স্বাধীনতা – অর্জিত না পড়ে পাওয়া

সন্দীপা বসু
আমাদের ভারত, ১৫ আগস্ট: ভারতের স্বাধীনতা ঠিক কতটা অর্জিত আর কতটাই বা পড়ে পাওয়া? স্কুলপাঠ্য ইতিহাসে বহু পাতা জুড়ে যে একটি মাত্র সংগঠনের অহিংস স্বাধীনতা আন্দোলনের কথা আমাদের শেখানো হয়েছে, বোঝানো হয়েছে যে মূলত তাদের নিরলস আন্দোলন, আত্মত্যাগ ও প্রচেষ্টার ফলে ভারতের স্বাধীনতা এসেছে, সেটাই বা কতটা সত্য? যদিও এর পাশাপাশি ছোট করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিচ্ছিন্ন কিছু বৈপ্লবিক আন্দোলনের কথাও উল্লেখ করা হয়, তবুও প্রশ্নটা সেই একই থেকে যায়।

অস্বীকারের উপায় নেই যে কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া বিপ্লবী আন্দোলনের জ্বালাময়ী রূপ ভারতের মূলত তিনটি জায়গায় দেখা গেছে – বাংলা, পঞ্জাব এবং মহারাষ্ট্র। কিন্তু সব মিলিয়েও অর্থাৎ, স্বাধীনতার উদ্দেশ্যে ভারতে অহিংস, সহিংস, দলমত নির্বিশেষে যত রকম আন্দোলনের ঘটনা ঘটেছে, কোনওটাই কি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সব থেকে বড় এবং সব থেকে বেশি লাভজনক একটি উপনিবেশ ছেড়ে দিয়ে চলে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল?

এমনকি ১৯৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ, যা কিনা ব্রিটিশ শাসনকালের সর্ববৃহৎ উত্থান বলে বহু ঐতিহাসিক মনে করেন, সেই বিদ্রোহও কিন্তু শেষ পর্যন্ত দমন করা হয়েছিল। ভারত ছেড়ে যাওয়ার কথা কিন্তু তখন তাদের দূরতম কল্পনাতেও আসেনি। এর পর স্বদেশী আন্দোলনের যুগে যত বৈপ্লবিক ঘটনা ঘটেছে, যার সিংহভাগ সীমাবদ্ধ ছিল বাংলাতেই, সেগুলিও দমন করা ব্রিটিশের পক্ষে কখনই খুব কঠিন কিছু হয়নি। কিছু ক্ষেত্রে তুলনামূলক কোনও বড় বিদ্রোহের ঘটনা ঘটলে, তাকে দমনের জন্য ব্রিটিশের অমানবিক অত্যাচারের প্রতিবাদে হয়ত আরও কিছু ছোট ছোট ঘটনা ঘটত। কোনও ক্ষেত্রে তাদের নিজেদের দেশেও সমালচনার মুখে পড়তে হত, যেমনটা ঘটেছিল জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ডের পর এবং সেক্ষেত্রে জেনারেল ডায়ারের কিছু শাস্তি হলেও শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশের মূল উদ্দেশ্য, নিজেদের ক্ষমতা কায়েম রেখে ব্যবসা, সম্পদের হরণ – কোনও কিছুতেই কোনও সমস্যা হয়নি। যেখানে যা কিছু স্বদেশী আন্দোলনের ঘটনা ঘটেছে, তা সাময়িকভাবে, আঞ্চলিক স্তরে ব্রিটিশদের কিছুটা সমস্যা তৈরি করেছে মাত্র। দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা তারা ভাবেনি। তাই যখন আমরা বলি – এই স্বাধীনতা আমাদের অর্জিত, তখন সেই কথায় কিছু মিথ্যা লেগে থাকে।

এখানে একটি কথা বলা আবশ্যক – এই লেখার মাধ্যমে কোনওভাবেই কোনও স্বাধীনতা সংগ্রামী, বিপ্লবী, তাঁদের আন্দোলন, আত্মত্যাগ অথবা দেশের জন্য জীবনদানকে ছোট করে দেখানোর চেষ্টা করা হচ্ছে না। সে ধৃষ্টতা আমার নেই। এক অসম শক্তির লড়াইতে, নিজেদের সীমিত ক্ষমতায় তাঁরা যে বীরত্বের প্রমাণ রেখে গেছেন, আমাদের প্রতিটি রক্তবিন্দু তাঁদের কাছে কৃতজ্ঞ। নত মস্তকে প্রণাম জানাই তাঁদের।

আবারও স্মরণ করিয়ে দিই আমার প্রশ্ন আমাদের সামনে যে ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে এবং যেভাবে তুলে ধরা হয়েছে, তার অর্ধসত্যতা নিয়ে।

ভারতের ঠিক পরে পরেই স্বাধীনতা পেয়েছিল বেশ কয়েকটি দেশ। ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা পায় শ্রীলঙ্কা ও মায়নমার। এর পর একে একে কিনিয়া, মালদ্বীপ, মরিশাস, মালটা, মালয়েশিয়া। এই সমস্ত দেশে স্বাধীনতা সংগ্রামের তেমন কোনও বড় ঘটনা বা উল্লেখযোগ্য কোনও ইতিহাস নেই। তবুও তারা স্বাধীনতা পেয়েছিল প্রায় একই সময়কালে। ভারতকে যা অর্জন করতে হল এরা সেই একই বস্তু উপহারে পেল? না কি অন্য কোনও কারণে সেই সময় উপনিবেশগুলিকে স্বাধীনতা না দিয়ে উপায় ছিল না ব্রিটিশের?

এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে ভারতের বাইরে তাকিয়ে। ছয় বছর ধরে চলা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং তার ফলে ইংল্যান্ডের পরিস্থিতির দিকে দেখতে হবে। তখন ইংল্যান্ড আর সর্ব শক্তিমান নেই। যুদ্ধ বিধ্বস্ত, আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত একটি দেশ যে ক্রমেই দেউলিয়া হয়ে এসেছে। তাদের সর্ববৃহৎ উপনিবেশ, এই ভারত থেকে তাদের নেওয়ার মত আর কিছুই সেই মুহূর্তে অবশিষ্ট নেই। ভারতে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে সিংহভাগ এই দেশেরই মানুষ ছিল। তাদের তো বটেই, আরও বহু সাধারণ মানুষকে ধরে বিভিন্ন প্রান্তে যুদ্ধ করতে পাঠানো হয়েছিল। সর্বমোট পঁচিশ লক্ষ মানুষ এই দেশ থেকে তাদের হয়ে লড়তে গিয়েছিল। যুদ্ধে অনভিজ্ঞ এই সকল মানুষরা একটা সময়ের পর আর যুদ্ধ করতে রাজি হচ্ছিল না। দেশে ফিরতে চাইছিল। বাড়ছিল অসন্তোষ। শুধু এরাই নয়, ভারতীয় নৌসেনার যে বিরাট দলটিকে জার্মানির সঙ্গে যুদ্ধরত ব্রিটিশ সেনার সুরক্ষার জন্য ফক আইল্যান্ডে পাঠানো হয়েছিল, অসন্তোষ বাড়ছিল তাঁদের মধ্যেও।

অন্যদিকে ক্ষোভ বাড়ছিল এই দেশের মধ্যেও। ১৯৪৩ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের কথা আলাদা করে বলার প্রয়োজন নেই। পরবর্তীতে ঐতিহাসিক এবং গবেষকরা বারেবারেই স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন এই দুর্ভিক্ষ অনাবৃষ্টি বা অন্য কোনও প্রাকৃতিক কারণে হয়নি, খাদ্যের অসম বণ্টন বা বলা ভালো যুদ্ধের রসদ হিসাবে চালান যাওয়ার ফলে হয়েছিল। এর পেছনে ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলের ভূমিকার কথা কম বেশি আমরা সকলেই জানি। ভারতে তখন খাদ্যের আকাল, জ্বালানীর আকাল। সেই সময় ব্রিটিশ পার্লামেন্ট থেকে একটি রিপোর্টে বলা হয়েছিল যে, ভারতে উপনিবেশ রাখা কোনওভাবেই আর লাভজনক নয়।

এমন পরিস্থিতির মাঝেই পূর্ব প্রান্ত থেকে তখন চাপ দিচ্ছে জাপান। তাদের সহায়তায় মায়ানমারের দিক থেকে ঢুকে আসছেন নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোস ও তাঁর আজাদ হিন্দ বাহিনী। ভারতের বন্দরগুলি ছাড়া পূর্ব এশিয়ার দিক থেকে সমস্ত বন্দর হাতছাড়া হয় ব্রিটিশের। অন্যদিকে আফ্রিকার উপকুলে বেশিরভাগ ব্রিটিশ উপনিবেশ জার্মান অথবা ইটালির উপনিবেশ দিয়ে ঘেরা ছিল। ফলে সেখানেও তাদের অবস্থা খুব একটা সুবিধাজনক জায়গায় ছিল না। নিজেদের উপনিবেশগুলির ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ অনেকটাই শিথিল হয়ে পড়ে। সেই সময় উত্তর আফ্রিকার দিকে ইটালির সঙ্গে সংঘর্ষে প্রাথমিকভাবে ব্রিটিশ খানিকটা সুবিধাজনক অবস্থায় পৌঁছলেও অল্প সময়ের মধ্যে সে পরিস্থিতিও উল্টে যায়। জার্মানির হাতে সেখানেও তাদের পর্যুদস্ত হতে হয়। জার্মান ইউ বোট সেই সময় দাপিয়ে চলেছে ঐ অঞ্চলের জলপথ। যে কোনও সময় সুয়েজ ক্যানেল হাত ছাড়া হয়ে যাওয়ার ভয় কাজ করছে তখন ব্রিটিশের মনে। উত্তমাশা অন্তরীপ পেরিয়ে, অতলান্তিক ও ইংলিশ চ্যানেল হয়ে যাতায়াত স্বভাবতই অত্যন্ত ব্যায়বহুল ও সময়সাপেক্ষ হয়ে পড়েছিল।

সেই সময় ব্রিটেনের মূল ভূখণ্ডের চিত্রটা কেমন ছিল? জানা যায় ব্রিটেনের সমস্ত পুলিশ ফোর্সকে যুদ্ধে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ম্যাঞ্চেস্টার, লিভারপুল, বার্মিংহাম ইত্যাদি বড় বড় শহরগুলিতে কোথাও কোনও পুলিশ ছিল না। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি ঘটতে থাকে। একইসঙ্গে সে দেশের মাটিতেও তৈরি হতে থাকে যুদ্ধবিরোধী জনমত। সব মিলিয়ে ব্রিটেনের অবস্থা তখন সঙ্গীন। সে আর পৃথিবীর বড় শক্তিগুলির মধ্যে একটি ছিল না। সে দেশ তখন সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাওয়া একটা দেশ। মূল শক্তি হয়ে উঠেছিল, যেমন অবশ্যই আমরা সবাই জানি, ওদিকে আমেরিকা ও এদিকে রাশিয়া। শক্তির ভরকেন্দ্র চলে গিয়েছিল এই দেশগুলির হাতে। উত্থান ঘটছিল বাম শক্তিগুলির। সেই সময় রাশিয়ার হাতে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হল জার্মানির মত বিপুল শক্তি। যাদের হাতে ব্রিটেন বার বার পর্যুদস্ত হয়েছে, তাদের এমন শোচনীয় পরাজয় ব্রিটিশের মনে ভয় ধরাল।

ওপরে উল্লেখিত সমস্ত বিষয়ের থেকেও ভারতের তথা বাকি সমস্ত উপনিবেশগুলির স্বাধীনতার পেছনে সব থেকে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল আটলান্টিক চার্টার। ১৪ জুলাই ১৯৪১ -এর প্রকাশিত হওয়া এই চার্টার-এ যে বিষয়গুলির ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল তার মধ্যে আজকের আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে একটি পয়েন্ট উল্লেখযোগ্য। সেটি হল চার্টারের ৩ নম্বর পয়েন্ট, যেখানে বলা ছিল – কোনো স্বনির্ভর জাতি তার জনগণের ইচ্ছা অনুসারে স্বাধীন সরকার গঠন করতে পারবে ((right to self-determination)।

এই পয়েন্টে সব থেকে বেশি বিরোধিতা এসেছিল মিত্র শক্তির ভেতর থেকেই, যেমন ব্রিটেন। স্বভাবতই তারা আপত্তি জানিয়েছিল সব থেকে বেশি। শুরুতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট ও ব্রিটিশ প্রধান মন্ত্রী চার্চিল এই ব্যাপারে ঐক্যমত্য পোষণ করেছিলেন যে এই তৃতীয় পয়েন্টটি আফ্রিকা ও এশিয়ার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না। কিন্তু ততদিনে ভারত, মালয়েশিয়া, মায়নমার (তৎকালীন বর্মা) সহ একাধিক এশিয়ান দেশ প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছে যে এই চার্টার প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল, তথা সমগ্র এশিয়ার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হবে কিনা। কিন্তু সেই সময় যুদ্ধ চলছে এবং মূলত এই অঞ্চল থেকেই সৈন্য এবং খাদ্য সহ যুদ্ধের অন্যান্য রসদ সরবরাহ হয়ে চলেছে। কাজেই যতদিন না যুদ্ধ শেষ হচ্ছে অন্তত ততদিন এই অঞ্চলকে সরকার গঠনের অধিকার দেওয়া উচিত হবে না বলে রুজভেল্টও মনে করেছিলেন। এই প্রসঙ্গে মনে রাখতে হবে ভারত থেকে ২৫ লক্ষ সৈন্য যুদ্ধে গিয়েছিল, এত লোক অন্য কোনও দেশ থেকেই যায়নি।

ঐতিহাসিক ক্যারোলিনা এলকিন্সের মতে স্বাধীনতার ইচ্ছার বোতলবন্দী দৈত্য তখন মুক্ত হয়েছে। আর তাকে মুক্তি দিয়েছিল আটলান্টিক চার্টার (“The independence genie was out of her bottle and it was the Atlantic Charter that had set her free”)। চার্চিল ভারতের স্বাধীনতার সম্পূর্ণ বিরোধী ছিলেন। ১৯৪১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এক বক্তৃতায় তিনি বলেন, এই চার্টার শুধুমাত্রই জার্মানির উপনিবেশগুলির জন্য প্রযোজ্য। ব্রিটিশ উপনিবেশের জন্য নয়। কারণ ব্রিটিশের কোনও উপনিবেশেই সেখানকার মানুষদের কাছে কোনওরকম সার্বভৌমত্ব নেই। কাজেই এমন কোন সার্বভৌম সংগঠনও নেই যাদের হাতে যুদ্ধের পর ক্ষমতার হস্তান্তর করা যেতে পারে।

অন্যদিকে, ইতিমধ্যেই ১৯৪২ সালে বিশ্বের পূর্ব প্রান্তে সিঙ্গাপুরে জাপানের কাছে ইংল্যান্ডের শোচনীয় পরাজয় হল। ভারতে পরিস্থিতি সামাল দিতে আমেরিকান টমিদের আগমন ঘটল। ফলে মানুষের মনে ব্রিটিশ শক্তি অজেয় বলে যে উচ্চ ধারণা ছিল, সেই ধারনায় বড়সড় ধাক্কা লাগল। তারা বুঝতে পারল ব্রিটিশ সর্বশক্তিমান ভগবান নয়। এই সময় ভারতে উত্থান ঘটছিল আরএসএস, মুসলিম লিগ প্রভৃতি দলগুলির। এদের সদস্য সংখ্যাও নগন্য ছিল না। এই দুটি দলের প্রত্যেকের সদস্য সংখ্যাই এক লাখের কাছাকাছি ছিল। শিরোমণি আকালি দলের সদস্য সংখ্যাও ছিল এর কাছাকাছি। উল্লেখযোগ্য, এই দলগুলির কোনটিই আবেদন, নিবেদনে বিশ্বাস করত না। জাপানের হাতে ব্রিটিশ পর্যুদস্ত হওয়ার পর এই দলগুলির আরও বেশি করেই শক্তিবৃদ্ধি হতে থাকে। ফলে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে।
এর পরেই ইংল্যান্ডে ঘটে যায় রাজনৈতিক পালাবদল, যার ফলে সম্পূর্ণ বিষয়টাই উল্টো খাতে বইতে শুরু করে।

১৯৪৫ সালে ইংল্যান্ডের নির্বাচন। শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয় উইন্সটন চার্চিলের নেতৃত্বাধীন কনজারভেটিভ পার্টি। বিপুলভাবে জয়ী হয় লেবার পার্টি। প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন ক্লেমেন্ট অ্যাটলি। স্বভাবতই এই পার্টি আদর্শগতভাবে উপনিবেশ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ছিল। আটলান্টিক চার্টারের তৃতীয় পয়েন্ট সহ সমস্ত পয়েন্টগুলিই মেনে নিতে তাদের কোনও অসম্মতি দেখা যায়নি। তাছাড়া যুদ্ধবিরোধী মানুষের ভোটে জিতেই লেবার পার্টি ক্ষমতায় এসেছিল। যদিও চার্চিল ভারত ছেড়ে দেওয়ার পক্ষে ছিলেন না, কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের বিরোধিতা ও সমস্ত দেশের জনমত তাঁর মতের বিরুদ্ধে ছিল। কাজেই তাঁর ইচ্ছা আর প্রাধান্য পায়নি। ভারত সহ ব্রিটিশের বাকি উপনিবেশগুলির মুক্তির কারণ কিন্তু লুকিয়ে আছে এখানেই। ভারত ত্যাগের জন্য ব্রিটিশের এই যে দৃঢ় সংকল্প – এর পেছনে ভারতের প্রতি কোনও প্রেম অথবা ভারতবাসীর স্বাধীনতার জন্য লড়াই-এর প্রতি কোন সহানুভুতি অথবা ভয় ব্রিটিশের মনে কাজ করেনি।

এই জায়গায় এসে, আরও একটি বিষয়ের দিকে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইব। দেশ ভাগের জন্য আজ সর্বতোভাবে ব্রিটিশকে দায়ি করা হয়, সেটাও খানিকটা অর্ধ সত্যই বটে। শ্রী শঙ্কর ঘোষ তাঁর “হস্তান্তর” গ্রন্থের প্রথম খণ্ডে জানিয়েছেন ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত (ওয়াভেল-এর ব্রেক ডাউন প্ল্যান) ভারত ত্যাগের যত পরিকল্পনা করা হয়েছিল সেখানে কোথাও ভারত বিভাগের কোনও প্রস্তাব ছিল না। উল্টে সমস্ত আলোচনাতেই চেষ্টা করা হয়েছিল যাতে ভারতের অখণ্ডতা বজায় থাকে। ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনাতেও বহু বিতর্কিত গ্রুপিং-এর ব্যবস্থা থাকলেও অবিভিক্ত ভারতের ভাবনাই প্রাধান্য পেয়েছিল। এই মিশনের তিন সদস্যের একজন ছিলেন ভাইসরয় ওয়াভেল। তিনি বিভিন্ন কারণে গান্ধীকে চূড়ান্ত অপছন্দ করতেন। শ্রী ঘোষের মতে তিনি গান্ধীকে ‘মিথ্যাবাদী, ‘ভণ্ড’ ইত্যাদি বিশেষণে ভূষিত করেছেন এবং সবিশেষ দুর্বলতা দেখিয়েছেন মুসলিম লিগের প্রতি। জিন্নাকে তিনি পছন্দ করতেন। কিন্তু তিনিও জিন্নার দাবি মেনে ভারত ভাগ করে দুটো স্বতন্ত্র ডোমিনিয়নের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে যেতে চাননি।

ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনা বিফল হওয়ার পর যে নতুন পরিকল্পনা করা হয়েছিল তার নাম ছিল “ব্রেকডাউন প্ল্যান”। এই পরিকল্পনায় ভারতকে কয়েকটি অঞ্চলে ভাগ করে দক্ষিণ ভারত থেকে শুরু করে ক্রমশ সারা ভারত থেকে ব্রিটিশের সরে যাওয়ার কথা বলা হয়েছিল। বলা হয়েছিল এক একটি প্রদেশ ধরে সেখান থেকে প্রথমে নারী ও শিশু, তারপর অসামরিক প্রশাসন ও একেবারে শেষে সেনাবাহিনী অপসারন করার কথা। ওয়াভেলের মতে সেই সময় সামগ্রিকভাবে যা পরিস্থিতি ছিল তাতে এই পদ্ধতি ছাড়া উপায় ছিল না। কিন্তু কোনও রকম রাজনৈতিক মিমাংসা ছাড়া এই ভাবে ব্রিটিশ অপসারনের ফলে আইনশৃঙ্খলা ভেঙে পড়ার ও গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার সম্ভবনা ছিল প্রবল। সেক্ষেত্রে ওয়াভেলের যুক্তি ছিল এর ফলে ভারতভাগের দায় অথবা সংখ্যালঘুর স্বার্থ রক্ষা না করার দায় ব্রিটিশের ওপর পড়বে না। মনে রাখতে হবে এই সময় ১৯৪৬ সালে শুরু হয় নোয়াখালী দাঙ্গা। ক্রমশ দেশের অন্যত্রও তার আঁচ পড়ে। আইন শৃঙ্খলার অবনতি নিয়ে ব্রিটিশের দুশ্চিন্তার একমাত্র কারণ ছিল ভারতে ব্রিটিশ নাগরিকদের উপস্থিতি। ১৯৪৭ সালের মার্চ মাসে ভারতে অসামরিক ব্রিটিশ নাগরিকের সংখ্যা ছিল প্রায় ৭৩,০০০। এর মধ্যে প্রায় ৫০,০০০ মহিলা ও শিশু।

কিন্তু ইংল্যান্ডে অ্যাটলি-র নেতৃত্বাধীন লেবার পার্টি এই ব্রেকডাউন প্ল্যান মেনে নেননি। উল্টে এই পরিকল্পনায় বিরক্ত হয়ে তাঁকে বরখাস্ত করে অ্যাটলি সরকার। প্রধানমন্ত্রী অ্যাটলি ব্রিটিশ হাউস অফ কমনসে এক বিবৃতিতে ইঙ্গিত দেন ১৯৪৮ সালের জুন মাসের মধ্যে যদি সর্বদলীয় সম্মতিক্রমে ভারতের সংবিধান রচিত না হয় তাহলে ব্রিটিশ সরকারকে ভাবতে হবে কার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে, কোনও প্রাদেশিক সরকারের কাছে, নাকি অন্য কোনও উপায়ে যা কিনা ভারতের স্বার্থের পক্ষে সব থেকে অনুকুল হয়।

এই বিবৃতি থেকেই পরিষ্কার হয়ে যায় ১৯৪৮ এর জুনের মধ্যে সংবিধান রচিত না হলে ভারত ভাগ অনিবার্য হয়ে পড়বে। এই সময়সীমা স্থির করা হয় লর্ড মাউন্টব্যাটেনের পরামর্শে। ১৯৪৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মাউন্টব্যাটেন ভাইসরয় পদে নিয়োজিত হন। তাঁর মনে হয়েছিল সময়সীমা বেঁধে না দিলে ভারত কোনও দিনই ঐক্যমত্যে পৌঁছতে পারবে না। কিন্তু ভারতে পৌঁছে তিনি বুঝেছিলেন ওই সময়সীমা অনেকটাই দেরী হয়ে যাবে। এ’দেশে পরিস্থিতি ইতিমধ্যেই অত্যন্ত খারাপ এবং আইন শৃঙ্খলার এমন অবস্থা যে ব্রিটেনের সীমিত প্রশাসনিক ক্ষমতায় যে কোনও সময় তা ভেঙে পড়তে পারে। অন্যদিকে মুসলিম লিগ গণপরিষদ বর্জন করায় সেখানে যে সংবিধানের কাজ চলছিল তাতে তাদের সম্মতির প্রশ্নই ছিল না। কাজেই ভারত ভাগের সম্পূর্ণ দায় হয়ত ব্রিটিশের ওপর দেওয়া যায় না।

যদিও এই প্রসঙ্গে সম্পূর্ণভাবে লিখতে গেলে যে পরিমাণ বিষয় উঠে আসবে, এই পরিসরে তার জন্য স্থান সঙ্কুলান সম্ভব নয়। তাই সংক্ষেপে এটুকুই বলার যে, আজ যখন ইতিহাসকে তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে দেখা হচ্ছে, ব্যক্তিগত মাতমত এবং বিশেষ উদ্দেশ্যে তাকে নিজের মতো করে গড়ে নেওয়ার বিরুদ্ধে যাচ্ছেন কিছু ঐতিহাসিক এবং গবেষক, তখন সত্যকে আমাদের সহজে গ্রহণ করা প্রয়োজন। দেশকে স্বাধীনতা এনে দেওয়ার উদ্দেশ্যে যে দলটি গঠন করা হয়েছিল, স্বাধীনতার পর যখন যুক্তিসঙ্গতভাবেই সেই দল ভেঙে দেওয়ার কথা উঠল, প্রস্তাব এলো নতুন নামে নতুন দল গঠন করার, তখন শুধুমাত্র রাজনৈতিক ফায়দা তোলার উদ্দেশ্যে সেটি করতে দেওয়া হয়নি। সাধারণ মানুষকে বোঝানো হয়েছে শুধুমাত্র তাদের আন্দোলনের ফলেই ব্রিটিশ ভারত ছেড়ে গেছে। দেশের মানুষের জন্য স্বাধীনতা অর্জন করে এনে দিয়েছে তারাই। সাধারণ মানুষের আবেগ পরিবর্তিত হয়েছে ভোটবাক্সের ফুলেফেঁপে ওঠায়।

তবে কথায় আছে গতস্য শোচনা নাস্তি। বরং বিগত সময়ের থেকে শিক্ষা নিয়ে আজ এবং আগামীকে আরও সচেতন ও শক্তিশালী করে গড়ে তোলাই উদ্দেশ্য। আর সেই কারণেই আজ স্বাধীনতার ৭৫ বছর পর হয়ত আমাদের সত্যটাকে জানা, জানানো এবং স্বীকার করার সময় এসেছে। অর্ধ সত্য নয়, মানুষের সামনে আসুক পূর্ণ সত্য।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *