“নির্মাণের সাথে রক্ষণাবেক্ষণ একটা গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ”, মত প্রাক্তন পুরকর্তার

অশোক সেনগুপ্ত, আমাদের ভারত, ২১ এপ্রিল: কলকাতার একাধিক উড়ালপুলের অবস্থা মাঝে মাঝেই উঠে আসছে সংবাদ শিরোনামে। এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট স্থপতি তথা কলকাতা পুরসভার প্রাক্তন ডিরেক্টর জেনারেল দীপঙ্কর সিংহর মন্তব্য, “যে আমলেই হোক, নির্মাণ ত্রুটি হলে উড়ালপুলের স্থায়িত্ব কম হবেই। তবে নির্মাণের সাথে রক্ষণাবেক্ষণ একটা গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। এতো উড়ালপুল ত্রুটিপূর্ণ হচ্ছে কেনো? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে।”

চিংড়িঘাটা উড়ালপুল ভেঙ্গে ফেলা হবে— এই খবরে প্রশ্ন উঠছে, প্রকল্পের নির্মাতাদের কি আরও সতর্ক হওয়া উচিত ছিল? এত আর্থিক ধাক্কা, পুনরায় কাজ করাকালীন বিপুল যানজট— এই ভোগান্তির দায় কার? এর উত্তরে দীপঙ্করবাবু শুক্রবার এই প্রতিবেদককে বলেন, “আমি সরেজমিনে মাঝেরহাট ফ্লাইওভার ও গিরিশ পার্ক ফ্লাইওভার কিছুটা দেখার চেষ্টা করেছিলাম। গিরিশ পার্ক উড়ালপুলে গুরুতর নির্মাণ ত্রুটি চিহ্নিত হয়েছিল। মাঝের হাট উড়ালপুলের বয়স হলেও ভেঙ্গে পড়তোনা, যদি রক্ষণাবেক্ষণ ঠিক হতো। মাঝেরহাট উড়ালপুলের ‘মিডস্প্যান ফেইলিওর’ হয়েছিল। ওর উপরে ওজন অতিরিক্ত চাপানো হয়েছিল শুধু নয়, পাটাতনের বৃদ্ধি ও সংকোচনের যে ফাঁক থাকে তাকে অপটু ঠিকাদার বু্ঁজিয়ে দিয়েছিলো। তাপ বৃদ্ধি ও কমের সাথে সেতুর পাটাতন যদি বাড়তে বা সংকুচিত হতে না পারে খুব ভালো ভাবে নির্মিত সেতুও ভেঙ্গে পড়তে পারে। সেতুর পাটাতনের একদিক অনড় রাখা হয় ও অপরদিক রোলারের উপর রাখা হয় সহজে বৃদ্ধি ও সংকোচনের খেলা করার জন্য।

উল্টোডাঙা উড়ালপুলে এই রোলার উল্টো করে লাগানো হওয়ায় লরির দ্রুত বাঁক নেওয়ার অভিকেন্দ্রিক বল সামাল দিতে পারেনি। তবে এ ছাড়াও ঐ সেতুর আরো ত্রুটি আছে।

সেতুর নির্মাণ ত্রুটি থাকলে সাধারণত অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তা ভেঙ্গে পড়ে, বা ভঙ্গুর হয়ে যায়। এর বিজ্ঞান সম্মত কারণ আছে। মাঝেরহাট উড়ালপুল ভেঙ্গে পড়ার পর বিদ্যাসাগর সেতু সমেত বহু সেতুর পাটাতনের বৃদ্ধি ও সংকোচনের জন্য রাখা ফাঁক রাতারাতি পরিস্কার করা হয়। ভারি ফুলের টব নামানো হয়। রাস্তা চেঁচে ভার কমানো হয়। আসলে এই ক্ষেত্রগুলোতেও ভয়ঙ্কর রক্ষণাবেক্ষণ ত্রুটি করা হয়েছিল। সময়ে পদক্ষেপ নিয়ে এড়িয়ে যাওয়া গিয়েছে।

চিংড়িহাটা উড়ালপুলের সমস্যা আমি জানিনা। আলটপকা একটা কারণ বলা আমার উচিত নয়। তবে এটা মনে রাখতে হবে যে চিংড়িঘাটা উড়ালপুলের একটি বিপদজ্জনক বাঁক রয়েছে। এমন বাঁক থাকলে নির্মাণ খুব সাবধানে করতে হয়। সাথে রক্ষণাবেক্ষণও খুব ঝুঁকি পূর্ণ থাকে। বাঁকের অভিকেন্দ্রিক বল সামাল দেওয়ার জন্য সেতুর বাইরের দিক উঁচু ও ভিতরের দিক নীচু করতে হয়। এর সাথে রোলার গুলির স্বাস্থ্য পরীক্ষা নিয়মিত করতে হয়। পাটাতনের ঢালাই ঠিক না হলে খুব ছোট অংশে ক্ষতি হয়। সেটা ঠিক করাও কঠিন হয়। মূল কাঠামো ঠিক না হলে পরে ঠিক করা যায় না। আর এতদিন টেকসই থাকার কথাই নয়।

আমার একটা সন্দেহ আছে মা ফ্লাইওভারের নির্মাণ নিয়ে। সেখানে বাঁকের মুখে এত গাড়ি উল্টে যাওয়ার কারণ অনুসন্ধানের প্রয়োজন আছে। এটা সম্প্রীতি উড়ালপুলের জন্যও প্রযোজ্য। অভিকেন্দ্রিক বল সামাল দেওয়ার জন্য পাটাতনের মেঝেতে গাড়ির সম্ভাব্য দ্রুতি বিচার করে যে ঢাল রাখা উচিত ছিল, তা কি রাখা হয়েছে? স্বীকার কেউ না করলেও গাড়ির গতি কমিয়ে দেওয়ার নির্দেশিকা থেকে এই ত্রুটি নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়।

আমি কদিন আগেই টরন্টোর অনেকগুলি উড়ালপুলের বাঁক ও অনুমোদিত দ্রুতি একটু খুঁটিয়ে দেখে চমকে গিয়েছি। ১২৫ কিলোমিটার বা তারও বেশি গতিতে নির্দ্বিধায় গাড়ি বাঁক নিয়ে ছুটে যাচ্ছে। কোনো গাড়ি টাল খাচ্ছে না। কোনো গতি নিয়ে ঊর্ধ্বসীমা বেঁধে দেওয়া নেই বললেই চলে। এগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিশেষজ্ঞরা আরো ভালো বলতে পারবেন, যদি নিরপেক্ষভাবে বলেন।”

প্রসঙ্গত, বৃহস্পতিবার পুরমন্ত্রী তথা কেএমডিএ চেয়ারম‌্যান ফিরহাদ হাকিম বলেন, “মাঝেমধ্যে মেরামত চলছে। কিন্তু এ ভাবে বেশিদিন চলবে না। ইঞ্জিনিয়াররা বলছেন, নকশায় গলদ তো বটেই। উড়ালপুলের করুণ অবস্থার জন‌্যে দায়ী মেট্রোর কাজও। সে কারণেই নতুন উড়ালপুল তৈরি করতে হবে।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *