
অশোক সেনগুপ্ত
আমাদের ভারত, কলকাতা, ২৯ এপ্রিল: শুক্রবার সামাজিক মাধ্যমের একটা বড় অংশে দিনভর প্রচারিত হল বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়কে সব মামলার শুনানী থেকে অপসারিত করা হয়েছে। এ নিয়ে অনেকে অনুযোগ করছেন। তার প্রেক্ষিতেই এই আলোচনা।
এই মাধ্যমের একটা মস্ত বড় সমস্যা, নেটনাগরিকদের একটা অংশ যা দেখেন সেটাই শেয়ার করে দেন। সত্যমিথ্যে যাচাই না করে। এই আলোচনা রাজনৈতিক নয়, তথ্যনির্ভর।
ওপরের ছবিটা চেনা চেনা লাগছে?
ডিসেম্বর ২০২০ তে, তাঁর শান্তিনিকেতন সফরের সময়, অমিত শাহ রবীন্দ্রনাথের চেয়ারে বসে ছিলেন, এমনই এক দাবি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। তাতে শাহকে এক জায়গায় বসে ভিজিটার্স বইয়ে সই করতে দেখা যাচ্ছে।
এর পর ২০২১-এর ৮ ফেব্রুয়ারি, লোক সভায় ভাষণ দেওয়ার সময় অধীর রঞ্জন চৌধুরী অভিযোগ করেন রবীন্দ্রনাথের চেয়ারে বসে অমিত শাহ রবীন্দ্রনাথের অসম্মান করেছেন। ভাষণে অধীরবাবুকে হিন্দিতে বলতে শোনা যায়: “এই সরকার আমাদের সকলের। আমি বলতে চাই যে, বিজেপির নেতা অমিত শাহ ও নাড্ডা সাহেব নির্বাচনের আগে বাংলায় গিয়েছিলেন। তাঁরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শান্তিনিকেতনে গিয়েছিলেন। ওঁরা বলেছেন সেখানে তাঁর জন্ম হয়। এটা খুব অদ্ভুত। পড়াশোনা করে তারপর যান। জানুন কোথায় তিনি জন্মেছিলেন। আপনি হঠাৎ বলছেন, উনি শান্তিনিকেতনে জন্মেছিলেন। লোকে হাসছে। আমাদের খারাপ লাগছে এই ভেবে যে, আপনারা একটা এত বড় দেশের নেতা। আমাদের অমিত শাহ সেখানে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের চেয়ারে বসেন। জানি না লোকে আপনাকে কী বলেছিল যে আপনি তাতে বসলেন। এটা অসম্মান করার শামিল। আপনি যান। কিন্তু স্থানীয় সংস্কৃতি রীতিনীতির প্রতি নজর দিন। সেখানে বার বার যান।”
সত্যাসত্য যাচাইয়ের নির্ভরযোগ্য মাধ্যম ‘বুম’ বিষয়টি খতিয়ে দেখে। তারা নিশ্চিত হয়ে জানায় যে, ২০ ডিসেম্বর, শান্তিনিকেতনে গিয়ে, শাহ রবীন্দ্রনাথের চেয়ারে বসেননি। উনি বসেছিলেন একটি জানলার সামনের এক জায়গায়। ৯ ফেব্রুয়ারি, লোক সভায় ভাষণ দেওয়ার সময়, শাহ স্পষ্ট করে দেন যে, উনি একটি জানালার সামনের অংশে বসেছিলেন, রবীন্দ্রনাথের চেয়ারে নয়। তাঁর দাবির সমর্থনে শাহ বিশ্বভারতীর উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তী চিঠিও দেখান। তাতে উপাচার্য শাহর বক্তব্যকেই সমর্থন করেন। চক্রবর্তীর সই-করা চিঠিতে বলা হয় যে, অতীতে বিশ্বভারতীর প্রাক্তন আচার্য জওহরলাল নেহরু, ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রতিভা পাতিল ও প্রণব মুখার্জি, আর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সহ আরও অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তি “জানলার এক পাশে” তৈরি করা সিটে বসেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ব্যবহার করতেন এমনই একটি সাদা কাপড়ে ঢাকা চেয়ারের সামনে দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধা জানাতেও দেখা যায় শাহকে।
৯ ডিসেম্বর, তৃণমূল কংগ্রেসের অফিসিয়াল টুইটার হ্যান্ডেল থেকে একটি টুইটের স্ক্রিনশট শেয়ার করা হয়। টুইটটি করা হয় বিজেপি4বেঙ্গল নামের টুইটার হ্যান্ডেল থেকে। তাতে নাড্ডার এক উক্তি উদ্ধৃত করা হয়, যাতে উনি বলেন যে, রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে জন্মেছিলেন। ওই স্ক্রিনশটের লেখাটিতে বলা হয়, “চিন্তা আদানপ্রদানের জন্য পশ্চিমবঙ্গ খ্যাত এবং বিশ্বভারতী হল রবীন্দ্রনাথের জন্মস্থান।” সেটিকে ভিত্তি করে তৃণমূল ভুল তথ্য দেওয়ার জন্য নাড্ডাকে কটাক্ষ করে এবং অভিযোগ করে যে, প্রচার করার জন্য বিজেপি বহিরাগতদের নিয়ে আসছে, যাঁরা রাজ্যের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নন। কিন্তু এটাও ছিল ভুয়ো খবর। বুম বিষয়টি যাচাই করে দেখে যে, নাড্ডা বলেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ পশ্চিমবঙ্গে জন্মগ্রহণ করেন।
কিন্তু বিতর্কিত খবরটি সত্যি না মিথ্যে— তা নিয়ে মাথা ঘামানোর অবকাশও অনেকের নেই। দেশ-বিদেশে এ রকম অজস্র নমুনা আছে। ‘বুম’ খতিয়ে দেখে জানিয়েছে এ রকম সাম্প্রতিক একটি ভুয়ো খবর, “ভোটে আতিক আহমেদ ইউপিএ-এর পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন।“ সংবাদ-গবেষকরা জানেন, বিভিন্ন সময় ভুল খবর কতটা প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। পরে রটে যাওয়া ভুল খবরের সঠিক নির্যাস প্রচারিত হলেও বহু মানুষের মনে গেঁথে যায় ভুয়ো খবরটাই।
পূর্ববঙ্গে হিন্দু নির্যাতনের বিস্তীর্ণ অধ্যায়েও বার বার এসেছে ভুয়ো খবর ছড়ানোর বিষয়টি। ১৯৪৬-এর নোয়াখালি দাঙ্গা, ১৯৫০-এর বরিশাল দাঙ্গা, ১৯৬৪-র পূর্ব পাকিস্তানের দাঙ্গা— এ সব নিয়ে চর্চা করতে গিয়ে পড়েছি ভুয়ো খবর ছড়িয়ে লোককে উত্তেজিত করে কীভাবে হিন্দুদের বেপরোয়া খুন ও আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করে দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উক্তি বলে একটি বাংলা দৈনিকের প্রথম পৃষ্ঠার প্রকাশিত শীর্ষ সংবাদে খুব বিপজ্জনক কথা ছড়ানো হয়েছিল। সেটি সামাজিক মাধ্যমে মাঝে মাঝেই ঘুরপাক খায়। খবরটি ভুয়ো। সম্প্রতি এই ভুয়ো খবর ছড়ানোয় আমি দু’জন প্রবীন, সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিকে ব্যক্তিকে ফেসবুকে ইনবক্সে সতর্ক করি। সরিয়ে নেওয়ার আবেদন করি। তাঁরা নির্বিবাদে সরিয়ে নিয়েছেন। অনেক ক্ষেত্রে এরকম আবেদনে বিপরীত দিকের ব্যক্তি তর্ক শুরু করেন। কটূ কথা বলেন। এই দুই ক্ষেত্রে তা হয়নি।
ভুয়ো খবর, ভুয়ো ছবি ভীষণভাবে মিশে গিয়েছে সঠিক খবরের সঙ্গে। বহু ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে মানুষ ওই ভুয়ো খবরই বিশ্বাস করছেন। এগুলো নিয়ে বিভিন্ন স্তরে আলোচনা, শিক্ষাশিবির শুরু হয়েছে। উদ্যোগী হয়েছে গুগুল, কলকাতা প্রেস ক্লাব- সহ নানা প্রতিষ্ঠান। আমি নিজেও একাধিক এরকম আয়োজনে শিক্ষার্থী হিসাবে শরিক হয়েছি। কিন্তু সার্বিকভাবে মানুষ কতটা সচেতন হবে, এটা একটা বড় প্রশ্ন।