ড. কল্যাণ চক্রবর্তী
আমাদের ভারত, ২৩ জুন: মন্ত্রিত্ব, রাজনীতি, সেবাকাজ ইত্যাদি বাদ দিলেও স্রেফ কলকাতার মতো একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন প্রয়াত উপাচার্য হিসাবে অন্তত জন্মদিনে একটি হলেও মালা প্রাপ্য হয় তাঁর; হিন্দু বাঙালির জন্য রাজনীতি করতে গিয়ে, বাঙালি হিন্দুর শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে ‘পশ্চিমবঙ্গ’-কে পাকিস্তান থেকে কেটে এনে দিতে গিয়ে, এক দেশ/এক কানুন/এক নিশানের দাবিতে লড়তে গিয়ে ‘সাম্প্রদায়িক’ পদবাচ্য হয়ে শাসকের মালা হারিয়েছেন তিনি। তাতে অবশ্য তাঁর বিন্দুমাত্র সম্মান কমেনি কোনোদিনই। যত দিন গিয়েছে, বাঙালি মানসে তিনি ক্রমেই উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছেন। আজকের দিনে অনেকানেক অমেরুদণ্ডী শিক্ষাবিদের বিপ্রতীপে তিনি এক প্রবল প্রতাপ পুরুষ সিংহ। তোতাপাখির মতো বুলি শেখানো শিক্ষাবিদরা প্রতিষ্ঠানে যে কতখানি অপ্রাসঙ্গিক, তা শ্যামাপ্রসাদকে সামনে রেখে পরিমাপ করে বুঝতে পারি আমরা।
১. ছাত্রাবস্থায় জেনেছিলাম, অনাথ ছাত্রদের প্রতি শ্যামাপ্রসাদের বিশেষ স্নেহমমতা ছিল। অকালে বাবাকে হারিয়ে কার্যত অনাথ হয়ে পড়েছিলাম, তাই রহড়া রামকৃষ্ণ মিশন বালকাশ্রমে আমার ঠাঁই হল। সেখানে একটি অনাথ ছাত্রাবাসের নাম ‘হিন্দু মহাসভা ধাম’। তখন ক্লাস এইটে পড়ি। সাধারণভাবে বিভিন্ন হোস্টেলের নাম ‘ব্রহ্মানন্দ ধাম’, ‘শিবানন্দ ধাম’ ‘যোগানন্দ ধাম’ ইত্যাদি হতো জানতাম। কিন্তু তার মধ্যে ‘অন্য জাতীয় শব্দ’ ‘হিন্দু মহাসভা ধাম’ কীভাবে হয়ে গেলো, তার যোগ্য জবাব খুঁজে পাচ্ছিলাম না তখন। মিশনের সবচাইতে প্রাচীন আশ্রমিক শ্রী বিধূভূষণ নন্দ আমার যাবতীয় প্রশ্নের মীমাংসা করে দিয়েছিলেন। জানলাম রহড়া বালকাশ্রমে হিন্দুমহাসভার দানও আছে।
১৯৪৫ সালে পুণ্যানন্দজীর আমন্ত্রণে শ্যামাপ্রসাদ খড়দায় এসেছিলেন কেবল হিন্দু মহাসভার নেতা হিসাবে নয়, একজন শিক্ষাবিদ হিসাবেও। তিনি এখানকার শিক্ষাব্যবস্থা কী হবে, তা নিয়ে বিস্তারিত পরিকল্পনা ছকে দিয়েছিলেন বলে জানা যায়। রহড়ায় পরবর্তীকালে অনাথ ছেলেদের কর্মসংস্থানমুখী কারিগরি শিক্ষার পরিকল্পনা সম্ভবত শ্যামাপ্রসাদেরই মানস-ভাবনা৷
হিন্দু মহাসভার কর্ণধার ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের উদ্যোগে তার আগে কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হত। বাংলাদেশে খুলনার সেনহাটি হাইস্কুল ছিল এই রকম একটি প্রতিষ্ঠান। নানান কারণে শ্যামাপ্রসাদ এই স্কুলটি চালাতে পারছিলেন না। তিনি পুণ্যানন্দজীর সঙ্গে যোগাযোগ করলেন এবং এই সমস্ত ছেলেদের পাঠাতে চাইলেন রামকৃষ্ণ মিশনে। স্বামীজি রাজি হলেন। পরবর্তীকালে ওই ছাত্রদের জন্য গৃহ নির্মাণের ব্যাপারে তিনি হিন্দু মহাসভার পক্ষ থেকে একটি বড় অঙ্কের টাকা দান করলেন। এই টাকায় তৈরী হয়েছিল ‘হিন্দু মহাসভা ধাম’।
অনাথ ছাত্রদের জন্য শ্যামাপ্রসাদের বেদনার্ত হৃদয়, তাঁর সেবাকাজ, আর্তত্রাণের ইতিহাসও বোধহয় হারিয়ে যায়নি। শ্যামাপ্রসাদ নিয়ে গবেষণা করলে একটি সময় ‘সাম্প্রদায়িক পদবাচ্য’ হতে হতো। ভয়ে-ভক্তিতে তাই সে পথে বিশেষ কেউ আর যাননি। শিক্ষাবিদ হিসাবে তাঁর টুকরো টুকরো বহু উদাহরণ জুড়ে আঞ্চলিক ইতিহাস উপাদানের পুঁথি গাঁথা হয়, তবে সামগ্রিক ইতিহাসের পুনর্নির্মাণ করা সম্ভব হবে।
২. এবার বলি এক ‘বাঘ’-এর ছেলে ছিলেন এক ‘সিংহ’ (স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়কে ‘বাংলার বাঘ’ নামে ডাকা হত, আর ড. শ্যামাপ্রসাদকে সাংসদ হিসাবে দক্ষতার জন্য ডাকা হত ‘ভারত কেশরী’)। ‘বাপ কা বেটা’ — সবাই বলতেন। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় মনে করতেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপারে অভাব অভিযোগ জানানোর একমাত্র পাত্র হচ্ছেন শ্যামাপ্রসাদ। ১৯২৫ সালে একটি চিঠিতে প্রফুল্লচন্দ্র লিখছেন, “ইউনিভার্সিটির ব্যাপারে তুমি দেখিতেছি বাপ কা বেটা হইয়াছো। কেননা এত অক্লান্ত পরিশ্রম ও স্বার্থত্যাগ কেহই করিতে পারিবে না।” ১৯৩৪ সালের ৮ আগস্ট মাত্র ৩৩ বছর বয়সে ভারতবর্ষের সর্বাপেক্ষা বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য পদে আসীন হলেন শ্যামাপ্রসাদ। পিতা-পুত্র কোনো একটি ঐতিহ্যবাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রসরতাকে প্রবল গতিসম্পন্ন করেছেন এমন উদাহরণ সম্ভবত একটিই— উপাচার্য হিসাবে স্যার আশুতোষ মুখার্জি এবং তার উত্তরাধিকারী শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি। অনেকে মনে করেন, আশুতোষের মৃত্যুর পরই ‘উপাচার্য’ হয়েছিলেন শ্যামাপ্রসাদ। আসলে তা নয়, পিতার মৃত্যুর অন্তত দশ বছর বাদে তিনি উপাচার্য হন এবং উপাচার্য হবার আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক নানা কাজ তিনি দক্ষতার সঙ্গে সামলে, নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করেই পদে আসীন হয়েছিলেন।
আশুতোষের প্রয়াণের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনে উৎকর্ষতার প্রবল অভাব অনুভূত হয়েছিল। একাগ্রতায়, অধ্যাবসায়ে, সাধনায় ও প্রজ্ঞায় তা পূরণ করে দিয়েছিলেন শ্যামাপ্রসাদ। পাঠক্রমে ও প্রশাসনে পিতাপুত্র উভয়েই উল্লেখযোগ্য রূপান্তর সাধন করেছিলেন। আশুতোষের হাতে উপাচার্যের দায়িত্ব ছিল ১৯০৬ সাল থেকে ১৯১৪ সাল পর্যন্ত এবং দ্বিতীয় দফায় ১৯২১ থেকে ১৯২৩ সাল পর্যন্ত। তবে এটা ঠিক, জীবদ্দশায় পিতার শিক্ষাচিন্তার সঙ্গে সম্যক পরিচিতি লাভ করার সুযোগ পেয়েছিলেন পুত্র। সামান্য সময়ের জন্য হলেও পরিচালনার কাজ একসঙ্গে করার সুযোগ ঘটেছিল। কারণ ১৯২৪ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেটর সদস্য মনোনীত হন তিনি। তার কয়েকমাস বাদে পিতার মৃত্যু ঘটে। তারপর তিনি সিন্ডিকেটেরও সদস্য হলেন। তখন তার বয়স মোটে ২৩। ১৯৩৪ থেকে ৩৮ সাল পর্যন্ত তিনি উপাচার্য ছিলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘স্বর্ণযুগ’ বলতে যা বোঝায়, তা হল তাঁর পিতার ১০ বছর এবং পুত্রের চার বছর মেয়াদি উপাচার্য পদে আসীন হবার কালপর্ব। অনেকের মতে, বিশ্ববিদ্যালয়ের কুশলী কার্যকর্তা হিসেবে শ্যামাপ্রসাদ নির্ধারিত সময়ের অনেকদিন আগে এবং পরেও কাজ করে গেছেন, তা De facto উপাচার্য-র মতোই। ১৯৩৪ থেকে হলেন Dejure উপাচার্য। বিদায়ী উপাচার্য স্যার হাসান সুরাবর্দিও তার নিয়োগে উচ্ছ্বসিত অভিনন্দন জানিয়েছিলেন।
উপাচার্য পদ থেকে সরে যাবার পরও ১৯৫২ সাল পর্যন্ত শ্যামাপ্রসাদ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে আমন্ত্রিত হয়ে বক্তব্য রেখেছেন, তার মধ্যে মৌলিক শিক্ষাচিন্তার নির্যাস পাওয়া যায়। ১৯৩৭ সালে বোম্বাই বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন ভাষণে বললেন, পরাধীন ভারতে শিক্ষা ব্যবস্থার সমস্ত স্তরের মধ্যেই সমন্বয়ের প্রয়োজনীয়তা আছে। ভারতবর্ষে নানা প্রান্তে শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে যে বৈচিত্র্য রয়েছে, তার মধ্যে ঐক্যসূত্রটি তুলে আনা দরকার। যখন ১৯৪৩ সালে গুরুকুল বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তন ভাষণ দিচ্ছেন ততদিনে বুঝতে পেরে গেছেন ভারতের স্বাধীনতা অর্জন কেবল সময়ের অপেক্ষা, আসছেই। তাই উত্থাপন করলেন জাতীয় শিক্ষানীতির প্রসঙ্গ। এইভাবে বাঙ্গলার শিক্ষাবিদ হিসেবে ভারতে একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করে নিলেন তিনি। বললেন, জাতীয় শিক্ষার এমন একটি সুস্থ নীতি প্রতিষ্ঠিত হওয়া দরকার যা সর্বনিম্ন স্তর থেকে সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতি সাধন করতে পারে। তিনি কতকগুলি দিক চিহ্নিত করলেন যা পরবর্তীকালে দেশের শিক্ষাবিদদের কাছে পথনির্দেশ হয়ে উঠলো। যেমন, সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত জাতীয় ভাষাগুলির মাধ্যমে পঠন-পাঠন ও পরীক্ষার ব্যবস্থা পরিচালিত হওয়া, দেশের প্রয়োজন ও প্রত্যাশা মেটাতে পাঠ্যসূচি পুনর্বিন্যস্ত ও নবায়িত করা, ভারতীয় সভ্যতার মৌলিক উপাদানগুলির সঙ্গে বৈজ্ঞানিক যুগের প্রয়োজনীয় উপাদানগুলির সুষ্ঠু সমন্বয়ের পদ্ধতি।
ড. শ্যামাপ্রসাদকে ত্ৰিভাষার প্রয়োজনীয়তার কথা সওয়াল করতে দেখা যায়। আঞ্চলিক ভাষা বা মাতৃভাষা, জাতীয় ভাষা যা ভারতের সর্বত্র যোগাযোগ রক্ষার ভাষা এবং আন্তর্জাতিক ভাষা যা বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে অপরিহার্য। ভাষা সম্পর্কে তিনি গোলমেলে হঠকারী সিদ্ধান্ত নেবার পক্ষপাতী ছিলেন না। ইংরেজি ভাষা ব্রিটিশের ভাষা বলে উপেক্ষাও তিনি করেননি, আবার প্রাচীনতম সংস্কৃত ভাষার প্রয়োজনীয়তার কথা বলে তার মধ্যেকার মণিমাণিক্য সংগ্রহে জোর দিতে বলেছেন, বিশেষত তার মধ্যে অনাবিষ্কৃত উপাদান সংগ্রহ করতে অনুপ্রাণিত করেছেন।
নারী শিক্ষার প্রতি যত্নবান হতে শিক্ষাবিদ হিসেবেও তাঁর বিশিষ্ট অবদান রয়েছে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে মহিলাদের জন্য গার্হস্থ্যবিজ্ঞান (Home Science) পাঠ্যক্রমের সূচনা করেছিলেন তিনি। আরও যে বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন সকলের, তা হলো কলকাতায় কৃষিবিদ্যা অধ্যয়নের ব্যবস্থা; ফলিত পদার্থবিদ্যায় Communication Engineering পাঠ্যক্রমের আয়োজন, শিক্ষকদের শিক্ষাদানে দক্ষ করে তুলতে টিচার্স ট্রেনিং কোর্সের প্রবর্তন, প্রাচীন সভ্যতা সংস্কৃতির নিদর্শন সংরক্ষণ, চর্চা ও গবেষণার জন্য মিউজিয়াম স্থাপন ইত্যাদি।
শরীরচর্চা যে জাতি গঠনের অন্যতম বিষয়, তা বুঝেছিলেন তিনি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে খেলাধুলার উন্নতিতে তার অনন্য পরিকল্পনা ও রূপায়ণ ছিল।
১. ছাত্রদের খেলাধূলা এবং ব্যায়াম চর্চার ব্যবস্থা করলেন। ২. ঢাকুরিয়া লেকে তৈরি হলো ইউনিভার্সিটি রোইনিং ক্লাব। ৩. তাঁরই উদ্যোগে তৈরি হলো ইউনিভার্সিটি অ্যাথলেটিক্স ক্লাব।
৪. ময়দানে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য আলাদা খেলার মাঠের ব্যবস্থা হলো। ইত্যাদি।
(ছবি — শীর্ষ আচার্য)