
আমাদের ভারত, ১৩ মার্চ: লিচুর আদিনিবাস চিন, দক্ষিণ চিনের গোয়াংডং এবং ফুজিয়াং প্রদেশে আদি বাসভূমি। মায়ানমার হয়ে অসমের মধ্য দিয়ে ভারতে পৌঁছেছে লিচু, আমদানি করেছে ব্রিটিশরা। এদেশে লিচু চাষে সবচেয়ে অগ্রণী রাজ্য বিহার। বিহার ছাড়া পশ্চিমবঙ্গ ও উত্তরপ্রদেশ উল্লেখযোগ্যভাবে লিচু চাষ হয়। এছাড়া অসম, ওড়িশা, উত্তরাখণ্ড, পাঞ্জাব এবং অরুণাচল প্রদেশে লিচুর চাষ বেড়েছে।
১. লিচুর চাষ লাভজনক বলে প্রমাণ করেছেন মালদা ও মুর্শিদাবাদের চাষিরা। রাজ্যে যেমন আম চাষের রপ্তানি এলাকা আছে, তেমনি লিচু চাষের রপ্তানি এলাকাও তৈরি করা হয়েছে মালদা, মুর্শিদাবাদ ও নদিয়াকে কেন্দ্র করে। ভারতবর্ষের লিচু ইংল্যান্ড, নেদারল্যান্ড, ফ্রান্স, নেপাল প্রভৃতি দেশে রপ্তানি হচ্ছে। বহু দেশে সমাদৃত ‘লিচু-নাট’। বিশ্ববাজারে সংরক্ষিত লিচু পাঠাতে পারলে প্রচুর মুনাফা। লিচু-নাটের শাঁস ব্যবহার করা হয় কেক, বানরুটি ও নানান খাবার বানানোর জন্য। সারা বিশ্বের যে সমস্ত জায়গায় লিচু উৎপাদন হয়, তার মধ্যে ভারতে লিচু পাকে সবচাইতে আগে, তাই সবচেয়ে আগে বিশ্ব-বাজারে লিচু রপ্তানি করতে ভারত সক্ষম। যে দেশ আগে তার পণ্য বাজারে পাঠায়, রপ্তানি বাণিজ্য থেকে সে সবথেকে বেশি লাভবান হতে পারে। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করার জন্য প্রয়োজন উন্নতগুণ-সম্পন্ন লিচু ফলানো।
২. প্রশ্ন, লিচু চাষ করে কি পশ্চিমবঙ্গের চাষিরা সত্যিই লাভবান হতে পারবেন? এককথায় উত্তর, অবশ্যই পারবেন। লিচু চাষ আজ এক শিল্পের পর্যায়ে পৌঁছেছে, একটি ভৌমশিল্প। এ রাজ্যে লিচুর উৎপাদনশীলতা হেক্টরে প্রায় ১০ মেট্রিকটন। ফলে এক বিঘাতে উৎপাদন প্রায় তেরশো কেজি। যদি বাগান থেকে চাষি কুড়ি টাকা কেজি দরেও ফল বিক্রি করতে পারেন (যদিও বাজারে দাম ৮০ থেকে ১০০ টাকা কিলো), তাহলে এক বিঘা জমি থেকে ফল বেচে চাষি পাবেন প্রায় সাড়ে ছাব্বিশ হাজার টাকা। চাষের খরচ বিঘাতে প্রায় সাড়ে ছয় হাজার টাকা বাদ দিলে চাষির নিট লাভ থাকবে বিঘায় কুড়ি হাজার টাকা। এর সঙ্গে যদি সাথী-ফসল হিসাবে বাগান তৈরির প্রথম দফায় কিছু সবজি ও পরে কিছু মশলা যেমন আদা-হলুদ লাগানো যায়, তবে বিঘাতে অতিরিক্ত পাঁচ হাজার টাকা লাভ হবে। তবে মনে রাখতে হবে গাছের বাড়-বাড়ন্ত বেশি হলে ইচ্ছেমত সবজি চাষ করা সম্ভব হয় না। তাহলেও দেখা যাচ্ছে একবিঘা জমি থেকে সাথী-ফসল সমেত মোট আয় পঁচিশ হাজার টাকা। এটা প্রথাগত চাষ করে চাষি পেলেন। এবার তার সঙ্গে যদি নতুন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি যোগ করা যায়, তাহলে চাষের উৎপাদন কমপক্ষে পঁচিশ শতাংশ বাড়তে পারে, অবশ্য চাষের খরচও সামান্য বাড়বে। যদি এই পঁচিশ-ত্রিশ শতাংশ ফলন অধিক হয় তখন লাভের পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় একত্রিশ হাজার টাকা।
এই লাভের অঙ্কটা আসবে সাধারণভাবে ১০x১০ মিটার দূরত্বে লিচু গাছ লাগিয়ে হয়। এবার তার সঙ্গে যদি ঘন চাষ করা হয় (High density Orchard), তবে লাভের পরিমাণ আরও বাড়ে। দ্বি-বেড়া সারি (Double Hedge Row System) করে লিচু লাগালে; প্রথাগত পদ্ধতিতে যেখানে বিঘাতে ১৩ টি গাছ লাগানো সম্ভব হয়, দ্বি-বেড়া সারিতে বিঘাতে ২৯ টি গাছ লাগানো যাবে, অর্থাৎ ২২২ শতাংশ বৃদ্ধি। দ্বি-বেড়া সারিতে দুটি বেড়ার মধ্যের দূরত্ব থাকবে ৫ মিটার এবং বেড়া-সারিগুলির মধ্যে গাছের দূরত্বও ৫ মিটার হবে। দুটো বেড়া সারির মাঝে স্বাভাবিক দূরত্ব হবে ১০ মিটার। তারপর আবারও দুটি বেড়া সারি দিতে হবে। এই পদ্ধতিতে লিচু লাগালে এক বিঘাতে ৫০-৬০ হাজার টাকা চাষি লাভ করতে সক্ষম হবে।
৩. আমরা কৃষি বিষয়ক খনার বচনে লিচুর কথা পাই না। খনার বচন প্রায় ৮০০ থেকে ১০০০ বছরের পুরনো। ভারতবর্ষে লিচুর চাষটা খুব সম্প্রতি ২০০ বা ৩০০ বছর আগে এসেছে। তা সত্ত্বেও ভারতের জলবায়ুতে এই গাছটা নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে। কারণ ভারতবর্ষে এত বৈচিত্র্যময় জলবায়ু আছে, সেখানে কোনও না কোনও ফসল হবেই; এটাই ভারতবর্ষের বৈচিত্র্য। লিচু নির্দিষ্ট আবহাওয়াই পছন্দ করে। এর চাষের জন্য আর্দ্র নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া দরকার। যদি সঠিক আবহাওয়া লিচু না পায়, তাহলে গাছ ঠিকমতো বাড়ে না; লিচু ফল ধরে না; গাছ মরে যায়; গাছটিকে প্রাথমিকভাবে বাঁচানোই যায় না। ভারতবর্ষে যদি লিচুর চাষ করতে হয়, তার উপযোগী জলবায়ু-বৈশিষ্ট্যগুলি হবে: সেটি বরফ বা তুষারপাত মুক্ত অঞ্চল; গরম তাপপ্রবাহ বা লু-আবহাওয়া থাকা চলবে না; গরমকালের গরম বাতাস আটকাতে লম্বাজাতের উইন্ড-ব্রেক গাছ লাগাতে হবে। এমন গাছ সেক্ষেত্রে লাগানো দরকার, যেগুলি থেকে বাগানের অতিরিক্ত আয় সম্ভব। লিচু চাষে বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত হতে হবে ১২০০-১৫০০ মিলিমিটার, তবে তার কম বৃষ্টিপাতেও লিচু চাষ সম্ভব। কম বৃষ্টিপাত অঞ্চলে মাটিতে আর্দ্রতা ধরে রাখতে গোড়ার মাটি পাতা, খড় ইত্যাদি দিয়ে ঢেকে মালচিং করে দিতে হবে। গড় মাসিক তাপমাত্রা হবে ২০-৩০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। এরকম জলবায়ু ভারতবর্ষে রয়েছে। লিচু চাষের জন্য শীতকালে শুষ্ক আবহাওয়া থাকতে হয়; থাকতে হয় কাঁটা-লাগা শীত।
লিচু চাষের জন্য বেলে দোঁয়াশ বা এটেল দোঁয়াশ মাটি দরকার। নবীন পলি মাটি, বিশেষ করে ফারাক্কা, কালিয়াচকের মত এলাকায় গঙ্গার ধারের নবগঠিত পাললিক বেলে-দোঁয়াশ মৃত্তিকা লিচুর চাষের জন্য ভালো। মাটির ক্ষারাম্লমান বা পিএইচ ভ্যালু হতে হবে ৫.৫ থেকে ৬.৫ এর মধ্যে। মাটি যথেষ্ট গভীরতা থাকা দরকার, তাতে শিকড় মাটির গভীরে ছড়িয়ে যেতে পারে এবং উদ্ভিদ-পুষ্টি ও গাছের যান্ত্রিক দৃঢ়তার বিষয়টিও রক্ষিত হয়। মাটির লেয়ার বা স্তর অগভীর হলে লিচু গাছ লাগানো সমীচীন নয়। মাটির ভৌম-জলস্তম্ভ দেড়-দুই মিটার গভীরতার মধ্যে থাকা বাঞ্ছনীয়। যেখানে নতুন করে লিচু গাছ লাগানো হবে সেখানে পুরনো বাগানের কয়েক ঝুড়ি মাটি এনে গর্তে বিছিয়ে দিতে হয়। লিচু গাছের মূল ও মাটির কতিপয় ছত্রাকের সহাবস্থানের, মিথোজীবিতার মাইকোরাইজা সম্পর্ক তৈরি হয় প্রতিষ্ঠিত বাগানে; সেই উপকারী ছত্রাক-কলোনীকে আনা যায় এই মাটির মাধ্যমে।
৪. লাভজনক লিচু চাষ করতে হলে কোন জাতটি নির্বাচন করবেন? গুণমানে সর্বশ্রেষ্ঠ জাত বেদানা হলেও, ফলন কম। এ রাজ্যের সবচাইতে জনপ্রিয় জাতটির নাম ‘বোম্বাই’। এটি জৈষ্ঠ্যমাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে পাকে। ১৫ বছর বয়সী কলমের গাছে এর ফলন ক্ষমতা প্রায় ৮০-১২০ কেজি। জাতটি বড়সড়, উচ্চতা ২০-২২ ফুট, প্রায় ২২-২৬ ফুট ব্যাসের জায়গা জুড়ে বিস্তারিত থাকে। বোম্বাই জাতটির থোকা বড়, ফলগুলো হার্ট-সেপেড বা হৃদয়াকৃতি, খোসার রঙ উজ্জ্বল লাল। ফলের বোঁটায় ছোট্ট আর একটি ফল জুড়ে থাকে। ফলের ওজন প্রায় ১৯-২০ গ্রাম; বীজটি বড়সড়, প্রায় ৪ গ্রাম।
অর্থকরি লিচুচাষ করতে হলে বোম্বাই জাতের ভালো মা-গাছ সিলেকশন করে তার অঙ্গজ কলম করে নিতে হবে। বর্ষাকালে গুটিকলম করে লিচুর চারা তৈরি হয়। এক বছরের পেনসিল চওড়া নীরোগ বিটপের এক ফুট ডগা অংশ ছেড়ে দু’টি পর্বের মাঝে ২-৩ ইঞ্চি ছাল ছুরি দিয়ে তুলে ফেলতে হয়। তারপর ছুরি দিয়েই ছালের তলার পিছল ক্যাম্বিয়াম অংশটি চেঁছে তুলে দিতে হয়। এবার গোবর সার ও মাটির মিশ্রণ পরিমাণ মতো জলে মেখে মন্ড তৈরি করে নিয়ে তা কাটা অংশে মাকুর মতো জড়িয়ে, তার উপর পলিথিন দড়ি দিয়ে বেঁধে দিতে হবে৷ মাস খানেক বাদে তাতে শিকড় গজালে মা-গাছ থেকে চারাগাছ সিকেটয়ার দিয়ে কেটে পৃথক করে নিতে হবে। গুটি খুলে, পলিথিন সরিয়ে চারা গাছ নার্সারীতে যত্নে বসাতে হবে। পরে মূল জমিতে স্থানান্তরিত করতে হবে। চারা রোপন করতে হয় বর্ষাকালের শুরুতে। বেশী দেরী হলে পরে ঠান্ডার প্রকোপে চারাগাছ নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
৫. চারা লাগানোর আগে ২x২x২ ফুট গভীর গর্ত গ্রীষ্মকালেই করে নিতে হবে। সেখানে ২০ কেজি মতো গোবর বা কেঁচোসার, এক কেজি হাড়ের গুঁড়ো, ১ কেজি কাঠের ছাই, ২ কেজি পরিমাণ পুরোনো লিচু গাছের গোড়ার মাটি, ১০০ গ্রাম VAM (Vesicular arbuscular mycorrhiza) পরিবেশন করতে হবে। প্রথম ২/৩ বছর ধরে গাছের বৃদ্ধি কম হয়।
গাছ-প্রতি বছর প্রতি নাইট্রোজেন ফসফেট এবং পটাশ যথাক্রমে ১০০, ৫০ এবং ১০০ গ্রাম করে দু’বারে দিতে হবে। অর্থাৎ গাছের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সারের পরিমাণ বেড়ে যাবে৷ ৬ বছর পর থেকে প্রতি বছর ৬০০, ৩০০, এবং ৬০০ গ্রাম হারে নাইট্রোজেন, ফসফেট ও পটাশ সার দিতে হবে। সেচের ব্যবস্থা থাকলে ফল পাড়ার পর এবং গুটি ধরার পর দু দ’ফায় সার দিতে হবে। সেচের ব্যবস্থা না থাকলে ফল পাড়ার পর পুরো নাইট্রোজেন ও অর্ধেক পরিমাণ ফসফেট ও পটাশ সার দিতে হবে। বাকীটা দিতে হবে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে৷ মাটি অম্ল থাকলে মাত্রা মতো চুন প্রয়োগ করা দরকার। যেমন প্রথম বছর গাছ-প্রতি ৫০০ গ্রাম মতো চুন লাগবে।
চারা গাছে গ্রীষ্মকালে সপ্তাহে দু’দিন এবং শীতকালে ১০-১৫ দিন অন্তর সেচ দিতে হবে। ফল ধরলে ৭-১০ দিন অন্তর সেচ দেওয়া প্রয়োজন। ফল পাড়ার ১০ দিন আগে সেচ বন্ধ করে দিতে হবে। ফল ধরার পর নিয়মিত সেচ দিলে ফল ফেটে যাওয়ার সম্ভাবনা কমে।
গুটির বাড়-বৃদ্ধি করতে এবং গুটি-ঝরা রোধ করতে ফলের আকার মটর দানা এবং মার্বেল দশায় দু’দফায় এনএএ ২০-৩০ মিলিগ্রাম অথবা জিব্বারেলিক অ্যাসিড ২৫-৫০ মিলিগ্রাম অথবা ২,৪-ডি ১০ মিলিগ্রাম প্রতি লিটার জলে গুলে স্প্রে করতে হবে।
লিচুতে অনুখাদ্যের বিশেষ ভূমিকা আছে, বিশেষ করে ফল-ফাটা ও মরচে ধরার সমস্যা মোকাবিলা করতে। মুকুলে পুষ্প-লিঙ্গ-হার সঠিক রাখতে এবং ফল-ঝরা কমাতে ফুল ফোটার ১০-১৫ দিন আগে ০.৫% জিঙ্ক সালফেট স্প্রে করতে হয়। ফল ধরার ১৫ দিন পর ১৫ দিন অন্তর বোরাক্স ১.০% মাত্রায় ২-৩ বার স্প্রে করলে ফলের বৃদ্ধি সঠিক হয়, গোছায় ফলের ধারণ ক্ষমতা বাড়ে, ফল-ফাটা বন্ধ হয়, খোসা উজ্জ্বল রঙ ধারণ করে, ফলের মিষ্টতা বাড়ে এবং ফল আগে পাকে। এসব কারণে বাজারে ফলের দাম বেশি পাওয়া যায়, কৃষক লাভবান হয়৷
(অধিক জানতে যোগাযোগ করুন ICAR-AICRP on Fruits, BCKV, Mohanpur সেন্টারের মন্ডৌরীস্থ ফল গবেষণা কেন্দ্রে)