“আশা রাখি, এই কবন্ধ কালের সত্বর সমাপন, আমাদের আয়ুর সীমানার মধ্যেই দেখে যেতে পারবো“
অশোক সেনগুপ্ত
আমাদের ভারত, ১৫ এপ্রিল: যে বছর, আজ থেকে শুরু হলো, তাকে সাদরে স্বাগত জানাই। আমরা ভাঙনের মুখে দাঁড়িয়ে। চারিদিকে ভাঙচুর ও নির্মম নৈরাজ্যের নীরব দর্শক।
“দুঃখেরে দেখেছি নিত্য,
পাপেরে দেখেছি নানা ছলে ;
অশান্তির ঘূর্ণি দেখি
জীবনের স্রোতে পলে পলে ;”
বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন এই ভাবনার কথা জানালেন বরিষ্ঠ শিক্ষাবিদ সুদিন চট্টোপাধ্যায়। পশ্চিমবঙ্গ উচ্চ শিক্ষা পর্ষদের প্রাক্তন সভাপতি, মধ্যশিক্ষা পর্ষদের প্রাক্তন সম্পাদক, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন পরীক্ষাসমূহের নিয়ামক সুদিনবাবু এই প্রতিবেদককে জানালেন, “পুত্র বিদেশে। আমারও বয়স হয়েছে। স্ত্রী চিকিৎসক। আজও বাইরে গিয়েছেন। আর আমি ডুবে আছি লেখাপড়ার মধ্যে। নববর্ষ বলে কোনও বৈচিত্র নেই।“
কী পড়ছেন, কী লিখছেন— এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “এগরা থানার ইতিবৃত্ত— অতীত ও বর্তমান’ নামে একটি বই পড়ছি। ৮৩০ পৃষ্ঠার বই। লেখক হরিশ্চন্দ্র দাস। বইটা রিভিউ করতে হবে। গত কয়েকদিনের মত আজও ওই বইয়ে ডুবে ছিলাম।
সন্ধ্যায় বারাসতে উৎসবে আমন্ত্রণ আছে। ইচ্ছে আছে যাওয়ার। এ ছাড়া খুব একটা বৈচিত্র্য, রঙ নেই। ভাবনার মধ্যে যদিও রয়ে গিয়েছে নানা বিষয়।
পুরাতন ক্লান্ত বরষের সর্বশেষ গান। তবু আশা রাখি, এই কবন্ধ কালের সত্বর সমাপন, আমাদের আয়ুর সীমানার মধ্যেই দেখে যেতে পারবো। ধ্বংসে চূর্ণ ধরাতলে দাঁড়িয়েও কবি তো ভাবতে পেরেছিলেন, “রাত্রির তপস্যা সে কি আনিবে না দিন ?”
আগামীর সম্পর্কে এই টুকু ‘আশা’ রেখে, আশঙ্কা, ত্রাস ও পতনে সমাপ্ত পুরনো, ফেলে আসা, ক্লান্ত বছরের সর্বশেষ সঞ্চয়গুলো, বরং আজ , নববর্ষের পুণ্য প্রভাতে, নেড়েচেড়ে দেখি। রবীন্দ্রনাথেই প্রত্যাবর্তন,স্মরণ করিয়ে দিই অতীতের এইরকমই এক নববর্ষে কবির খেদ আর শপথের কথা :
“নব বৎসরে করিলাম পণ
লব স্বদেশের দীক্ষা….
পরের বুলিতে তোমারে ভুলিতে দিয়েছি
পেয়েছি লজ্জা ।।
সে-সকল লাজ তেয়াগিব আজ,
লইব তোমার দীক্ষা ”
‘পরের বুলি,…. হীনমন্যতায় নত হয়ে ইংরেজি ভাষার দাসত্বের ধূলি মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলার দীক্ষা নিতে চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। স্বাধীনতার সত্তরটা বছর পার করেও কী পরিকীর্ণ জঞ্জাল দেখছি চারাদিকে !
নিজের মুখের ভাষা, মায়ের ভাষার প্রতি কী বিপুল অবহেলা ! আমার ‘মেসেঞ্জারে’ রোজ সকালে অন্তত ১০০টি ‘শুভ সকালের’ বার্তা আসে, যার ৯০ টি ইংরেজিতে লেখা ‘গুড মর্ণিং’। কী লজ্জা ! এঁরাই ভাষা দিবসে কৃত্রিম কান্না ও ভাষাপ্রেমে ফেসবুক ভাসিয়ে দেন। অথচ আমার এক জার্মান বন্ধু ‘গুটেন মর্গেন’ জানান, আমার বুঝতে অসুবিধে হয় না, শ্রদ্ধান্বিত হই তাঁর আত্মপরিচয়ের সঙ্গে লিপ্ত আপন ভাষার প্রতি আনুগত্যে। এক নেপালি অধ্যাপক বন্ধু কখনও ভুলেও আমায় ‘গুড মর্ণিং’ বলেননি। প্রত্যহ সকালে ঘুম থেকে ওঠার আগেই তাঁর বার্তা পৌঁছে যায়, ‘নমস্তে, শুভ্ দিঅঁসো’। এ তো গেলো একটা দিক।
বাংলার এপারে ওপারে ভাষার শরীরে নির্যাতনের ক্ষত চিহ্ন দেখে আতঙ্কিত হই। এপারে হিন্দির বোধবুদ্ধিহীন এবং ওপারে আরবির ধর্মাচ্ছন্ন বুলির নিয়ত অনুপ্রবেশে বাংলা ভাষার নিজস্বতা বিপন্ন। ভাষার আপন লাবণ্যও প্রতিহত । একথা ঠিক, প্রাণবন্ত ভাষা নিজেকে প্রতিমুহূর্তে সম্প্রসারিত করে এগিয়ে চলে, আত্মস্থ করে নেয় অন্য ভাষার শব্দসম্পদও। কিন্তু স্বীয় ভাষা কাঠামো এবং তার সহজাত স্রোতশীলতা ও লালিত্যকে বিসর্জন দিয়ে নয়। এর সঙ্গে বাংলা বলতে গিয়ে পদে পদে হোঁচট এবং ইংরেজিতে আশ্রয় নেওয়া তো আছেই।
আসুন, নতুন বছরে এর পরিবর্তন প্রার্থনা করি, বাংলা ভাষাকে গর্ব, আদরে, বুকে নিয়ে দৃঢ়তায়, উন্নত মস্তকে বলি :
“মা, তোর মুখের বাণী
আমার কানে লাগে সুধার মতো,
মরি, হায় হায় রে …”
ইংরেজির প্রতি আমার কোনো অপরাগ নেই। এ ভাষার অসীম ঐশ্বর্য অস্বীকার করবে কে ? পড়াশোনায়, পড়ানোয় আমি নিজেও তো এ ভাষায় আশ্রয় নিয়েছি, কিন্তু কোনোভাবেই ‘আমার’ ভাষাকে আহত অসম্মান করে নয়।
সামাজিক মাধ্যমে সকালেই লিখেছি, “পুরনো বছরের ক্লেদাক্ত কঙ্কালের ওপর নতুন বছরের সূর্যালোকিত সকাল এলো। দুঃখ, দুর্দশা ও দুর্যোগের অন্ধকার অবসান করে এ সকাল সোনালী সম্ভাবনার কোনো ইঙ্গিত বয়ে আনবে কী ?
“নববর্ষ এল আজি
দুর্যোগের ঘন অন্ধকারে;
আনে নি আশার বাণী,
দেবে না সে করুণ প্রশ্রয়।”
দ্বিধা, দ্বন্দ্ব, দুঃস্বপ্নে দীর্ণ নববর্ষ-এর অভিনন্দন আপনাদের সকলকে। ভালো থাকুন। আনন্দ ও ভালোবাসায় থাকার চেষ্টা করুন।