(খড়দার ভূমিপুত্র কৃষিবিজ্ঞানী ড. কল্যাণ চক্রবর্তী খড়দায় একাদিক্রমে ৩৫ বছর অবস্থান করেছেন। তার সঙ্গে খড়দার মানুষের দীর্ঘ সাংস্কৃতিক-সাহিত্যিক-সামাজিক যোগসূত্র আজও বিনষ্ট হয় নি। তিনি আপন-চারণায় সমকালীন সময়ের অভিজ্ঞতা শেয়ার করছেন, তার মধ্যে সেই সময়ের স্থানীয় ইতিহাস কিছুটা ফুটে উঠবে এই আশায় তা পরিবেশিত হল। তিনি ব্যক্তিবিশেষকে আক্রমণ করার লক্ষ্যে এই ধারাবাহিক নিবন্ধ লিখছেন না, লিখছেন নিজেকে অবিরত জানতে, নিজের ফেলে আসা পথটির স্বরূপসন্ধান করতে, যাতে আগামীদিনে আরো নির্মল ভাবে সকলকে সঙ্গে নিয়ে পথ চলতে পারেন। প্রস্তুত প্রতিবেদনটি তার পঞ্চম পর্ব)
ড. কল্যাণ চক্রবর্তী
আমাদের ভারত, ২৩ ডিসেম্বর: ১৯৯৯ সালের ডিসেম্বর মাস। খড়দহে বইমেলার আয়োজন হয়েছে। প্রথম সভাপতি পীযূষ কান্তি চট্টোপাধ্যায়, তিনি তখন রহড়া রামকৃষ্ণ মিশন ব্রহ্মানন্দ বিএড কলেজের অধ্যক্ষ পদ থেকে অবসর নিয়েছেন। প্রথম সম্পাদক মনোনীত হলেন ডাক্তার সমীর ব্যানার্জি। রহড়ার অনেক বন্ধু-বান্ধব, পরিচিত মুখ যুক্ত হচ্ছেন, আমাকেও প্রতিষ্ঠাতা-সদস্য হবার সুযোগ দেওয়া হল। আমি অসঙ্কোচে স্বাক্ষর করে সদস্য চাঁদা আর অনুদান দিয়ে দিলাম, আপত্তি করলাম না। বইমেলাতে আপত্তি থাকবেই বা কেন! কোনো বইকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার পক্ষপাতীও নই। আয়োজক-বন্ধুরা বোধহয় বুঝেছিলেন, একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার সঙ্গে যুক্ত যখন, নিশ্চয়ই বই-টই পড়ি, বইয়ের মর্ম কিছুটা বুঝি, সদস্য করা যায়! তাছাড়া তখন শাসকদলের বুদ্ধিজীবীরা সাড়া দিচ্ছিলেন না মোটেও, ফলে বিস্তর খোঁজাখুঁজি চলছিল যোগ্য সদস্যতার জন্য। কেই বা গড্ডালিকা প্রবাহের বিরুদ্ধে যাবেন!
শাসকদলের মোহ বলে কথা! একেবারে প্রথম দিকে সদস্য কম ছিল, তবে তাদের মধ্যে সমন্বয় কিন্তু ভালোই ছিল। ডাক্তার সমীর ব্যানার্জিকে সমীহ করতাম বরাবরই, পীযূষবাবুও আমার পাড়ায় থাকতেন, আমাকে চিনতেন। পীযূষবাবু প্রথম বছর কাজে সহায়তা করতে বইমেলা কার্যালয়ে দৈনিক বসবার ডাক দিলেন। রহড়া মধ্যপাড়া মোড়ের একটি দোকান ঘর ছিল অস্থায়ী কার্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিরে সন্ধ্যায় বসতাম আড্ডার মেজাজে, চিঠিপত্রের ড্রাফ্ট করতাম, হরেকরকম টুকটাক কাজ ও নির্দেশ চলতো, আর চলত বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে, বাঙালি সাহিত্যিকদের নিয়ে উপস্থিত সদস্যদের মধ্যে নানান আলোচনা। পীযূষবাবু সরাসরি আমার শিক্ষক ছিলেন না, কিন্তু কয়েকজন প্রত্যক্ষ শিক্ষক মেলায় যুক্ত ছিলেন। ছাত্র-শিক্ষক সমভিব্যাহারে সাহিত্য আলোচনায় যে একটা আলাদা আনন্দ আছে, অনুভব করতে চেষ্টা করতাম তখন। কার্যালয়ে বসার আর একটি কারণও থাকত, যে যার পরিচিত মহলকে অবস্থানের সৌকর্যে আগমন-আকর্ষণ করে নিয়ে আসা, ‘খব’-কে খবর করা, নিজের উপস্থিতির মাধ্যমে জনসাধারণকে বিজ্ঞাপন দেওয়া। খড়দার অনেক মানুষ সেই সুবাদে আমার কাছেও আসতেন, কিছু সময় কাটিয়ে যেতেন সাহিত্যের আড্ডায়, আর কথা দিয়ে যেতেন, সপরিবারে-সবান্ধবে আসবেন মেলার আঙ্গিনায়।
পরের বছরও সদস্য হলাম, সেটা ২০০০ সাল। একটা সময় অনুভব করলাম, খড়দার বুকে প্রকাশিত সংবাদপত্র ‘সংবাদ এখন’ (পরে নাম পরিবর্তিত হয়ে ‘রোজনামচা’) সম্পাদনার সুবাদে একাধারে ‘সুখ্যাতি’ ও ‘কুখ্যাতি’ ঘটেছিল আমার। সে বিষয়ে প্রস্তুত রচনার চতুর্থ পর্বে কিছুটা বলেছি। আর বাজার চলতি কথা ছিল, পত্রিকাটি শাসকদল বিরোধী, বইমেলাটিও তাই। এমনিতেই তখন শাসকদলের ঘনিষ্ঠ মানুষ আমার সঙ্গ বর্জন করতেন, দেখা হলে চোয়াল শক্ত হয়ে যেতো, কেউ কেউ আমার মুখে অবয়বের বদলে কাঠ-পাথর-হাওয়া-বাতাস দেখতেন। কিন্তু এটা লক্ষ্য করলাম, বইমেলার মধ্যেও কিছু প্রবুদ্ধজন ‘সম্পাদক কল্যাণ চক্রবর্তী’-কে এড়িয়ে চলেন। তার কারণ ধর্মতত্ত্বের প্রতি তার বিশেষ আগ্রহ– হিন্দুত্ববোধ, রাষ্ট্র চেতনা, সনাতনী-চারণা এবং শিকড়-সংস্কৃতির নৈকট্য। যেখানে প্রকাশ করে ফেললাম, দেশবিভাগ ও বিভাজন-দুর্গতি নিয়ে অনেকানেক সাহিত্য রচনা হলেও, তার উৎস-সন্ধান সেভাবে হয়নি, তখনকার দাঙ্গাবাজদের চিত্রায়ণ নিয়ে কলম খরচ হয়েছে কম –তখনই হয়তো মেলাবাজিতে অনেকটা পিছলে গেছি! কোনো কোনো সাহিত্যিক যে অমেরুদণ্ডী, তা সবিস্তারে বলার মধ্যেও অনেকে অপরাধ খুঁজতে পারেন। কিন্তু আমার বিশ্বাস ছিল এবং এখনও আছে, আজও খড়দহ বইমেলা আমার প্রাণের সম্পদ। তারা ডাকুন, চাই না ডাকুন, সদস্য বানান, চাই না-ই বানান, খড়দহ-তীর্থে প্রতিবারই একবার পা রাখি নীরবে-নিভৃতে, শিকড়ের টানে, বইয়ের সুখে।
পুস্তক-যাপন, সেটাও একটা সুখের নাম। আর বুঝেছি, শিক্ষাবিদ বহুধা বিভক্ত, কেউ কারো মত শোনার জায়গাতেও থাকেন না। আসলে মত ধীর ও ধারাবাহিক প্রক্রিয়ায় তৈরি করে নিতে হয়, জুলুম চলে না, আমি ক্ষমতায় আছি মানেই পুরোটা আমার–এ এক শৈশবের পাগলামি। দৃঢ়কণ্ঠে অসত্যকে দূরে রেখে, মত শোনানোর সময় যখন আসে, তখন তা সহজেই মগজে মজে, আপনিই বেজে ওঠে মস্তিষ্কের মৃদঙ্গ, অনবধানেই কথা লিখে চলে হৃদয়ের হাল। অপেক্ষায় আছি, এইবার সময় হল বলে! কিন্তু আপসোস এই, সেদিনের মানুষ যারা এই মেলাতে অলংকার হতেন, তাদের অনেককে আর পাবো না, দীর্ঘ ২০ বছর বাদে। প্রশ্ন, তারাও কী সয়েছেন আমাদের মতো মানুষকে? তারাও কী সাহিত্য-মত প্রকাশ করবার পিঁড়ে পেতে দিতেন পড়শির মতো? অনুমোদন করতেন আপনায় জেগে ওঠা সাহিত্য-চিন্তাকে? যদি তা না হয়, তবে দূরত্বই ছিল প্রকৃত বাস্তব। যদি আগামী দিনে সে সৌন্দর্য খড়দার মাটিতে ধরা দেয়, তবে তা রমন-মেলাই হবে, হলফ করে বলতে পারি। কারণ ‘রাম’ তিনিই যিনি রমন করেন, আনন্দ দেন। বই পড়ে যদি আনন্দ না পাই, যিনি বই লিখেছেন তিনিও যদি অর্ডারি লেখায় লিপ্ত থেকে তৃপ্তি না পান, তবে বই পড়ার ও বইপাড়ার পুরো মেলাটাই মাটি! খড়দহ বইমেলা আনন্দমেলা হোক। আবারও যাবার ইচ্ছে নোটবুক নিয়ে।–ক্রমশ