অত্যন্ত, ইতি+অবসরে = ইত‌্যবসরে, অতি+আবশ্যক = অত্যাবশ্যক, ইতি+আদি = ইত্যাদি, প্রতি+অন্ত = প্রত্যন্ত, আদি+অন্ত = আদ্যন্ত, প্রতি+আশা = প্রত্যাশা, প্রতি+আঘাত = প্রত্যাঘাত, প্রতি+এক = প্রত্যেক, প্রতি+ঊষ = প্রত্যূষ, অনুমতি+অনুসারে= অনুমত্যনুসারে (কিন্তু, আজ্ঞা+অনুসারে= আজ্ঞানুসারে [সন্ধিসূত্র আ+অ = আ], আদেশ+অনুসারে =আদেশানুসারে [সন্ধিসূত্র অ+অ = আ])‌।

আর তাই প্রতি+অর্পণ – প্রত্যর্পণ হলেও প্রতি+আবর্তন – প্রত্যাবর্তন। আবার বি পূর্বক শব্দগুলো নিয়েও আমাদের সমস্যার অন্ত নেই। বি+অবস্থা – ব্যবস্থা হলেও আমরা ভুল করে ‘ব্যাবস্থা’ লিখে ফেলি। ঠিক সেই কারণেই ব্যবহার, ব্যতিক্রম, ব্যভিচার, ব্যর্থ, ব্যয়, ব্যথা এই শব্দগুলোতে ‘ব্য’। আবার ব্যাখ্যা, ব্যাপার, ব্যাকরণ, ব্যাকুল এগুলোতে ‘ব্যা’।

তবে যদি ‘পরি’ শব্দের পর ই/ঈ ছাড়া অন্য কোনো স্বর আসে তাহলে? র-এ তো য-ফলা দেওয়া যাবে না। তখন আবার ওই ‘র’ হয়ে যাবে ‘রেফ’ আর য-ফলা না হয়ে থাকবে শুধু ‘য’। যেমন:- পরি+অন্ত = পর্যন্ত, পরি+আলোচনা = পর্যালোচনা, উপরি+উপরি = উপর্যুপরি।

তবে মনে রাখতে হবে ই, ঈ-এর পর আবার ই বা ঈ এলে কিন্তু হয়ে যাবে ‘ঈ-কার’। প্রতীক্ষা, পরীক্ষা, অতীত।

প্রাক্তন উপাচার্য তথা বাংলার অভিজ্ঞ শিক্ষক ডঃ অচিন্ত্য বিশ্বাস সংযোজন করেছেন— “স্বর-সন্ধির বিধি — ই+ (ই /ঈ ছাড়া অন্য স্বর)= য-ফলা + পরের স্বর।
অতি + আচার =অত্যাচার, প্রতি + উপকার= প্রত্যুপকার। কঠিন নয়।”
***

৩৩।
নির্দেশক

‘বানানের টিপস্’- সিরিজে অভিজ্ঞ শিক্ষক স্বপন ভট্টাচার্য লিখেছেন, “টি, টা, টুকু, খানি, খানা, গাছা, গাছি, গুলো, গুলি, গুলা, সমূহ, রাজি এই শব্দগুলোকে বলা হয় নির্দেশক।

এটাই কিন্তু নির্দেশকের পুরো তালিকা নয়। আরও অনেক আছে। আর এগুলোর মধ্যে সমূহ, রাজি এগুলো সাধারণত সাধু ভাষায় ব্যবহৃত হয়। যেমন: গ্রন্থসমূহ, তরুরাজি। এই নির্দেশকগুলোকে কোনো ব্যক্তি বা বস্তুর সঙ্গে লাগালে তা সেই ব্যক্তি বা বস্তুটাকে বিশেষভাবে নির্দেশ করে। এছাড়াও এগুলো ওই ব্যক্তি বা বস্তুর সংখ্যা বা পরিমাণ‌ও নির্দেশ করে।

যদি বলি, ‘রাস্তায় লোক যাতায়াত করে’, আর ‘রাস্তাটায় লোকটা যাতায়াত করে’। প্রথম বাক্যে বোঝা যাচ্ছে যে কোন‌ও রাস্তাতেই লোক যাতায়াত করে, কিন্তু দ্বিতীয় বাক্যে একটা বিশেষ রাস্তা আর একজন বিশেষ লোকের কথা বলা হয়েছে।

আমরা অনেক সময়ই সংশয়ে পড়ে যাই যে কী লিখব ‘টা’ না ‘টি’ অথবা ‘খানি’ না ‘খানা’? এ বিষয়ে কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম নেই, আপনারা যে কোনো একটা লিখতেই পারেন। তবে নির্দেশক ‘টা’ যোগ করলে সাধারণত কিছুটা তাচ্ছিল্য ভাব প্রকাশ পায়। আবার আকাশটি, মেঘটি এইভাবে লিখলে কখনও কখনও দৃষ্টিকটু মনে হতেও পারে।

সে যাই হোক, আজকের টিপস্ হল যে এই নির্দেশকগুলো শব্দের পরে এলে তা কিন্তু শব্দের সঙ্গে সাঁটিয়ে লিখতে হবে। অর্থাৎ লোকটি, চোরটা, ছাতাখানা, ব‌ইখানি, দুধটুকু, বাড়িগুলো ইত্যাদি লেখার সময় নির্দেশকগুলো আলাদাভাবে লিখলে চলবে না।

অবশ্য কখনও কখনও নির্দেশক আগে এলে তা আলাদা করে লেখা যেতে পারে। যেমন: খান দুই, খান আষ্টেক। তবে ‘খানকতক’ একসঙ্গে লেখাই বাঞ্ছনীয়।
***

৩৪।
“ধানক্ষেত” না কী “ধানখেত”?

ফেসবুকে শুদ্ধ বানান চর্চা গ্রুপে এই প্রশ্নের উত্তরে মৃণাল চন্দ্র জানিয়েছেন, “পল্লীকবি জসীম উদ‌্‌দীনের একটি কবিতার নাম ‘ধানখেত।’ মোহিতলাল মজুমদার অবজ্ঞা করে বলতেন- জসীম উদ্ দীন ‘ধান খেত’।“

এই প্রসঙ্গে ওই গ্রুপের অ্যাডমিন মহম্মদ আমিন লিখেছেন, বাবা শুধু খেতে যায়, ক্ষেতে যায় না। কেন? এখন ক্ষেতে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। বাংলা একাডেমি নাকি সব ক্ষেত নষ্ট করে দিয়েছে। অভিধানেও রাখেনি। তাই সবাই শুধু খেতে যায়। এত খেতে যাচ্ছে বলে খেতে খেতে সব শেষ হয়ে যাচ্ছে।

তাই তো বলি— খাদ্যশস্য আর শাক-সব্‌জির দাম এত বেড়ে যাচ্ছে কেন। আগে যেটা ক্ষেত ছিল, এখন সেটি খেত।
হায়রে আমার ক্ষেত, হারিয়ে গেলি তুই,
এখন আমার কষ্ট অনেক, হচ্ছে খেতে ভুঁই।
একাডেমির ভারি মজা যা-ইচ্ছে-তাই করে
হতভাগা বাঙালিরা ক্ষেত হারিয়ে মরে।”

বাংলার অভিজ্ঞ শিক্ষক তথা প্রাক্তন উপাচার্য ডঃ অচিন্ত্য বিশ্বাসের মতে, “মোহিতলালের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে বলছি, ধানখেত শব্দে ভুল নেই। ধান্য যদি ধান হতে পারে ক্ষেত্র কেন খেত হবে না? এগুলো তদ্ভব শব্দ। অর্থ নিয়ে অতিরিক্ত হৈ চৈ না করাই ভাল। অর্থ অনষঙ্গ নির্ভর। ধানখেতে যাওয়া মানে ধান চিবিয়ে খেতে যাওয়া যে নয়, সবাই বুঝবেন।“
***

৩৫।
শব্দের উৎপত্তি

আমরা নিয়মিত অনেক শব্দ ব্যবহার করি যেগুলোর উৎপত্তির সঠিক উৎস সম্পর্কে জানা নেই। এরকম অজস্র শব্দভান্ডার রয়েছে বাংলা শব্দভান্ডারে। আজ তার গুটিকয়।

*কোলা ব্যাঙ*— উভচর, পেট মোটা এবং আকারে সামান্য বড়ো ব্যাঙকে কোলা ব্যাঙ বলা হয়। ‘কোলা’ ফারসি শব্দ। এর অর্থ : ডোবা, ছোটো পুকুর, অগভীর জলাশয় প্রভৃতি। এরা সাধারণত অগভীর জলাশয় বা ছোটো পুকুরে বাস করে।

*কুনো ব্যাঙ*— গ্রামাঞ্চলে স্যাঁতসেঁতে ঘরের মেঝের কোণে এদের পাওয়া যায়। ঘরের কোণে বসবাস করে বলে এদের নাম ‘কুনো ব্যাঙ’।

*ভাশুর*— সংস্কৃত ‘ভ্রাতৃশ্বশুর’ থেকে কথাটির উদ্ভব। ভাশুর তদ্ভব বা খাঁটি বাংলা শব্দ। সমার্থক শব্দ বটঠাকুর। এটি বাংলা শব্দ।

*অভ্যুত্থান* — শব্দের মূল ও আদি অর্থ কাউকে সম্মান প্রদানের জন্য আসন থেকে উঠা বা উন্নত, উদ্গত হওয়া, অভ্যুত্থিত হওয়া প্রভৃতি। তবে শব্দটি এখন তার মূল অর্থ সম্পূর্ণ হারিয়ে ফেলেছে। এখন অভ্যুত্থান বলতে জোরপূর্বক কাউকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়া অর্থ প্রকাশে ব্যবহৃত হয়।

বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানমতে, অভ্যুত্থান (অভি+উত্থান) অর্থ (বিশেষ্যে) গণআন্দোলন, বিদ্রোহ, সেনাবিদ্রোহ; উত্থান, উদয়; উন্নতি, সমৃদ্ধি।

*নাভিশ্বাস*— আভিধানিক অর্থ শেষ অবস্থা, চরম অবস্থা। মৃত্যুর প্রাক্কালে নাভিদেশ হতে ঊর্ধ্বমুখী যে শ্বাসটান দেখা যায় সেটাকে নাভিশ্বাস বলে। মানুষের জীবনের শেষ মুহূর্তে এমন ঘটনা ঘটে। নাভিশ্বাস উঠলে বুঝতে হবে তার শেষ অবস্থা।
সূত্র— ড. মোহাম্মদ আমীন (শুদ্ধ বানান চর্চা)।
***

৩৬।
রেফ এর প্রয়োগ

য-য়ে য-ফলা থাকলে রেফ হয় না কেন? প্রমিত বাংলা বানানের নিয়মে সমব্যঞ্জনের দ্বিত্বে রেফ বিধেয় নয়। যেমন: বর্ত্তমান নয়, বর্তমান, কর্ম্ম নয়, কর্ম; ধর্ম্ম নয়, ধর্ম, অর্চ্চনা নয়, অর্চনা। বর্জ্জন নয়, বর্জন।

যেহেতু, য-ফলা হচ্ছে য-এর অবিকল ধ্বনি-রূপ, তাই য-য়ে য-ফলা থাকলে তা হবে সমব্যঞ্জনের দ্বিত্ব। কারণ, য্য= য্‌+য। সুতরাং, য্য-এর ওপর রেফ দিলে তা সমব্যঞ্জনের দ্বিত্বে রেফ্‌ হয়ে যায়। এজন্য—
কার্য্যালয় নয়, কার্যালয় [কারণ: র্য্য= র্য্য= র্‌+য্‌+য (য-ফলা)]। সৌন্দর্য্য নয়, সৌন্দর্য। মাধুর্য্য নয়, মাধুর্য। ধৈর্য্য নয়, ধৈর্য। কার্য্য নয়, কার্য, [র্য্য= র্‌+য্‌+য (য-ফলা)] কিন্তু, সামর্থ্য। কারণ, এখানে থ-য়ে আর একটি থ যুক্ত হয়ে ব্যঞ্জনের দ্বিত্ব হয়নি। অনুরূপ— বর্জ্য, মর্ত্য, দৈর্ঘ্য, যথার্থ্য ইত্যাদি।

শব্দের শেষে রেফ-যুক্ত বর্ণ থাকলে এবং তার সঙ্গে কোনও কার-চিহ্ন না থাকলে উক্ত বর্ণটি ও- কারযোগে উচ্চারিত হবে। যেমন: গর্ব। এখানে শব্দের শেষে রেফ-যুক্ত বর্ণ ‘র্ব’ আছে এবং এর সঙ্গে কোনও কার-চিহ্ন যুক্ত নেই। তাই এখানে ‘ব’-এর উচ্চারণ ও-কারযোগে ‘বো’ এর মতো হবে। সুতরাং এর উচ্চারণ হবে ‘গর্ বো’ (‘গর্ ব’ নয়)।
আরও উদাহরণ:
বর্ণ (বর্ নো), পর্ণ (পর্ নো), কর্ণ (কর্ নো), স্বর্ণ (শর্ নো), দর্প (দর্ পো), সর্প (শর্
পো)।

সূত্র ১) শুদ্ধ উচ্চারণ চর্চা
২) মোহাম্মদ আমীন (বাংলা আমার ভালো নেই: সমগ্র সংযোগ)।
***

৩৭।
‘রেফ’-এর ঝামেলা

গতকাল রেফ-এর প্রয়োগের ওপর একপ্রস্থ আলোকপাত করেছি। আজ আর এক প্রস্থ। গোখলে মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল প্রাক্তন শিক্ষক সুদেষ্ণা মৈত্র সহজ পড়া-১, সহজ পড়া-২, বানান টানান, সহজ বাংলা ব্যাকারণ, রবীন্দ্রনাথ-নদী পথ পাখি প্রভৃতি বইয়ের লেখিকা।

‘বঙ্গদর্শন’-এ তিনি জানিয়েছেন (৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৭), ‘রেফ’ যে কার মাথার উপর কখন বসবে, সেটাও ছোটদের কাছে বেশ মুশকিলের বিষয়! দুর্গা , দূর্বা লিখতে গেলে রেফ দিতে হয়। রেফ কি, কেন, এত সব জটিলতায় না গিয়ে ছোটদের বলা যেতে পারে দুর্গা উচ্চারণে যেখানে ‘র’ এর উচ্চারণ হয় ঠিক তার পরের বর্ণের উপর ‘রেফ’ বসবে। যেমন বর্ণ উচ্চারণ করছে ‘ব’এর পর ‘র’ উচ্চারণ হচ্ছে তাই ‘ণ’ এর উপর রেফ হবে। আশীর্বাদ- এই শব্দটি উচ্চারণে ‘আশী’-র পর ‘র’ শোনা যাচ্ছে তখন ’র’টি ‘রেফ’ হয়ে ‘ব’ এর মাথায় বসবে। দুর্গতি/দুর্বার/দুর্বল উচ্চারণে দুর্ যেই উচ্চারণ হল তখনই তারপরের বর্ণে মাথায় রেফ বসবে।

এত কিছু করেও ছোটরা দুভির্ক্ষ লিখবে। বারবার অনুশীলন করালে মনের মধ্যে শব্দেরা ছবি এঁকে চলে ফিরে বেড়াবে, ফলে লেখার সময় বানান ভুল থেকে রেহাই পাওয়া সহজ হয়।
***

৩৮।
হ্রস্ব ই আর দীর্ঘ ই

‘ই ঈ বসে খায় ক্ষীর খই’— সহজ পাঠের সেই সুন্দর ছন্দ আমাদের সবার মনে গেঁথে আছে। হ্রস্ব ই আর দীর্ঘ ই নিয়ে আমাদের প্রায়ই বিভ্রান্তি হয়। ফেসবুকে ‘অক্ষর শুদ্ধ বানান ও ভাষা চর্চা’ গ্রুপের অ্যাডমিন স্বপন ভট্টাচার্যের ‘বানানের টিপস্‘ পেশ করছি আপনাদের কাছে।

‘বাড়ি/বাড়ী, পাখি/পাখী, কুমির/কুমীর’ শিরোনামে তিনি লিখেছেন, “অনেকেই প্রশ্ন করেন যে বাড়ী, পাখী এই সমস্ত শব্দের বানান হঠাৎ করে বাড়ি, পাখি এভাবে লেখা হচ্ছে কেন? এর উত্তরে বলা যায় যে এই পরিবর্তন হঠাৎ হয়নি। আমার যতদূর মনে হয় যে রবীন্দ্রনাথ‌ই বোধ হয় এই ধরনের বানান লেখা শুরু করেছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই বিশ্বভারতীর নির্দেশ‌ও ছিল তাই। তারপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বানান সংস্কার সমিতি নির্দেশ দেয় শব্দ অতৎসম হলে সেগুলো ই-কার বা ঈ-কার দুইভাবেই লেখা চলবে। অর্থাৎ বাড়ি অথবা বাড়ী যে কোনও একটা লিখলেই চলবে। কিন্তু বছর কুড়ি আগে পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি এবং প্রায় একই সময়ে ঢাকা বাংলা একাডেমি নির্দেশ দিয়েছে যে বানানের সমতা রক্ষা করতে গেলে অতৎসম শব্দে শুধু হ্রস্বস্বর অর্থাৎ ই-কার দেওয়াই ঠিক হবে। যদিও দু-একটি শব্দে, যেমন: কাহিনি, চিন ইত্যাদি, আকাদেমি আবার বিকল্পের সন্ধান দিয়ে রেখেছে। আবার চাবি অর্থে ‘কি’ লেখার সময় ‘কী’ লেখার পরামর্শ দিয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয় যে বিকল্পের সন্ধান দেওয়া মানেই বানানের সমতা রক্ষা না করার পরামর্শ। তাই বানানের সমতা যদি রক্ষা করতে বিকল্প বানান রাখা আদৌ যুক্তিসঙ্গত নয়।

সে যাই হোক, এখন প্রশ্ন কোনটা তৎসম শব্দ আর কোনটা নয় তা আমরা বুঝব কীভাবে? এটা কিন্তু খুবই সমস্যার। “রানি’ শব্দটা নিয়েই আলোচনা করা যাক। এই শব্দটা কেউ যদি লেখেন ‘রাণী’ তাহলে আমার মনে হবে যে এটা তৎসম শব্দ। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা তো নয়। ‘রাজ্ঞী’ তৎসম হলেও ‘রানি’ তৎসম শব্দ নয়। তার মানে আমাকে তৎসম শব্দ চিনতে লেখক বা কম্পোজিটার/প্রুফ রিডার এঁদের ওপর নির্ভরশীল হতে হবে।

অতৎসম শব্দে স্ত্রীবাচক ঈ ব্যবহার না করে সবগুলো‌ই ই-কার দিয়েই লিখতে হবে। যেমন: কাকি, খুড়ি, খান্ডারনি, চাকরানি, ঠাকুরানি, বামনি, মাসি, পিসি, মামি, সোহাগি ইত্যাদি।

জীবিকা, ভাষা, গোষ্ঠী, সম্প্রদায়, জাতি এই সব শব্দে শুধু ই-কার থাকবে। যেমন: ওকালতি, জমিদারি, মোক্তারি, ডাক্তারি, আরবি, ইংরেজি, হিন্দি, মালয়ালি, কাশ্মীরি, মারাঠি, আকালি, কংগ্রেসি, ইরানি, ওড়িশি, বাঙালি ইত্যাদি। এ ছাড়াও দেশি, বিদেশি, মরমি, মরসুমি, বন্দি, দরদি, মুলতুবি, রাজি, বাজি এগুলো‌ও ই-কার দিয়েই লিখতে হবে।

তবে মনে রাখতে হবে ‘ঈয়’ প্রত্যয় থাকলে কিন্তু ঈ-কার দেওয়া ছাড়া উপায় নেই। আর তাই আমরা লিখব ইরানীয়, অস্ট্রেলীয়, দেশীয়, এশীয়, ইউরোপীয় ইত্যাদি।“
***

৩৯।
উ ঊ

গতকাল হ্রস্ব ই দীর্ঘ ই নিয়ে চর্চা করেছি। সহজ পাঠ-এ ঠিক তার পরেই আমরা পড়েছিলাম ‘হ্রস্ব উ দীর্ঘ ঊ ডাক ছাড়ে ঘেউ ঘেউ’। উ ঊ-এর প্রয়োগ আমাদের অনেককে ভাবায়।

গোখলে মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল প্রাক্তন শিক্ষক সুদেষ্ণা মৈত্র সহজ পড়া-১, সহজ পড়া-২, বানান টানান, সহজ বাংলা ব্যাকারণ, রবীন্দ্রনাথ-নদী পথ পাখি প্রভৃতি বইয়ের লেখিকা। ‘বঙ্গদর্শন’-এ তিনি লিখেছেন (৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৭), “পুজো এসে গেল। মানে মা দুর্গা আসছেন।

চারিদিকে পুজো পুজো গন্ধ। মুশকিল হল একটাই, স্কুলের পরীক্ষায়ও এই দুর্গা পুজো নিয়ে লিখতে হতে পারে। হয় অনুচ্ছেদ, নয় চিঠি। এইখানেই তো সমস্যা। কখনও দুর্গা নিয়ে আবার কখনও বা দূ্র্বা নিয়ে। উ-কার আর ঊ-কার, এই দু’জন কোথায় যে কে কখন বসে, মাঝে মাঝেই তা গোলমাল হয়ে যায়। শুধু কী তাই?

দুর্গা নিয়ে সমস্যা বেশি তার কারণ, ‘দূর্গা’, এই ভুল বানানটা ছোটরা পথে ঘাটে বিজ্ঞাপনে, দোকানের সাইন বোর্ডে প্রায়ই দেখে। এই ভুল আটকাতে বা মনে রাখার সুবিধের জন্য, ছোটদের বলা যেতে পারে দুর্গা হলেন দেবী, যাঁকে মা হিসেবে অনেকে উপাসনা করে, আর মা তো আমাদের স্নেহ করেন, ভালোবাসেন তাই ‘দু’ উচ্চারণ কোমল ভাবেই করা হবে। আর লেখার সময়ও তাই ‘ দ্+উ=দু’ লেখা হবে।
আবার, দূর্বা, ঘাসের একটা অংশ। তাকে মাটি থেকে টেনে তুলতে হয়, জোর লাগে। তাই দ্+ ঊ= দূ হবে।( বাচ্চাকে শেখাতে এই ভাবে ছোট ছোট গল্প বললে ওদেরও মনে রাখাটা সহজ হয়)

মনে রাখার জন্য একই ভাবে ছোটদের বলা যেতে পারে, দুষ্টু, দুরন্ত, দুরবস্থা , দুর্গতি, দুর্গম, দুর্বার ইত্যাদির ক্ষেত্রে ‘দু’-এর উচ্চারণ আস্তে হয়।

আবার যখন দ্+ঊ= দূ  উচ্চারণ হবে, তখন জোর পড়বে ‘দূ’ তে। দূর বা দূরত্বের যে ‘দূ’ সেই ‘দূ’ একটু জোর দিয়ে উচ্চারণ করতে হবে। হ্রস্ব-উ এবং দীর্ঘ-ঊ-এর এমন দু’রকমের উচ্চারণ যদি ছোটরা রিডিং পড়ার সময় অভ্যাস করে, তাহলে এই ধরনের বানান ভুল কমে যেতে বাধ্য।
***

৪০।
দুরবস্থা/ দুরাচার

‘অক্ষর শুদ্ধ বানান ও ভাষাচর্চা’ গ্রুপে ‘বানানের টিপস্’-এ স্বপন ভট্টাচার্য ‘দুরবস্থা/ দুরাচার’ শিরোনামে লিখেছেন, “একবার একজন লোক বিদ্যাসাগর মশাইকে বলেছিলেন, ‘আমার খুবই “দুরাবস্থা” চলছে’‌। ‘ ‘সে তোমার ‘আ-কার’ দেখেই বুঝতে পারছি’, বিদ্যাসাগর উত্তরে বলেছিলেন।

‘দুরবস্থা’ শব্দে র-এ একটা আ-কার লাগিয়ে দেওয়াতেই তিনি ওই কথা বলেছিলেন। তাই আমরা লিখব দুঃ+ অবস্থা = দুরবস্থা, দুঃ+অতিক্রম = দুরতিক্রম কিন্তু দুঃ+আচার = দুরাচার, দুঃ+আত্মা = দুরাত্মা। আবার দুঃ+উক্তি = দুরুক্তি।

আর একটা কথা দুঃ উপসর্গ দিয়ে সব শব্দের বানান কিন্তু ‘দু’ অর্থাৎ দ-এ হ্রস্ব উ। আমরা অনেক সময়ই ‘দূর্বল’ লিখে ফেলি, এটা আমাদের দুর্বলতা।“
***

৪১।
বুদ্ধিজীবী, ই, ঈ

ই, ঈ নিয়ে আলোচনা করছি। এর বিস্তৃতি এতটাই কয়েক পর্যায় ধরে আলোচনা প্রয়োজন।

* পদের শেষে ‘-জীবী’ ঈ-কার হবে।
যেমন— চাকরিজীবী, পেশাজীবী, শ্রমজীবী, কর্মজীবী, ক্ষণজীবী, দীর্ঘজীবী, বুদ্ধিজীবী, কৃষিজীবী, আইনজীবী ইত্যাদি।

জীব, জীবিত, জীবিকা ব্যবহার।
যেমন— সজীব, রাজীব, নির্জীব, জীবিত, জীবিকা।

* পদের শেষে ‘-বলি’ (আবলি) ই-কার হবে।
যেমন— কার্যাবলি, শর্তাবলি, ব্যাখ্যাবলি, নিয়মাবলি, তথ্যাবলি ইত্যাদি।

* বিশেষণবাচক আলি প্রত্যয়যুক্ত শব্দে ই-কার হবে।
যেমন— সোনালি, রুপালি, বর্ণালি, হেঁয়ালি, খেয়ালি, মিতালি ইত্যাদি।

* অঞ্জলি দ্বারা গঠিত সকল শব্দে ই-কার হবে।
যেমন— অঞ্জলি, গীতাঞ্জলি, শ্রদ্ধাঞ্জলি ইত্যাদি।

* বিদেশি শব্দে ই-কার ব্যবহার হবে। যেমন— আইসক্রিম, স্টিমার, জানুয়ারি, ফ্রেরুয়ারি, ডিগ্রি, চিফ, শিট, শিপ, নমিনি, কিডনি, ফ্রি, ফি, ফিস, স্কিন, স্ক্রিন, স্কলারশিপ, পার্টনারশিপ, ফ্রেন্ডশিপ, স্টেশনারি, নোটারি, লটারি, সেক্রেটারি, টেরিটরি, ক্যাটাগরি, ট্রেজারি, ব্রিজ, প্রাইমারি, মার্কশিট, গ্রেডশিট ইত্যাদি।

* হীরা ও নীল অর্থে সকল বানানে ঈ-কার হবে।
যেমন— হীরা, হীরক, নীল, সুনীল, নীলক, নীলিমা ইত্যাদি।
***

৪২।
বোমাবাজি, ই, ঈ

ই, ঈ নিয়ে আলোচনা করছি। এর বিস্তৃতি এতটাই কয়েক পর্যায় ধরে আলোচনা প্রয়োজন।

* অ-তৎসম অর্থাৎ তদ্ভব, দেশি, বিদেশি, মিশ্র শব্দে ই-কার ব্যবহার হবে।
যেমন— বোমাবাজি, সরকারি, তরকারি, গাড়ি, বাড়ি, দাড়ি, শাড়ি, চুরি, চাকরি, মাস্টারি, মালি, পাগলামি, পাগলি, বোমাবাজি, দাবি, হাতি, বেশি, খুশি, হিজরি, আরবি, ফারসি, ফরাসি, ইংরেজি, জাপানি, জার্মানি, ইরানি, হিন্দি, সিন্ধি, ফিরিঙ্গি, সিঙ্গি, ছুরি, টুপি, দিঘি, কেরামতি, রেশমি, পশমি, পাখি, ফরিয়াদি, আসামি, বেআইনি, কুমির, নানি, দাদি, বিবি, চাচি, মাসি, পিসি, দিদি, বুড়ি, নিচু।

* ত্ব, তা, নী, ণী, সভা, পরিষদ, জগৎ, বিদ্যা, তত্ত্ব শব্দের শেষে যোগ হলে ই-কার হবে।
যেমন— দায়িত্ব (দায়ী), প্রতিদ্বন্দ্বিতা (প্রতিদ্বন্দ্বী), প্রার্থিতা (প্রার্থী), দুঃখিনী (দুঃখী), অধিকারিণী (অধিকারী), সহযোগিতা (সহযোগী), মন্ত্রিত্ব, মন্ত্রিসভা, মন্ত্রিপরিষদ (মন্ত্রী), প্রাণিবিদ্যা, প্রাণিতত্ত্ব, প্রাণিজগৎ, প্রাণিসম্পদ (প্রাণী) ইত্যাদি।
***

৪৩।
জাতীয়, ই, ঈ

ই, ঈ নিয়ে আলোচনা করছি। এর বিস্তৃতি এতটাই কয়েক পর্যায় ধরে আলোচনা প্রয়োজন।

*ঈ, ঈয়, অনীয় প্রত্যয় যোগ ঈ-কার হবে।
যেমন— জাতীয় (জাতি), দেশীয় (দেশি ), পানীয় (পানি), জলীয়, স্থানীয়, স্মরণীয়, বরণীয়, গোপনীয়, ভারতীয়, মাননীয়, বায়বীয়, প্রয়োজনীয়, পালনীয়, তুলনীয়, শোচনীয়, রাজকীয়, লক্ষণীয়, করণীয়।

* ভাষা ও জাতিতে ই-কার হবে। যেমন— বাঙালি/বাঙ্গালি, জাপানি, ইংরেজি, জার্মানি, ইরানি, হিন্দি, আরবি, ফারসি ইত্যাদি।

ব্যক্তির ‘-কারী’-তে (আরী) ঈ-কার হবে।
যেমন— সহকারী, আবেদনকারী, ছিনতাইকারী, পথচারী, কর্মচারী ইত্যাদি। ব্যক্তির ‘-কারী’ নয়, এমন শব্দে ই-কার হবে। যেমন— সরকারি, দরকারি ইত্যাদি।

প্রমিত বানানে শব্দের শেষে ঈ-কার থাকলে –গণ যোগে ই-কার হয়।
যেমন— সহকারী>সহকারিগণ, কর্মচারী>কর্মচারিগণ,
কর্মী>কর্মিগণ, আবেদনকারী>আবেদনকারিগণ
ইত্যাদি।

‘বেশি’ এবং ‘-বেশী’ ব্যবহার: ‘বহু’, ‘অনেক’ অর্থে ব্যবহার হবে ‘বেশি’। শব্দের শেষে
যেমন— ছদ্মবেশী, প্রতিবেশী অর্থে ‘-
বেশী’ ব্যবহার হবে।

অভিমানী, প্রতিদ্বন্দ্বী, প্রতিযোগী, মেধাবী, প্রতিরোধী একাকী, দোষী, বৈরী, মনীষী, সঙ্গী।

উন্নয়নশীল, দানশীল, উৎপাদনশীল, ক্ষমাশীল, নির্ভরশীল, দায়িত্বশীল, সুশীল, ধৈর্যশীল।
***

৪৪।
ভূত, কিন্তু ভুতুড়ে, উ ঊ

উ ঊ নিয়ে আগে আলোচনা করছি। এর বিস্তৃতিও এতটাই যে কয়েক পর্যায় ধরে আলোচনা প্রয়োজন।

১. দূরত্ব বোঝায় না এরূপ শব্দে উ-কার যোগে ‘দুর’ (‘দুর’ উপসর্গ) বা ‘দু+রেফ’ হবে।
যেমন— দুরবস্থা, দুরন্ত, দুরাকাঙ্ক্ষা, দুরারোগ্য, দুরূহ, দুর্গা, দুর্গতি, দুর্গ, দুর্দান্ত, দুর্নীতি, দুর্যোগ, দুর্ঘটনা, দুর্নাম, দুর্ভোগ, দুর্দিন, দুর্বল, দুর্জয় ইত্যাদি।

২. দূরত্ব বোঝায় এমন শব্দে ঊ-কার যোগে ‘দূর’ হবে। যেমন— দূর, দূরবর্তী, দূর-দূরান্ত, দূরীকরণ, অদূর, দূরত্ব, দূরবীক্ষণ ইত্যাদি।
২৪. অদ্ভুত, ভুতুড়ে বানানে উ-কার হবে। এ ছাড়া সকল ভূতে ঊ-কার হবে।
যেমন— ভূত, ভস্মীভূত, বহির্ভূত, ভূতপূর্ব ইত্যাদি।

* রেফের পর ব্যঞ্জনবর্ণের দ্বিত্ব হবে না৷
যেমন— অর্চনা, অর্জন, অর্থ, অর্ধ, কর্দম, কর্তন, কর্ম, কার্য, গর্জন, মূর্ছা, কার্তিক, বার্ধক্য, বার্তা, সূর্য৷
***

৪৫।
হয়তো, সে তো

হয়তো, নয়তো বাদে সকল তো আলাদা হবে। যেমন— আমি তো যাইনি, সে তো আসেনি, এই তো আমি চাই ইত্যাদি।
[দ্রষ্টব্য: মূল শব্দের শেষে আলাদা তো
ব্যবহারের ক্ষেত্রে এ বিধান প্রযোজ্য হবে।]

ইক প্রত্যয় যুক্ত হলে যদি শব্দের প্রথমে অ-কার থাকে তা পরিবর্তন হয়ে আ-কার হবে।
যেমন— অঙ্গ>আঙ্গিক, বর্ষ>বার্ষিক,
পরস্পর>পারস্পরিক, সংস্কৃত>সাংস্কৃতিক, অর্থ>আর্থিক, পরলোক>পারলৌকিক, প্রকৃত>প্রাকৃতিক, প্রসঙ্গ>প্রাসঙ্গিক, সংসার>সাংসারিক, সপ্তাহ>সাপ্তাহিক, সময়>সাময়িক, সংবাদ>সাংবাদিক, প্রদেশ>প্রাদেশিক, সম্প্রদায়>সাম্প্রদায়িক ইত্যাদি।
***

৪৬।
নির্জন, নীরব

ফেসবুকে অক্ষর, শুদ্ধ বানান ও ভাষাচর্চা গ্রুপে ‘বানানের টিপস্‘-এ স্বপন ভট্টাচার্য লিখেছেন, আমরা জানি যে ‘নিঃ’ একটা উপসর্গ। এই উপসর্গের শেষে একটা বিসর্গ আছে। আর তাই এর পরের শব্দটার গোড়ায় যে স্বর বা ব্যঞ্জনবর্ণ থাকে তার সঙ্গে মিলে একটা বিসর্গ সন্ধি তৈরি করে। এর ফলে ওই বিসর্গ কখনও র, রেফ্, আবার কখনও শ, ষ, বা স বর্ণে বদলে যায়। যেমন: নিঃ+অবয়ব = নিরবয়ব, নিঃ+অন্তর = নিরন্তর, নিঃ+আকার = নিরাকার, নিঃ+আশা = নিরাশা, নিঃ+উৎসাহ = নিরুৎসাহ, নিঃ+দোষ = নির্দোষ, নিঃ+ধন = নির্ধন, নিঃ+বোধ = নির্বোধ, নিঃ+নিমেষ = নির্নিমেষ, নিঃ+জন = নির্জন, নিঃ+বাক = নির্বাক, নিঃ+বান্ধব = নির্বান্ধব, নিঃ+তরঙ্গ = নিস্তরঙ্গ ইত্যাদি। আবার কখনও কখনও দেখা যাবে যে বিসর্গ যেমন ছিল তেমনি আছে। যেমন: নিঃ+সন্দেহ = নিঃসন্দেহ, নিঃ+সঙ্গ = নিঃসঙ্গ ইত্যাদি। তবে বিসর্গ বদলে যাই হোক না কেন দেখা যাবে যে সন্ধির ফলে যে শব্দটা তৈরি হল তার গোড়ায় ‘নি’ থেকেই যাচ্ছে।

কিন্তু এই ‘নিঃ’ উপসর্গের পরের শব্দের গোড়ায় যদি ‘র’ থাকে তাহলে কী হবে? তাহলে একটা মজার ব্যাপার ঘটে। ‘নিঃ’ উপসর্গের বিসর্গ তো লোপ পায়‌ই, ‘নি’-এর ই-কার বদলে ঈ-কার হয়ে যায়। যেমন: নিঃ+রব = নীরব, নিঃ+রস = নীরস, নিঃ+রোগ = নীরোগ, নিঃ+রন্ধ্র = নীরন্ধ্র, নিঃ+রক্ত = নীরক্ত ইত্যাদি। তাই আমরা খেয়াল রাখব যে ‘নিঃ’ উপসর্গের পর ‘র’ এলে আমরা লিখব ন-এ ‘ঈ-কার”।
***

৪৭।
‘স্ট’ এবং ‘ষ্ট’ ব্যবহার

বিদেশি শব্দে ‘স্ট’ ব্যবহার হবে। বিশেষ করে ইংরেজি st যোগে শব্দগুলোতে ‘স্ট’ ব্যবহার হবে। যেমন—পোস্ট, স্টার, স্টাফ, স্টেশন, বাসস্ট্যান্ড, স্ট্যাটাস, মাস্টার, ডাস্টার, পোস্টার, স্টুডিও, ফাস্ট, লাস্ট, বেস্ট ইত্যাদি।

ষত্ব-বিধান অনুযায়ী বাংলা বানানে ট-বর্গীয় বর্ণে ‘ষ্ট’ ব্যবহার হবে। যেমন— বৃষ্টি, কৃষ্টি, সৃষ্টি, দৃষ্টি, মিষ্টি, নষ্ট, কষ্ট, তুষ্ট, সন্তুষ্ট ইত্যাদি।

* ‘পূর্ণ’ এবং ‘পুন’ (পুনঃ/পুন+রেফ/
পুনরায়) ব্যবহার ‘পূর্ণ’ (ইংরেজিতে Full/Complete অর্থে) শব্দটিতে ঊ-কার এবং র্ণ যোগে ব্যবহার হবে।
যেমন— পূর্ণরূপ, পূর্ণমান, সম্পূর্ণ, পরিপূর্ণ ইত্যাদি।

‘পুন’ (পুনঃ/পুন+রেফ/পুনরায়— ইংরেজিতে Re-অর্থে) শব্দটিতে উ-কার হবে এবং অন্য শব্দটির সাথে যুক্ত হয়ে ব্যবহার হবে।
যেমন— পুনঃপ্রকাশ, পুনঃপরীক্ষা, পুনঃপ্রবেশ, পুনঃপ্রতিষ্ঠা, পুনঃপুন, পুনর্জীবিত, পুনর্নিয়োগ, পুনর্নির্মাণ, পুনর্মিলন, পুনর্লাভ, পুনর্মুদ্রিত, পুনরুদ্ধার, পুনর্বিচার, পুনর্বিবেচনা, পুনর্গঠন, পুনর্বাসন ইত্যাদি।

* পদের শেষে’-গ্রস্থ’ নয় ‘-গ্রস্ত’ হবে।
যেমন— বাধাগ্রস্ত, ক্ষতিগ্রস্ত, হতাশাগ্রস্ত, বিপদগ্রস্ত ইত্যাদি।

* বিদেশি শব্দে ণ, ছ, ষ ব্যবহার হবে না।
যেমন— হর্ন, কর্নার, সমিল (করাতকল), স্টার, আস্সালামু আলাইকুম, ইনসান, বাসস্ট্যান্ড ইত্যাদি।

ইংরেজি বর্ণ S-এর বাংলা প্রতিবর্ণ হবে ‘স’ এবং sh, -sion, -tion শব্দগুচ্ছে ‘শ’ হবে।
যেমন— সিট (Seat/Sit), শিট, (Sheet), রেজিস্ট্রেশন (Registration), মিশন (Mission) ইত্যাদি।
***

বাংলা চর্চা ৪৮।
সসেমিরা

ফেসবুকে অক্ষর ‘শুদ্ধ বানান ও ভাষা চর্চা’ গ্রুপে ‘শব্দের উৎস সন্ধানে’ ‘বিশেষজ্ঞ’ তকমাপ্রাপ্ত স্বপন ভট্টাচার্য লিখেছেন, “সসেমিরা মানে কী? অভিধান খুললে পাওয়া যাবে কিংকর্তব্যবিমূঢ় বা হতবুদ্ধি অবস্থা। কিন্তু এই শব্দটির প্রকৃত অর্থ কি তাই? তার আগে বুঝে নিতে হবে যে এটা কি আদৌ কোনও শব্দ?

আসলে ‘সসেমিরা’ শব্দকে একটি শব্দসংক্ষেপ বলা চলে। যেমন, ইংরেজিতে কিলোগ্রাম না লিখে লেখা যায় kg. কিলোর k আর গ্রামের g। অথবা আর এক ধরনের সংক্ষেপণ হয় – feet না লিখে লেখা হল ft.। তবে ‘সসেমিরা’ কিন্তু সম্পূর্ণ অন্য এক ধরনের সংক্ষেপ। এখানে চারটে শ্লোকের প্রথম অক্ষর দিয়ে তৈরি হয়েছে এই শব্দ।

কী সেই শ্লোক তা বিস্তারিত বলার আগে ওই শ্লোকগুলির উৎস সম্পর্কে কিছু বলা যাক। মহাকবি কালিদাসের ‘দ্বাত্রিংশৎ পুত্তলিকা’য় আছে যে রাজা নন্দর ছেলে জয়পাল একবার গভীর জঙ্গলে গিয়ে বাঘের মুখে পড়ে যায়। প্রাণ বাঁচাতে অন্য কোনও উপায় না দেখে সে একটা গাছে আশ্রয় নিয়ে দেখে যে সেখানে এক বিশাল ভালুক বসে আছে। জয়পাল অত্যন্ত ভয় পেয়ে যায়। তখন ভালুকটি তাকে বলে যে তোমার কোনও ভয় নেই। তুমি আমার শরণাগত, তাই তোমাকে রক্ষা করার দায়িত্ব আমার। ক্লান্ত অবসন্ন রাজপুত্র জয়পাল বলে যে তার ঘুমের অত্যন্ত প্রয়োজন। ভালুকটি তাকে বলে যে এই গাছের উপর তুমি ঘুমিয়ে পড়লে নিচে পড়ে যেতে পার। তুমি বরং আমার কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়। জয়পালের আর কোনও উপায় ছিল না। নিচে বাঘটি তখনও দাঁড়িয়ে আছে। সে ভালুকটির কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ল। জয়পাল ঘুমিয়ে পড়লে বাঘ ভালুককে বলল, ‘তুমি ওকে ঠেলে ফেলে দাও। আমি ওকে খেয়ে এখান থেকে চলে যাব।’ ভালুকটি এই প্রস্তাবে রাজি হয় না। বলে যে রাজপুত্র আমার শরণাগত, তাই তাকে রক্ষা করা আমার কর্তব্য। এই কর্তব্য থেকে বিচ্যুত হয়ে আমি মহাপাতক হতে চাই না।

কিছুক্ষণ পর জয়পালের ঘুম ভাঙলে ভালুক বলে এবার তুমি বসে পাহারা দাও। আমি একটু ঘুমিয়ে নিই। ভালুক ঘুমিয়ে পড়লে বাঘ জয়পালকে বলল যে তুমি যদি ভালুকটাকে ঠেলে গাছ থেকে ফেলে দাও তাহলে আমি ভালুকটাকে খেয়ে এখান থেকে চলে যাব। জয়পাল বাঘের কথায় প্রভাবিত হয়ে ভালুকটিকে গাছ থেকে ঠেলে ফেলে দেবার চেষ্টা করে। কিন্তু ভালুক কোনও রকমে গাছের ডাল ধরে নিজেকে বাঁচিয়ে নেয়। জয়পালকে অভিশাপ দিয়ে সে বলে যে তুমি এখন থেকে ‘সসেমিরা’ ‘সসেমিরা’ বলতে বলতে পথে পথে ঘুরবে আর যখন তুমি ‘সসেমিরা’ শব্দের মানে বুঝতে পারবে তখনই হবে তোমার মুক্তি।

এবার সেই চারটে শ্লোকের কথা বলি। সেই সংস্কৃত চারটি শ্লোক বাংলা করলে দাঁড়ায়:
শ্লোক নং ১ – স- সদ্ভাবে সম্মিলিত সুহৃদ ব্যক্তিকে বঞ্চনা করে কী নৈপুণ্য প্রকাশ হয়েছে? যার কোলে বসে তুমি গভীর নিদ্রায় মগ্ন তাকে বধ করলে কি পৌরুষলাভ হতে পারে?

শ্লোক নং ২ – সে – সেতুবন্ধ রামেশ্বর ও গঙ্গাসাগর সঙ্গমে গেলে ব্রহ্মহত্যার পাপও দূর হয়, কিন্তু বন্ধুদ্রোহী ব্যক্তি কোথাও মুক্তি লাভ করতে পারে না।

শ্লোক নং ৩ – মি – মিত্রদ্রোহী, কৃতঘ্ন ও বিশ্বাসঘাতক এই তিনজন প্রলয়কাল পর্যন্ত নরক বাস করে।

শ্লোক নং ৪ – রা – রাজন! আপনি যদি নিজের ছেলের কল্যাণ কামনা করেন, তবে দ্বিজগণকে দান ও দেবতাদের আরাধনা করুন।

এরপর কীভাবে জয়পালের শাপমুক্তি হয়েছিল সেই বর্ণনা বিস্তারিত আছে। তবে শব্দের উৎসের সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক না থাকায় সেগুলো আর এখানে বলছি না।
***

৪৯।
সমাসবদ্ধ পদ ও বহুবচন রূপী শব্দ

সমাসবদ্ধ পদ ও বহুবচন রূপী শব্দের মাঝে ফাঁক রাখা যাবে না।

যেমন— চিঠিপত্র, আবেদনপত্র, ছাড়পত্র (পত্র), বিপদগ্রস্ত, হতাশাগ্রস্ত (গ্রস্ত), গ্রামগুলি/গ্রামগুলো (গুলি/গুলো), রচনামূলক (মূলক), সেবাসমূহ (সমূহ), যত্নসহ, পরিমাপসহ (সহ), ত্রুটিজনিত, (জনিত), আশঙ্কাজনক, বিপজ্জনক (জনক), অনুগ্রহপূর্বক, উল্লেখপূর্বক (পূর্বক), প্রতিষ্ঠানভুক্ত, এমপিওভুক্ত, এমপিওভুক্তি (ভুক্ত/ভুক্তি), গ্রামভিত্তিক, এলাকাভিত্তিক, রোলভিত্তিক (ভিত্তিক), অন্তর্ভুক্তকরণ (করণ), আমদানিকারক, রফতানিকারক (কারক), কষ্টদায়ক, আরামদায়ক (দায়ক), স্ত্রীবাচক (বাচক), দেশবাসী, গ্রামবাসী, এলাকাবাসী (বাসী), সুন্দরভাবে, ভালোভাবে (ভাবে), চাকরিজীবী, শ্রমজীবী (জীবী), সদস্যগণ (গণ), সহকারী, আবেদনকারী, ছিনতাইকারী (কারী), সন্ধ্যাকালীন, শীতকালীন (কালীন), জ্ঞানহীন (হীন), দিনব্যাপী, মাসব্যাপী, বছরব্যাপী (ব্যাপী) ইত্যাদি। এ ছাড়া যথাবিহিত, যথাসময়, যথাযথ, যথাক্রমে, পুনঃপুন, পুনঃপ্রকাশ, পুনঃপরীক্ষা, পুনঃপ্রবেশ, পুনঃপ্রতিষ্ঠা, বহিঃপ্রকাশ শব্দগুলো একত্রে ব্যবহার হয়।
***

৫০।
মন্ত্রী কিন্তু মন্ত্রিত্ব? তবে কি মন্ত্রিসভা, মন্ত্রিপরিষদ?

ত্ব, তা, নী, ণী, সভা, পরিষদ, জগৎ, বিদ্যা, তত্ত্ব ইত্যাদি যদি অন্য শব্দের শেষে যোগ হয়, তা হলে কি আগের পদের ঈ-কার সব ক্ষেত্রেই ই-কার হবে?

ত্ব, তা, ণী, নী – এগুলো আলাদা কোনো শব্দ নয়। এদের আলাদা কোনো অর্থ নেই। এগুলো প্রত্যয়। একটি শব্দের সঙ্গে যুক্ত হয়ে অন্য শব্দ সৃষ্টি করে। এবং যখন যুক্ত হয় তখন প্রথম পদের ঈ-কার সংযুক্ত শব্দে ই-কার হয়।

তাই মন্ত্রী, কিন্তু মন্ত্রিত্ব; স্থায়ী, কিন্তু স্থায়িত্ব। তেমনই দায়িত্ব (দায়ী), প্রতিদ্বন্দ্বিতা (প্রতিদ্বন্দ্বী), প্রার্থিতা (প্রার্থী), দুঃখিনী (দুঃখী), অধিকারিণী (অধিকারী), সহযোগিতা (সহযোগী) ইত্যাদি।

এই প্রসঙ্গে আনন্দবাজার পত্রিকার প্রাক্তন উপ বার্তা সম্পাদক শম্ভু সেনের মন্তব্য, ”সভা, পরিষদ, জগৎ, বিদ্যা, তত্ত্ব ইত্যাদি এক একটি অর্থযুক্ত শব্দ। এই শব্দ যখন অন্য শব্দের সঙ্গে যুক্ত হয় আগের পদের ঈ-কারে কোনো পরিবর্তন হয় না। সুতরাং মন্ত্রিসভা নয়, মন্ত্রীসভা; তেমনই মন্ত্রীপরিষদ, মন্ত্রীমণ্ডলী, প্রাণীবিদ্যা, প্রাণীতত্ত্ব, প্রাণীজগৎ, প্রাণীসম্পদ ইত্যাদি।
তবে যে হেতু মন্ত্রিসভা, মন্ত্রিপরিষদ, মন্ত্রিমণ্ডলী ইত্যাদি শব্দ বহুল প্রচলিত তাই বাংলা আকাদেমি তাদের বানানবিধিতে দু’ রকম বানানই রেখে দিয়েছে।”
***

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *