চড়ক পূজা পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লোকউৎসব

স্নেহাশীষ মুখার্জি, আমাদের ভারত, নদিয়া, ১৪ এপ্রিল: চড়ক পূজা পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লোকৎসব। চৈত্রের শেষ দিনে এই পূজার আরম্ভ হয়, চলে বৈশাখের প্রথম দু-তিন দিন ব্যাপী। এই পূজা উপলক্ষ্যে নদীয়া জেলার নানা প্রান্তের মানুষ মেতে ওঠেন। এই চড়ক পূজো উপলক্ষ্যে নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগরের শক্তিনগর ময়দানে মেলা বসে, আবার জেলার সীমান্ত এলাকাবর্তী গ্রামগুলিতে এই পুজোকে কেন্দ্র করে ভালোই ধুম পড়ে যায়। চাপড়া, নবদ্বীপ, তেহট্ট করিমপুর পলাশী, বেথুয়া, প্রভৃতি অঞ্চলগুলি এই চরক উৎসবে মেতে ওঠে।

হিন্দু ভাবাবেগে এই চরক পূজা এলো কিভাবে? জানাবযায়, লিঙ্গ পুরাণ, বৃহদ্ধর্ম পুরাণ এবং ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে চৈত্র মাসে শিবআরাধনা প্রসঙ্গে নৃত্যগীতাদি উৎসবের উল্লেখ থাকলেও চড়ক পূজার উল্লেখ নেই। পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতাব্দীতে রচিত গোবিন্দ দাসের বর্ষক্রিয়াকৌমুদীতেও এই পূজার উল্লেখ নেই। তবে পাশুপত সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রাচীন কাল থেকেই এই উৎসব প্রচলিত ছিল। কিন্তু উচ্চ স্তরের লোকেদের মধ্যে এই পূজার প্রচলন খুব প্রাচীন নয়। জনশ্রুতি আছে ১৪৮৫ খ্রিষ্টাব্দে সুন্দরানন্দ ঠাকুর নামে এক রাজা এই পূজা প্রথম শুরু করেন। তার পর থেকেই এই পূজার প্রচলিত হয়ে যায় গ্রামবাংলার মানুষের সংস্কৃতিতে।

শক্তিনগর চড়ক পূজা কমেটির এক প্রবীণ দেবদত্ত সাহা বলেন, হিন্দু ধর্মের প্রাচীন রীতি এই পূজার অপর নাম নীল পূজা। যা চৈত্র মাসের শেষ অবধি পালন হয়। আগের দিন চড়ক গাছটি ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করা হয়। তারপর এক জলভরা পাত্রে শিবের প্রতীক শিবলিঙ্গ রাখা হয়, যা পূজারিদের কাছে “বুড়োশিব” নামে পরিচিত”।
এই পুজোর দায়িত্ব পালন করেন পতিত ব্রাহ্মণ। আবার এই পূজার বিশেষ অঙ্গ হল কুমিরের পূজা, জ্বলন্ত অঙ্গারের উপর দিয়ে হাঁটা, কাঁটা আর ছুঁড়ির ওপর দিয়ে লাফানো, বানফোড়া, শিবের বিয়ে, অগ্নিনৃত্য, চড়কগাছে দোলা এবং দানে বারানো বা হাজারা পূজা করা।

জেলার বিভিন্ন পূজা কমেটির উদ্যোক্তারা কয়েকজনের একটি দল নিয়ে সারা গ্রাম ঘুরে বেড়ায়। দলে থাকে একজন শিব ও দু’জন সখী। একজনকে সাজানো হয় লম্বা লেজ দিয়ে তার মাথায় থাকে উজ্জ্বল লাল রঙের ফল। সখীদের পায়ে থাকে ঘুঙুর। তাদের সঙ্গে থাকে ঢোল-কাঁসর সহ বাদক দল। সখীরা গান ও বাজনার তালে তালে নাচে। এদেরকে নীল পাগলের দল বলে ডাকা হয়। এরা বাড়ি বাড়ি ঘুরে গাজনের গান গায় এবং নাচ-গান পরিবেশন করে। বিনিময়ে দান হিসেবে যা কিছু পাওয়া যায় তা দিয়ে এই চরকের পূজা হয়। এই উৎসবকে কেন্দ্র করে জেলার বিভিন্ন স্থানে মেলা বসে যা “চড়ক সংক্রান্তির মেলা” নামেও পরিচিত।

জেলার এক বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ তন্ময় বসু জানান, “এই সব পূজার মূলে রয়েছে ভূতপ্রেত ও পুনর্জন্মবাদের ওপর বিশ্বাস। এর বিভিন্ন অনুষ্ঠান প্রাচীন কৌমসমাজে প্রচলিত নরবলির অনুরূপ। এই পূজার উৎসবে বহু প্রকার দৈহিক যন্ত্রণা ধর্মের অঙ্গ বলে বিবেচিত হয়।চড়কাগাছে ভক্ত বা সন্ন্যাসীকে লোহার হুড়কা দিয়ে চাকার সাথে বেঁধে দ্রুত গতিতে ঘোরানো হয়। তার পিঠে, হাতে, পায়ে জিহ্বায় এবং শরীরের অনান্য অঙ্গে বাণ সলাকা বিদ্ধ করা হয়। কখনো কখনো জ্বলন্ত লোহার শলাকা তার গায়ে ফুঁড়ে দেয়া হয়। ১৮৬৫ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার আইন করে এ নিয়ম বন্ধ করলেও দেশ স্বাধীন হয়ে যাওয়ার পরেও আজও গ্রামের সাধারণ মানুষের মধ্যে এই প্রথা চলে আসছে”।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *