অশোক সেনগুপ্ত
আমাদের ভারত, কলকাতা, ৯ জানুয়ারি: শেষ পর্যন্ত সাগরমেলা হচ্ছে। চলছে বিতর্ক। এই আবহেই সল্টলেকের সেন্ট্রাল পার্কে কলকাতা বইমেলা শুরুর হওয়ার কথা ৩১ জানুয়ারি। চলবে ১৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। গিল্ড কর্তৃপক্ষকে জানুয়ারির গোড়া থেকেই বইমেলার কাজ করার নির্দেশ দেয় নবান্ন। এ জন্য যাবতীয় সাহায্য করার কথা বলা হয় সব দপ্তরকে। এর পর পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি হয়েছে।
গিল্ডের সভাপতি সুধাংশু শেখর দে বলেছেন, ‘করোনার কারণে গত বার মেলার আয়োজন করা যায়নি। ফলে এ বার মেলা নিয়ে আমজনতার পাশাপাশি প্রকাশনা সংস্থাগুলির আগ্রহও প্রবল। বিধি মেনেই আমরা আয়োজন করব।’ উদ্যোক্তা ত্রিদিব চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্য, ‘দিদি (মুখ্যমন্ত্রী) যেভাবে বলবেন, তাই হবে।’ খোদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় আগামী দু’মাস সব রকম সমাবেশ না করার কথা বলেছেন শনিবার।
এব্যাপারে কী বলছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা?
“সবাই সচেতন না হলে দীর্ঘকাল ধরে সব কিছু বন্ধ করে রাখা সম্ভব?”
— অপু দে, কর্নধার দে’জ পাবলিশিং
কলকাতা বইমেলা করার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। প্রশ্নটা মোটেই ভিত্তিহীন নয়। অবশ্যই যুক্তিসঙ্গত। আমাদের সকলেরই উচিত যতভাবে সম্ভব, সতর্কতার সঙ্গে করোনার মোকাবিলা করা। কারণ, গোটা রাজ্যের কত মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন, রুজি হারিয়েছেন তার খোঁজ আমরা রাখি না। সতর্কতা নেওয়া সত্বেও ২০২০ সালে আমার একবার করোনা হয়েছিল। এখন আবার আক্রান্ত হয়েছি। সমাবেশ হলে সংক্রমণের আশঙ্কা অবশ্যই থাকবে। এসব স্বীকার করেও প্রকাশক হিসাবে আমি চাইব বইমেলা হোক। গঙ্গাসাগর মেলা যদি হতে পারে, বইমেলা নয় কেন? এই মেলার আয়োজনের একটা বড় দায়িত্ব আমার বা আমাদের ওপর পড়ে। আমার মতে, বিপদের আশঙ্কা থেকে বাঁচতে আমাদের প্রত্যেককে, প্রতি পদে সচেতনভাবে অঙ্গীকার করতে হবে। প্রয়োজনে সব কিছু বিচার করে মেলা পিছিয়ে দেওয়ার কথাও ভাবা যায়। কিন্তু আমার প্রশ্ন, প্রধানমন্ত্রী-মুখ্যমন্ত্রী-আদালতের পুনঃ পুনঃ আবেদন সত্বেও অধিকাংশ মানুষ যেখানে বিধি মানছেন না, সেখানে কেবল বইমেলার ওপর কোপ দিয়ে কি বিপদ রোখা যাবে? সবাই সচেতন না হলে দীর্ঘকাল ধরে সব কিছু বন্ধ করে রাখা সম্ভব?
***
“বইমেলা হলে এমন কিছু ক্ষতি হবে না“
— সুস্বাগত বন্দ্যোপাধ্যায়- অধ্যাপক,
সম্পাদক রাজগীর রামকৃষ্ণ সারদা আশ্রম।
বইমেলা এবং মেলা বন্ধ করার যুক্তি দেখি না। করোনা বলে যা হচ্ছে তার বেশিরভাগটাই সর্দি-কাশি। মৃত্যুর আশঙ্কা প্রায় নেই। ১৮ হাজার আক্রান্তের মধ্যে ১৮ হচ্ছে কি না সন্দেহ! এর থেকে অনেক বেশি দৈনিক মৃত্যু হচ্ছে ক্যান্সার, হৃদরোগ প্রভৃতিতে। করোনার নামে একটা উদ্দেশ্যমূলকভাবে আতঙ্ক ছড়ানো হচ্ছে। একটা নাটক বা খেলা চলছে। ক্ষতি হচ্ছে প্রান্তিক মানুষদের। এই উপলক্ষে কিছু লোক আয় করছে। অ্যাপস-এর ব্যবসা বাড়ছে। এই ক’বছরের ছেলেমেয়েরা যেন কালো তালিকায় পড়ে যাচ্ছে। আতঙ্কগ্রস্ত না হয়ে অনেকে কাজও তো করছে। আমি ‘ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন’-এর সম্পাদক হিসাবে বিদ্যাসাগরের সমাধি সংরক্ষণে উদ্যোগী হয়েছিলাম। মহামারীর সময় কলকাতা পুরসভা এবং নিমতলা শ্মশান একমাস ধরে ছোটাছুটি করেছি। বিদ্যাসাগরের মৃত্যুর একশো তিরিশ বছর পর সমাধি বেদী নির্মাণ হল।
২০২০-র ৩০ জুলাই মন্ত্রী শশী পাঁজা ও কিছু বিশিষ্টের উপস্থিতিতে নিমতলায় সেটা করার অবকাশ হয়েছিল। তখন আমাকে কোভিড ধরেনি।
রাস্তায় বার হলে হার্ড ইমিউনিটি বাড়ে। রোগ মোকাবিলার সহায়ক হয় সেটি। তা ছাড়া, বইমেলা বাঙালির একটা উৎসব। হুজুগে বহু লোক মেলায় বই কেনে। এই শিল্প ও মেলার সঙ্গে নানা পেশার বহু মানুষ জড়িয়ে থাকেন। মেলা না হলে ওঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
***
“বৃহত্তর স্বার্থের ক্ষেত্রে সাময়িক আনন্দ বা ক্ষুদ্র চাহিদাকে ত্যাগ করা শ্রেয়“
— আবীর কুমার গড়াই, পরামর্শদাতা- মৌলানা আজাদ মিউজিয়াম (মৌলানা আবুল কালাম আজাদ ইনস্টিটিউট অফ এশিয়ান স্টাডিস)
বর্তমানে কোভিড সংক্রমণের ভয়াবহতার মধ্যেও শেষ পর্যন্ত সাগর মেলার আয়োজন হচ্ছে, তাই সাগর মেলার পরে কোভিড পরিস্থিতি কি হবে, সেই সম্পর্কে ধারনা বা আলোচনা এখন অমূলক। তবে সাগর মেলা এই বছর স্থগিত হলে খুব খারাপ কিছু হতো বলে মনে হয় না। ক্রিসমাস পালন বা বর্ষবরণ উৎসবের পরে চিত্রটা কী তা আমাদের সকলের সামনেই স্পষ্ট, সেখানে সাগর মেলা বা বাঙালির প্রিয় বইমেলার পর পরিস্থিতি আরও কতটা ভয়ংকর হতে পারে তা অনুমানের জন্য খুব বেশি গবেষণার প্রয়োজন নেই। বইমেলা হওয়া নিয়ে সংশয় থাকলেও গিল্ডের তরফে প্রস্তুতি পর্ব শুরু হয়ে গিয়েছে। এবারের থিম বাংলাদেশ। বইমেলা ঘিরে হাজার মানুষের জীবিকা, রোজগারের প্রশ্ন জড়িয়ে তা আমাদের সকলেরই জানা এবং এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সেই সম্পর্কে কোনো সন্দেহ নেই। আমাদের সকলের প্রিয় বইপাড়ার হাল ফেরাতেও বইমেলার ভূমিকা অপরিসীম। কিন্তু একটু বিশদে গিয়ে পর্যালোচনা করা গেলে মনে হয় বৃহত্তর স্বার্থের ক্ষেত্রে সাময়িক আনন্দ বা ক্ষুদ্রতর চাহিদাকে ত্যাগ করাই শ্রেয়।
***
“আগে মানুষ ও সুস্থ জীবন, তারপর তো সংস্কৃতি“
— সুদীপ রায়চৌধুরী, অবসরপ্রাপ্ত আধিকারিক- টাটা স্টিল
উৎসব-মেলা এ’সবই আমাদের সংস্কৃতির অঙ্গ। তবে বিশ্বব্যাপী মহামারীর এই মারণ পর্বে এই ধরণের অনুষ্ঠান বন্ধ রাখাই আমার মতে বাঞ্ছনীয়। পৌষ সংক্রান্তির সাগরমেলা প্রবহমান ধারায় নির্দিষ্ট দিনেই হয়। তবে এ’বছর তা নিয়ম রক্ষার্থে হলেই ভালো হতো। তাতে শ্যাম ও কূল দুই রক্ষা পাবে।
অন্য দিকে, বর্তমান পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতিতে পৃষ্ঠপোষকদের পক্ষে বই মেলা আয়োজন করা হলেও এ’বছর সন্ত্রস্ত পাঠকদের সমাবেশ কতটা হবে এবং ঐ’মেলার ব্যবসায়ীক সাফল্য কতটা আসবে, তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় আছে! মেলার সমাবেশ থেকেও সংক্রমণ তো কিছুটা বাড়াবেই । তাই চলতি বছর মেলার বিষয়টা অবশ্যই ভেবে দেখা দরকার বলেই মনে হয়।
বস্তুতঃ জীবাণু-শত্রুটির লক্ষ্য সমাবেত মানব সমাজ। তার বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবশ্যই মানুষ যতটা বিচ্ছিন্ন ও নিভৃতে থাকে, ততই মঙ্গল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আমার দেখার সৌভাগ্য না হলেও, ‘৬২র চীনের যুদ্ধ বা ‘৬৫র পাক যুদ্ধের বছরেও এই ধরণের অনুষ্ঠানগুলোর হার-সার চেহারা দেখেছি। আসলে আগে মানুষ ও তাদের সুস্থ জীবন, তারপর তো তার সংস্কৃতি।
***
“শুধু বই-পত্তরের সাথেই কি করোনার যুদ্ধ?“
— সুদেষ্ণা দাশগুপ্ত, লেখক ও আবৃত্তিকার
অতিমারির শুরু থেকে এই প্রশ্নই বারে বারে উঠে এসেছে যে জীবন আগে না জীবিকা? কেউ বলেছেন জীবন আগে বাঁচুক তারপর তো জীবিকার প্রশ্ন। তবে জীবিকার দরজা দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় করোনার থেকে বেঁচে ফেরা জীবন যে জীবিকা হারিয়ে মরতে বসেছে, তার সাক্ষী আমরা ক্রমাগত হয়ে চলেছি।
তা-না-না-না করেও শেষ পর্যন্ত গঙ্গাসাগর মেলা হচ্ছে। তাহলে বইমেলাই বা বন্ধ থাকবে কেন? শুধু বই-পত্তরের সাথেই কি করোনার যুদ্ধটা? ঠাট্টা করার সময় বা প্রসঙ্গ এটা নয়। আরও কিছুদিন রাজ্যের ও কলকাতার করোনা-চিত্র কীরকম দাঁড়ায় তারপর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার। প্রয়োজন হলে আরেক সপ্তাহ পরেও শুরু করা যেতে পারে, তার জন্য বাড়তি ভাড়া ইত্যাদি রাজ্যসরকারের উচিত মাফ করা। বইয়ের সাথে যুক্ত বহু মানুষের জীবন ও জীবিকা দুই’ই অপেক্ষা করে আছে এই বইমেলার দিকে তাকিয়ে।
***
ডঃ উজ্জ্বয়িনী হালিম
—সমাজকর্মী
আমি বইমেলার ভক্ত, কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে সব রকম অনুষ্ঠান, যেখানে এক সাথে অনেকে জড়ো হবেন, সেটার সমর্থন করতে পারছি না। একাধিক সিদ্ধান্তের মধ্যে তো কোন যুক্তি থাকতে হবে! কোথাও বন্ধ – কোথাও খোলা – এ কিরকম খামখেয়াল! সাগরমেলায় কি করে কোভিড বিধি মেনে চলা সম্ভব সেটা সাধারণ বুদ্ধিতে বুঝলাম না। কলকাতায় নানা ছোট মেলা বন্ধ করা হয়েছে যেমন খাদি মেলা। এ রাজ্যেরই অন্যান্য জেলায় কিছু মেলা বন্ধ করা হয়েছে। তাহলে বই মেলা করার যুক্তি কোথায়?
***