প্যাঁচে মোড়া পশ্চিমবঙ্গের করোনা

ড. রাজলক্ষ্মী বসু
আমাদের ভারত, ৮ মে: যত দিন যাচ্ছে সংখ্যার মারপ্যাঁচ দেখে মাথা ঝিম ঝিম করছে। বারে বারে কেন এ রাজ্যের সংখ্যা নিয়েই এতো কাটাছেঁড়া করতে হচ্ছে? পশ্চিমবঙ্গে কোভিড পরীক্ষা বৃদ্ধি করা হয়েছে এটা নিশ্চিত। কিন্তু এবার জিজ্ঞাসা মোট জনসংখ্যা, রোগ লক্ষ্মণধারী এবং মোট আক্রান্তের সাথে যদি অঙ্কটা কষি তা মোটেই নিশ্চিত করবে না।

আমরা কেউ নিন্দুক নই। মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীরই প্রদর্শিত তথ্যের ভিত্তিতেই এ কলম। মাননীয়া নিজেই ট্যুইট করে বলেছেন যে গত একমাস ধরে বাড়ি বাড়ি ঘুরে স্বাস্থ্য পরীক্ষা/ পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে দুটি লক্ষণ যুক্ত রোগীর উল্লেখ করা হয়। SARI ( Severe Acute Respiratory Illness) এবং ILI ( Influenza like illness)। স্বয়ং তিনিই টেস্ট সংক্রান্ত বিষয়ে যখন পোষ্ট টি করেন তা অনেকাংশেই পিছিয়ে পড়া বা মন্থর গতির করোনা পরীক্ষা রাজ্যের মধ্যে এ রাজ্য ধরা দেয়।
গত ৭ এপ্রিল থেকে ৩ মে পথ্য করোনা পরিষেবা চিত্র মেলে ধরতেই তিনি ট্যুইট করেন, মোট পরিদর্শিত গৃহ সংখ্যা ৫৫৭৩৪৯৫৫, সর্বমোট ILI ছিল ৯১,৫১৫ টি। SARI যুক্ত ব্যক্তির সংখ্যা ৮৭২, লক্ষণ যুক্ত ব্যক্তি যারা চিকিৎসাধীন হয়েছেন তার সংখ্যা ৩৭৫ এবং করোনা পরীক্ষা হয়েছে ৬২ টি। একি সর্বনাশা তথ্য! এমন ট্যুইট কি করে চোখ এড়ায়? স্কুল পড়ুয়া অঙ্কের কাঁচা ছাত্রও টপাটপ অঙ্ক কষে বলে দেবে যে করোনা পরীক্ষা হয়েছে মাত্র ৭.১ % রোগীর। এ তথ্য কি সত্যিই অশনীসঙ্কেতবাহী নয়?

গত ৫ মে মহাশয়া আরো একটি ট্যুইট করেন। যা পুনরায় সংখ্যা জরিমানা আওতায় আসবে। গত চার সপ্তাহ ধরে বুঝি ৫.৫ কোটি বাড়িতে SARI এবং ILI এর স্ক্রিনিং হয়েছে। উদ্দেশ্য, কোভিড লক্ষণধারীদের চিহ্নিতকরণ। স্বাস্থ্যকর্মীরা নিঃসন্দেহে রাত দিন এক করে পরিবার মায়া ত্যাগ করে সেবায় ব্রতী। এই তথ্যও বিশ্বাস অবিশ্বাসের সীমারেখায় দন্ডায়মান। গত বারের সেনসাস অনুযায়ী এ রাজ্যে ২ কোটি গৃহ। যদি ৫.৫ কোটি গৃহের তথ্য গ্রহণ করি এবং গড়ে প্রতি বাড়িতে যদি কমপক্ষে চারজনও সদস্য থাকেন, তাহলেও পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যা দাঁড়াবে ২২ কোটি! কি মারাত্মক অঙ্ক বিভ্রাট। এ যে পশ্চিমবঙ্গের মূল জনসংখ্যার দ্বিগুণ।

এতো বাড়ি যেতে এবং সবার স্ক্রিনিং করতে কত স্বাস্থ্য কর্মী লাগে? এবং যে সংখ্যক স্বাস্থ্য কর্মী আছেন তা কি সত্যিই পর্যাপ্ত এই যুদ্ধ পরিস্থিতিতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে কড়া নাড়ার? রাজ্যে প্রতিদিনই কনটাইনমেন্ট জোন বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত ৬ মে, কেবলমাত্র কলকাতাতেই ৩১৮ থেকে বৃদ্ধি করে ৩৩৪ টি জোন করা হয়েছে। এটাও স্মরণে রাখতে হবে যত বেশি সংখ্যক কনটাইনমেন্ট জোন হবে তত বেশি বাড়ি বাড়ি যাওয়ার বিষয়টি থিওরিটেক্যালি বৃদ্ধি পাওয়া উচিৎ। কিন্তু এও লক্ষ্য করতে হবে কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক দল এ রাজ্যে টহল দিয়ে গেলে তবেই হঠাৎ করে কনটাইনমেন্ট জোন বাড়তে থাকে। তাই এই সংক্ষিপ্ত সময়েই এতো বাড়ি আর সদস্যদের স্বাস্থ্য স্ক্রিনিং কতটা প্রাক্টিক্যালি সম্ভব? সারা রাজ্যে ৬ মে পর্যন্ত মোট কনটাইনমেন্ট জোন ছিল ৫৫৫ টি। এ প্রসঙ্গে লক্ষ্য রাখতে হবে দার্জিলিংয়ে ২ টি এবং কালিংপঙে ১ টি জোন। কিন্তু উক্ত অঞ্চলের আশপাশে করোনা পরীক্ষার গন্তব্য বলতে শিলিগুড়ি। ওই অঞ্চলে করোনা পরীক্ষার রিপোর্ট বেশ বিলম্বে আসছে। স্যাম্পল যেতেই তো সময় ‘ব্যয়’ অনেকটা।

আরো একটা সদ্য ঘটে যাওয়া সংখ্যা গোলমাল উল্লেখ করি। ৪ঠা মে রাজ্য হেলথ বুলেটিনে জলপাইগুড়িতে টোটাল কেস ৫ দেখানো হয়, ঠিক তার পরের দিনই অর্থাৎ ৫ মে তা হয় ৪। খুব মনোযোগ দিয়ে সংখ্যা খেলা দেখলে বোঝা যাবে টাইপের সময় এটা হয়তো ক্রিস ক্রস হয়েছে। অর্থাৎ ৪ এর বদলে ৫ এবং উল্টো টাও। কিন্তু রেকর্ড অনুযায়ী এ হলো অদ্ভুতুরে সব ব্যাপার। সংখ্যা হয় বাড়বে বা এক থাকবে। কমে কোন যুক্তিতে । কিন্তু এবার আর কোনও যুক্তি ( গাজাখড়ি উত্তর) খাটবে না মুর্শিদাবাদের তথ্য দেখলে। ৪ ঠা টোটাল কেস ২ ছিল। পরের দিনই তা হয়ে গেল ১। এমন ভানুমতীর খেল জানলে তো সব সংখ্যা ০ তেও নেমে আসতে পারে। খুব সংক্ষেপে হিসেব দাঁড়াচ্ছে গত ৫ মে থেকে ৮ মে এর মধ্যেই এতোগুলো চোখে পড়া বড়সড় তথ্য বিভ্রাট? কি করে নিশ্চিত হবো আমরা?

কো মরবিডিটি তত্ত্ব এখন পুরোনো। সত্যিই বড্ড বস্তাপচা থিওরি। সে কি আর কেবল ডেঙ্গির সময়? না , এ থিওরিও বলা ভালো কৌশল ঋণমুক্ত না। ১৯৮৬ সালে জাপানে এনকেফেলাইটিস দেখা দেয়। এ রাজ্যে প্রকোপ আসে। তখন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু এবং প্রশান্ত শুর স্বাস্থ্য মন্ত্রী। সেদিনও মহাকরণ থেকে হাসপাতাল নির্দেশ পেয়েছিল, জাপানি এনকেফেলাইটিস মৃত্যু খবরদার বলা যাবে না। বলতে হবে মেনিনজাইটিস। সে খবরও এক বাংলা দৈনিক করলে ধমকে চমকে সব বন্ধ হয়। খুব মিল- সেদিনও হাসপাতালে সংবাদিক প্রবেশাধিকার খর্ব করা হয়। এ হল এ রাজ্যের ট্রাডিশন। এ রাজ্যের “পেয়ালা” ২০১১ তে একবার বদলেছে কিন্তু ” চামচা” ( বাংলা য় চামচ) একই রয়ে গেছে।
(তথ্য এবং মতামত লেখকের নিজস্ব)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *