‘ফল বৈচিত্র্য মেলা’ হল বিধান চন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে

মিলন খামারিয়া
আমাদের ভারত, ১৭ জুন, কল্যাণী: ভারতীয় কৃষি অনুসন্ধান পরিষদ (ICAR)-এর অধীনে সর্ব-ভারতীয় সমন্বিত ফল গবেষণা প্রকল্প (AICRP ON FRUITS) একটি বিশেষ এবং সফল গবেষণা প্রকল্প। সারা ভারতের নানা প্রান্তে, নানান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে এই প্রকল্পের শাখাকেন্দ্র রয়েছে। তার মধ্যে কল্যাণীর মোহনপুরে অবস্থিত বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা কেন্দ্র অন্যতম।

প্রায় চৌত্রিশ বছর ধরে এখানে চলছে গবেষণার নানান কাজ, কোনোটা ফলের উন্নয়ন ও মান-বৃদ্ধি সংক্রান্ত, কোনোটা ফলনবৃদ্ধির নানান প্রকৌশল সম্পর্কিত, কোনোটা বৃদ্ধি ও পরিস্ফূরণ বিষয়ক, আবার কোনোটা ফসল সুরক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ আঙ্গিক। এক্ষেত্রে মূল ফসল হিসেবে নেওয়া হয়েছে কলা, আম, কাঁঠাল, লিচু ও পেয়ারার মতো জনপ্রিয় ফলগুলি। তার বাইরেও অজস্র ফল নিয়ে তাদের কাজকর্ম।

গবেষণালব্ধ ফলাফল নিয়মিত কৃষকের মাঠে পৌঁছে দিতে এই প্রকল্পের বিজ্ঞানীরা সবসময় তৎপর। এইজন্য প্রকল্পের অধীনে নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করা হয়ে থাকে। কৃষকদের উৎসাহিত করতে এইবছর তাদেরই বিশেষ উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হল ‘ফল বৈচিত্র্য মেলা বা Fruit Diversity Festival’। উদ্দেশ্য গবেষণা খামারে উৎপন্ন নানান প্রজাতির ও নানান জাতের ফলের উৎপাদন, গুণমান এবং লাভের অঙ্কগুলি কৃষকের কাছে পৌঁছে দেওয়া, যাতে কোন জাতটি অর্থকরীভাবে চাষ করবেন কৃষক, সে বিষয়ে স্বচক্ষে দেখে নিজেরা সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।

সেই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই আজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সর্ব-ভারতীয় ফল-গবেষণা কেন্দ্র’-এর পক্ষ থেকে ‘ফল বৈচিত্র্য মেলা’র আয়োজন করা হয়েছিল। পূর্ব বর্ধমান, নদিয়া, হাওড়া, হুগলি, মুর্শিদাবাদ, উত্তর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার চল্লিশ জন ফলচাষী তাদের উৎপাদিত ফল নিয়ে আজ উপস্থিত ছিলেন।

পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীদের গবেষণার দ্বারা উৎপন্ন বিভিন্ন প্রকারের ফলও মেলাতে রাখা হয়েছিল; বিশেষ করে – আম, কলা, কাঁঠাল, পেয়ারা, সবেদা, ড্রাগন, ফলসা, চেরি, করমচা, জামরুল, কামরাঙা, আঙুর প্রভৃতি ফল। এদের মধ্যে আমের বৈচিত্র্য ছিল দেখার মতো।

হিমসাগর, সুজাতা, গোলাপ খাস, সরি, ল্যাংড়া, বোম্বাই, আলফান্সো, চৌষা, সন অফ গোল্ড, পুশা অরুনিমা, রেড পালমার, সুর, ব্যানানা কিং, বগলসা, মল্লিকা প্রভৃতি ৮৯ জাতের আম রাখা হয়েছিল এই প্রদর্শনীতে।

এদিনের মেলাতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিধান চন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক(ড.) বিকাশ চন্দ্র সিনহা মহাপাত্র। আজকের প্রদর্শনী সম্পর্কে তিনি জানান, “আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ফল-গবেষণা কেন্দ্র খুব ভালো কাজ করছে। তাদের উদ্যোগে এই ফল-মেলার আয়োজন বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। মানুষের পুষ্টির কথা বিবেচনা করে বিভিন্ন প্রকারের ফল চাষের প্রশিক্ষণ দিয়ে বেশি মাত্রায় ফল-চাষের জন্য কৃষকদের উৎসাহিত করা উচিত। পাশাপাশি এমন ফল মেলার আয়োজন বেশ বৈচিত্র্যপূর্ণ ও অভিনব।”

প্রকল্প আধিকারিক অধ্যাপক দিলীপ কুমার মিশ্র জানান, “বিভিন্ন প্রকারের ফল সম্পর্কে মানুষকে জানাতে ও ফল চাষে উৎসাহিত করার জন্যই আমাদের এই ‘ফল-মেলা’ আয়োজন করার মূল উদ্দেশ্য।”

কথায় বলে “দেখাদেখি চাষ, লাগালাগি বাস।” আজকের এই মেলার মাধ্যমে ফলবিলাসীরাও পছন্দের জাতগুলি নিজে চিনতে সক্ষম হবেন। বাগানবিলাসীরা এবং চারাকুশলীরা জাতগুলি প্রকৃষ্টরূপে শনাক্তকরণ করতে সক্ষম হবেন। পাশাপাশি গৌণফল বা Minor fruits যে-গুলি বাজারে কম আসে, সংগঠিত চাষাবাদ প্রায় হয় না বললেই চলে, অথচ নানান গুণমানে ভরপুর এই মণিমাণিক্যগুলি। তাদের চাষাবাদ বৃদ্ধি করাও কৃষি বিজ্ঞানীদের উদ্দেশ্য।

বাংলায় একটি প্রবাদ আছে “বারোমাসে বারো ফল/না খেলে যায় রসাতল।” নীরোগ এবং সুস্থজীবন নিয়ে বসবাস করতে গেলে আমাদের পুষ্টিদায়ী ফল নিয়মিত গ্রহণ করতে হবে।

আর তা সারাবছর ধরেই গ্রহণ করার দরকার কিন্তু সব ফল সারা বছর মেলে না। কিছু ফলের ফলন মরশুম নির্দিষ্ট কয়েকমাস মাত্র। তাই আম, জাম, কুল, ফলসা, আশফল ইত্যাদি ফল’কে প্রক্রিয়াকরণ করে যাতে সারাবছরই সুলভ করে তোলা যায়, সেই বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে মানুষকে ভাবানোর জন্য উপস্থিত ছিল ‘পরশ’। তারা চাটনি, আচার, আমসত্ত্ব, জ্যাম, জেলি, জুস, মোরব্বা, পেঠা করে ফল’কে সংরক্ষণ করে দীর্ঘদিন মানুষের রসনা কীভাবে চরিতার্থ করা যায়, সেটা বোঝাতেই আজকের এই মেলায় উপস্থিত ছিল।

আজকের এই মেলায় আয়োজনে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন অধ্যাপক দিলীপ কুমার মিশ্র, অধ্যাপক কল্যাণ চক্রবর্তী, অধ্যাপক ফটিক কুমার বাউরি, ড.দেবলীনা মাঝি ও ড.অনামিকা কর। এছাড়া বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন অধ্যাপক গোরা চাঁদ হাজরা(গবেষণা অধিকর্তা)। তিনি বলেন, “ফল গবেষণা কেন্দ্রের এই উদ্যোগের মাধ্যমে ভারতবর্ষ ধীরে ধীরে ফল চাষে আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠবে।”

মেলা শেষে উপস্থিত ফলচাষীদের সার্টিফিকেট দেওয়া হয় – যাদের মধ্যে কুশল ঘোষ অন্যতম। তিনি একটা আম গাছে ১৬০ প্রকারের আমের প্রজাতি তৈরি করেছেন। তাঁকে বিশেষ শ্রদ্ধা জানাতে ‘শাল’ উপহার দেওয়া হয়।

এই ফল-গবেষণা কেন্দ্র চাইছে যে, কৃষক কেবল তার জমিতে ফল বৈচিত্র্যই রচনা করবেন না, তৈরি করবেন খাদ্য সম্ভারের অঢেল ও অভূতপূর্ব বৈচিত্র্য। বৈচিত্র্যের সন্ধান দিতে হলে, বৈচিত্র্যের স্বরূপটাও উদঘাটিত করতে হয়। ফল-গবেষণা কেন্দ্র পথ যেমন পথ দেখাচ্ছে, তেমনি কৃষকও দেখাবে তাদের ফল সমৃদ্ধির সাফল্যকাহিনী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *