বিশেষ সংবাদদাতা, আমাদের ভারত, ১১ মে: পশ্চিমবঙ্গে এখন প্রায় এক লক্ষ নয় হাজার তিনশোর অধিক এনএসএস স্বেচ্ছাসেবী ২৪ ঘন্টা সমাজসেবা ও সমাজকল্যাণের কাজে ব্রতী আছে। এনএসএস (ন্যাশনাল সার্ভিস স্কিম)এর স্টেট কো-অর্ডিনেটর ডক্টর রমাপ্রসাদ ভট্টাচার্য দ্য ওয়েস্ট বেঙ্গল ইউনিভার্সিটি অফ টিচার্স ট্রেনিং এডুকেশন প্ল্যানিং এন্ড অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে (ডব্লুবিইউটিটিইপিএ) ‘বিবেক সংহতি উৎসব ২০২২’-এ এ কথা জানান।
সোমবার অনুষ্ঠানে স্বাগত ভাষণে তিনি বলেন এনএসএস এর মূলমন্ত্র হলো “নট মি, বাট ইউ”। ২০১৫ সালে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার এনএসএস এর গুরুত্ব অনুধাবন করে এবং বিবেকানন্দের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে এই বিবেক সংহতি দিবসের অনুষ্ঠান শুরু করেন।
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের উচ্চ শিক্ষা দপ্তরের অধীনস্থ এন এস এস সেল ও বিএড বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ আয়োজনে হয় এই অনুষ্ঠান। জাতীয় সংহতি উদযাপনের লক্ষ্যে প্রতি বছর জানুয়ারি মাসের ১২ তারিখে বিবেকানন্দের জন্মদিনে এই অনুষ্ঠান হয়। এবছর করোনার তৃতীয় ঢেউয়ের কারণে জানুয়ারি মাসে এই অনুষ্ঠান আয়োজন করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। পরবর্তীকালে পরিস্থিতির সামান্য উন্নতি হলে রাজ্য সরকারের অনুমতিক্রমে এ বছরেই অনুষ্ঠান আয়োজনের দায়িত্ব পায় বিএড বিশ্ববিদ্যালয়ের নবগঠিত এনএসএস ইউনিট।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিনে আর এক মহান মানুষ বিবেকানন্দের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে যুব শক্তির আরাধনায় ব্রতী হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের আধিকারিক, শিক্ষক-শিক্ষিকা, ছাত্র-ছাত্রী ও অন্যান্যরা। পশ্চিমবঙ্গের প্রায় ১৫ টি বিশ্ববিদ্যালয় এবং তাদের অধীনস্থ কলেজগুলি থেকে সাড়ে তিনশোর উপরে জাতীয় সেবা প্রকল্পের স্বেচ্ছাসেবকেরা আজকের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে।
অনুষ্ঠানের শুরুতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনের সেক্রেটারি স্বামী সর্বলোকানন্দজী মহারাজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপিকা সোমা বন্দ্যোপাধ্যায়, এনএসএস এর পূর্বাঞ্চলীয় অধিকর্তা শ্রী বিবেক কুমার, রাজ্যস্তরের উপদেষ্টা অধ্যাপক এ এন দে, অধ্যাপক শিবরঞ্জন চট্টোপাধ্যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিবন্ধক কুনাল কান্তি ঝা, ঝাড়গ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক অমিয় পান্ডা, পঞ্চানন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক দেবকুমার মুখার্জি এবং অন্যান্যরা। বিভিন্ন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আগত এন এস এস এর প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর এবং শিক্ষক-শিক্ষিকারাও ছিলেন।
বিএড বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা অনুষ্ঠানে উদ্বোধনী সংগীত পরিবেশন করেন। এর পরে শ্রীরামপুর গার্লস কলেজ এর এনএসএস ভলেন্টিয়াররা এনএসএস এর থিম সং পরিবেশন করে অনুষ্ঠানের শুভারম্ভের সুর বেঁধে দেয়। সেই সুরে তাল মিলিয়ে উপস্থিত বিশিষ্টজনেরা মঙ্গল প্রদীপ প্রজ্জ্বলন করে অনুষ্ঠানের শুভ সূচনা করেন।
উপাচার্য সোমা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর প্রারম্ভিক ভাষণে পশ্চিমবঙ্গ সরকার, মাননীয় শিক্ষা মন্ত্রী, মাননীয় শিক্ষা সচিবসহ উপস্থিত সমস্ত ব্যক্তিদের যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শন করে বিবেকানন্দ ও রবীন্দ্রনাথের বাণী উদ্ধৃত করে যুবশক্তি যে সমাজ গঠনের মূল কারিগর তা উল্লেখ করেন। ভবিষ্যৎ ভারত যুবশক্তির কর্মকাণ্ডের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠবে সে কথাও তাঁর বক্তব্যে উঠে আসে। তিনি বলেন যে বর্তমান পৃথিবীতে যুবশক্তি সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। তাঁর কথায় সততা, পবিত্রতা, আত্মবিশ্বাস, সাহস ও দেশপ্রেম মানুষের প্রতি ভালোবাসার মাধ্যমে আজকের যুবক-যুবতীরা মানুষের প্রতি তাদের দায়িত্ব পালন করতে পারবে।
এনএসএস এর আঞ্চলিক অধিকর্তা বিবেক কুমার তার ভাষণে উল্লেখ করেন এনএসএস এর থিম সং এর মধ্যেই যে গুরুত্বপূর্ণ কথাগুলি বলা আছে তা হল ধৈর্য, বিবেক, শ্রম এবং উৎসাহ। তিনি বলেন স্বামীজীর মহাপ্রয়াণের এত বছর পরেও আজকের সমাজে স্বামীজীর প্রসঙ্গিকতা একবিন্দুও কমেনি বরং তা ক্রমশ ঊর্ধ্বগামী।
বিবেক কুমার তাঁর বক্তব্যে উল্লেখ করেছেন যে এই মুহূর্তে ভারতবর্ষে ৮০ লাখের বেশি স্বেচ্ছাসেবী এনএসএস এর অন্তর্ভুক্ত হয়ে সমাজকল্যাণ ও সমাজ সেবার কাজে ব্রতী হয়ে আছে। পৃথিবীর সব থেকে বড় যুব জনসংখ্যার দেশ ভারত। এবং এত সংঘটিত যুবশক্তি পৃথিবীর আর কোনও দেশে নেই।
মূল্যবান বক্তব্য আসে আজকের প্রধান অতিথি স্বামী সর্বলোকানন্দজী মহারাজের কাছ থেকে। তিনি ভারতে বৈচিত্রতা, বিভিন্নতা, বহু ভাষা, বহু সংস্কৃতির উল্লেখ করে আজকের দিনে বিচ্ছিন্নতাবাদের জাগ্রত সমস্যার কথা তুলে ধরেন। সেই সাথে সাথেই ভারত যে বহুত্ববাদের দেশ তাও উল্লেখ করেন। “বিবিধের মাঝে দেখ মিলন মহান” তাঁর কথায় বারবার ফিরে আসে। তিনি আরও বলেন যে আধুনিক সমাজ বস্তুবাদী সভ্যতা বা ভোগবাদী সভ্যতায় বিশ্বাস করে চলেছে। কিন্তু এই বস্তুবাদী সভ্যতা বা ভোগবাদ মানুষের মনে পরম শান্তি কখনো আনতে পারেনা। এক্ষেত্রে রাজা যযাতির উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন ভোগের মাধ্যমে কখনোই ভোগের মৃত্যু ঘটানো যায় না।
স্বামী রঙ্গনাথনজী মহারাজের আধ্যাত্মিকতার ব্যাখ্যা উল্লেখ করে বলেন “যদি তুমি অপরকে ভালবাসতে পারো, যদি তুমি অপরের সঙ্গে একাত্ম হতে পারো, যদি তুমি তোমার মনের শান্তি খুঁজে পাও তবে তুমি আধ্যাত্মিকতার দিকে এগিয়ে চলেছ। শুধু গেরুয়া বসন পরিধান করলেই বা মন্দিরে গেলেই আধ্যাত্মিকতার ছোঁয়া পাওয়া যায় না। তাঁর কথায় আধ্যাত্মিকতাই মুক্তির একমাত্র পথ। তাই আজকের যুব সমাজের আধ্যাত্মিকতার পথ বেছে নিয়ে প্রথমে মানুষকে ভালোবাসতে শিখতে হবে এবং তারপর মানুষকে সাহায্য করতে হবে। স্বামী বিবেকানন্দ বিশ্বাস করতেন ভালোবাসা দিয়ে সবকিছু জয় করা যায়। আজকের যুব সমাজের কাছে স্বামীজি জাতীয় সংহতির আইকন।
অধ্যাপক অতীন্দ্রনাথ দে তার বক্তব্যে উল্লেখ করেছেন কিভাবে তাদের নিরলস প্রচেষ্টা এবং আন্দোলন আমাদের পশ্চিমবঙ্গে এন এস এস এর ভূমিকাকে আরও উজ্জ্বল করেছে, কিভাবে বিগত সরকার এবং বর্তমান সরকারের উৎসাহে এন এস এস এর পশ্চিমবঙ্গের ইউনিটগুলি ভারতবর্ষের বাকি রাজ্যের ইউনিটগুলির সঙ্গে সমতা রেখে চলার পথে এগিয়ে গেছে। তিনি ভবিষ্যতে আরও বড় করে বিবেক সংহতি উৎসব পালন করার জন্য রাজ্য সরকারকে অনুরোধ করেন।
প্রারম্ভিক অনুষ্ঠানের পরে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ এবং স্কুল থেকে আসা এনএসএস এর ভলান্টিয়াররা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি প্রেক্ষাগৃহে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশন করেন। নাচ, গান, আবৃত্তি, গীতি আলেখ্য, বক্তব্য, অংকন বিভিন্ন শিল্প কলার মাধ্যমে বারবার উঠে আসে স্বামী বিবেকানন্দ এবং রবীন্দ্রনাথের কথা। স্বামী বিবেকানন্দ ও রবীন্দ্রনাথের মাধ্যমে সমস্ত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করেছে জাতীয় সংহতি চর্চার ধারা।
আগত বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মধ্যে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়, ডায়মন্ডহারবার উওমেন ইউনিভার্সিটি, বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন কলেজ, স্কুল এবং আরো অনেক বিশ্ববিদ্যালয় এবং তার অধীনস্থ কলেজের জাতীয় সেবা প্রকল্পের স্বেচ্ছাসেবীরা অনুষ্ঠানে অংশ নেন। উপস্থিত ছিলেন প্রায় সমস্ত শাখার প্রোগ্রাম অফিসাররা। দ্য ওয়েস্ট বেঙ্গল ইউনিভার্সিটি অফ টিচার্স ট্রেনিং এডুকেশন প্ল্যানিং এন্ড অ্যাডমিনিস্ট্রেশন এর এনএসএস ইউনিট এবং অন্যান্য ছাত্র-ছাত্রীদের সহযোগে “বিবিধের মাঝে দেখ মিলন মহান” শীর্ষক গীতি আলেখ্য পরিবেশনের মাধ্যমে সারাদিন জুড়ে জাতীয় সংহতির যে কাঠামো তৈরি হয়েছিল তার ওপরে রংতুলির শেষ প্রলেপ পূর্ণতা পায়।
অনুষ্ঠানের শেষ বেলায় শুধু ছাত্র-ছাত্রীদের বা অংশগ্রহণকারীদের মানপত্র প্রদানের মধ্যেই আনুষ্ঠানিকতা সীমাবদ্ধ থাকেনি। সমস্ত ইউনিট থেকে আগত প্রোগ্রাম অফিসারদের মঞ্চে সম্বর্ধনা প্রদানের করে বি এড বিশ্ববিদ্যালয় এ বছরে যে নতুন সংস্কৃতির আমদানী করলো তা হয়তো পরবর্তী বছরের বিবেক সংহতি উৎসবের আয়োজকদের অনুসরণ করতে হবে।
অনুষ্ঠানের একদম শেষ বেলায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে আগত স্বেচ্ছাসেবকরা, প্রোগ্রাম অফিসাররা এবং এন এস এস কো-অর্ডিনেটররা তাদের অভিজ্ঞতা প্রসঙ্গে বলেন যে বিগত কয়েক বছরে এত সুন্দর ব্যবস্থাপনায় বিবেক সংহতি উৎসব অনুষ্ঠিত হয়নি। সকাল থেকে সন্ধ্যা জাতীয় সংহতি পালনে এ অনুষ্ঠান যেভাবে একতারে বাধা ছিল তার প্রশংসা করেন সকলেই।
পরিশেষে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করতে এসে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন্যান্স অফিসার অভিজিৎ বিশ্বাস বলেন কিভাবে উপাচার্য সোমা বন্দ্যোপাধ্যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত আধিকারিক, এন এস এস কো-অর্ডিনেটর ডক্টর বিশ্বজিৎ বালা, অন্যান্য অধ্যাপক অধ্যাপিকা, শিক্ষা কর্মী এবং ছাত্র-ছাত্রীদের নিরলস প্রচেষ্টায় খুব স্বল্প সময়ের মধ্যে আজকের অনুষ্ঠানটি সাফল্যের সাথে করা গেল। সর্বোপরি তিনি রাজ্যের শিক্ষা দপ্তরের মন্ত্রী, সচিব ও এন এস এস আধিকারিকদের ধন্যবাদ জানান এই বিশ্ববিদ্যালয়কে এই অনুষ্ঠানের দায়িত্ব দেওয়ার জন্য।