
স্বামী প্রৌঢ়ানন্দ
আমাদের ভারত, ৩০ জানুয়ারি: কোনও রকমে ভিড় ঠেলে নিজেদের আসনে পৌঁছে দেখি ইতিমধ্যেই কয়েকজন সেগুলি দখল করে বসে রয়েছেন। আমরা টিকিট দেখাতেই তারা সলজ্জে জিভ কেটে সরে বসে বললেন, আপলোগ শো যাইয়ে হাম লোগ সাইডপে বৈঠকে যায়েঙ্গে। কিন্তু এই ভাবে অন্যরা কষ্ট করে বসে থাকবে আর আমরা শুয়ে যাব? তাই অমরদাকে উপরের বার্থে শুইয়ে দিয়ে আমরা বসেই রইলাম, বললাম একরাতের তো ব্যাপার, আবার আমরা একই পথের যাত্রী, চলুন বসে গল্প করতে করতে চলে যাওয়া যাবে।
আমাদের কথা শুনে তারা অবাক, নিজেদের রিজার্ভ করা সিট কেউ যে এমনভাবে ছেড়ে দিতে পারে তা তাদের কল্পনারও অতীত। যাই হোক, কথায় কথায় জানতে পারলাম তারা বারানসী থেকে লখ্নউ এসেছেন আর এখান থেকেই চালু টিকিট কেটে দুন এক্সপ্রেসে উঠেছেন হরিদ্বার যাবেন কুম্ভস্নান করতে। দলে ছয়জন আছেন, প্রত্যেকেই ব্যবসায়ী। যিনি বয়স্ক তাঁর নাম রাজকুমার পাণ্ডে।রাজকুমারবাবুর বয়স প্রায় সত্তর বছর। দুই ছেলে আর এক মেয়ে। স্ত্রী গত হয়েছেন চার বছর আগে। নিজের কাপড়ের ব্যবসা ছেলেদের হাতে তুলে দিয়েছেন। এক মেয়েকেও সুপাত্রস্থ করেছেন। এইরকম ভরা সংসার ছেড়ে অন্য লোক জনের সাথে চলেছেন কুম্ভস্নানে।
আমি প্রশ্ন করলাম আপনাকে আপনার ছেলেরা বাধা দেননি। আমার দিকে তাকিয়ে রাজকুমারবাবু হাসলেন, বললেন বাধা? একেবারে তাড়িয়ে দিতে পারলেই ভালো হয়। আমরা সকলেই অবাক হয়ে তাঁর দিকে তাকালাম।রাজকুমারবাবুর চোখে জল, মুখের বন্ধন সেই জলে কেটে গিয়েছে। উনি বলে চললেন, খুব আশাকরে আমার দুই ছেলের বিয়ে এক সাথেই দিয়ে ছিলাম। ব্যবসাপত্তর আগেই দুই ছেলেকে ভাগ করে দিয়ে ছিলাম। সারা জীবন সংসারের ঠেলা সামলেছি, এবার ছেলেরা ওসব সামলাবে আর আমি আর রমলা মানে, আমার স্ত্রী দুজনে নাতিদের নিয়ে অবসর জীবন যাপন করব, এই ছিল মনে আশা। কিন্তু শুরুতেই ছন্দপতন, ছেলেদের বিয়ে দেবার বছর খানেকের মধ্যেই আমার স্ত্রী দুদিনের জ্বরে মারা গেলেন। আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। আমার যাবতীয় খুটিনাটি, আমার ওষুধ, খাবার সব তিনি দেখতেন। স্ত্রী গত হবার পর আমি একেবারে একা হয়ে গেলাম। ছেলেরা সারাদিন ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত, আর বৌমারা সারাদিন ব্যস্ত তাদের নিজেদের নিয়ে।আমার কোনো কোনও দিন হয়তো খাওয়াই হয় না। ওষুধ শেষ হয়ে গেছে কিন্তু এনে দেবার কেউ নেই। এসবই ভবিতব্য বলে মেনে নিয়ে ছিলাম। কিন্তু আমার একাকীত্বের সঙ্গী ছিল বই। সেই বই পড়ার চশমাটা একদিন ভেঙ্গে গেল। বহুবার বলাসত্ত্বেও কিছুতেই সেই চশমা কেউ এনে দিল না।জীবনের প্রতি চলে এল বিতৃষ্ণা, মনে হল এই ভাবে এখানে তিলে তিলে মরার চাইতে বাবা বিশ্বনাথের চরনে প্রাণত্যাগ করা অনেক ভালো। এইরকম চিন্তা ভাবনা করে বেরিয়ে পড়লাম বাড়ি থেকে। রাস্তায় দেখা হল বহু পরিচিতের সঙ্গে, তারাই আমাকে সাহায্য করলেন। মা অন্নপূর্ণার প্রসাদ পাই আর বাবার চরনে পড়ে থাকি, আর আমার সাথে যাদের দেখছেন তারাই আমায় দেখাশোনা করেন। এটাই এখন আমার সংসার। এতদিন সংসারে থেকে বুঝেছি সং সাজাই এখানে সার। এই সংসার রূপী মায়ার চক্করে পড়েই মানুষ যত কুকর্মে লিপ্ত হয়, মনের সংকীর্ণতা বৃদ্ধি পায়, কর্মফল ভোগ করে। সংসার রূপী ছোট ছাতাটার ছায়া থেকে বেরিয়ে এই বিশ্বসংসারের বড় ছাতার তলায় না এলে মুক্তির স্বাদ পাওয়া যায় না। এখন আর আমার মনে কোনও খেদ নেই, অপর সকলের দুঃখের ভাগিদার হয়ে কবে যে নিজের দুঃখ ভুলে গেছি বুঝতে পারিনি।
অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলাম, ভাবতে লাগলাম হায়রে কপাল, বিধির বিধানে যারা ছিল রাজকুমারবাবুর একান্ত আপনজন তারাই তাঁকে দূরে সরিয়ে দিয়েছেন, আর যাদের দুদিন আগেও চিনতেন না তারাই রাজকুমারবাবুকে আপন করে নিয়েছেন।
এখন প্রায় রাত একটা বেজে গেছে, আমরা সকলেই ঝিমুচ্ছি। হঠাৎ কামরার এক কোন থেকে জলদ্গম্ভীর স্বরে হর হর মহাদেব ধ্বনি কানে এল। তাহলে কি কোনও সাধুবাবা এই কামরাতেই ভ্রমণ করছেন। সাধুসঙ্গ লাভের বাসনায় আমিও গুটি গুটি পায়ে চললাম শব্দের উৎস সন্ধানে। গিয়ে দেখি কামরার একদম শেষে দুটি দরজার মাঝের জায়গায় কম্বল পেতে আসন করে বসেছেন বিশাল দেহী, জটাজুটধারি এক সাধুবাবা।
সাধুবাবা’কে প্রনাম করতেই উনি হাত তুলে আশীর্বাদ করলেন আর পাশেই পাতা কম্বলে ইশারায় বসতে বললেন।নীচে বসে হাত জোড় করে জিজ্ঞাসা করলাম মহারাজজী আপনি এখন কোথা থেকে আসছেন? সাধুবাবা বললেন, এখন আমি নৈমিষারন্য থেকে আসছি আর এখন যাব হরিদ্বারে কুম্ভস্নানে। কুম্ভমেলার কথা উঠতেই জিজ্ঞাসা করলাম মহারাজজী সবাই বলেন কুম্ভস্নান করলে জন্ম জন্মান্তরের পাপ ক্ষয় হয়, এটা কি ঠিক? সাধুবাবা হো হো করে হেসে উঠলেন। বললেন, ভালো কথা জিজ্ঞাসা করেছিস। পাপ আসলে কিরে পাপ তো মনে। আসলে কি জানিস, তীর্থে এলে স্থান মাহাত্ম্যে মন শান্ত হয়, মনের কলুষতা নাশ হয়, মনে অপরিসীম আনন্দ তরঙ্গ তৈরি হয়।সেই হিসেবে বলতে গেলে পাপ নাশ হয় বৈকি। কিন্তু সাধারণ মানুষ আবার নিজের জায়গায় ফিরে গিয়ে তার দৈনন্দিন কাজের মধ্যে দিয়ে পুনরায় পাপ সঞ্চয় করে, তাই এই সব স্নানের মাহাত্ম্য সে পরে আর অনুভবই করতে পারে না। এই বলে সাধুবাবা একটু চুপ করলেন, তারপর আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন তোর তো কিছুই খাওয়া হয়নি দেখছি। এই বলেই তাঁর ঝোলা থেকে দুটি কলা আর দুটি আপেল বের করে আমায় দিলেন। বললেন, খেয়েনে এখনও অনেকটা রাস্তা যেতে হবে। আমি অবাক হয়ে সাধুবাবার দিকে তাকালাম, আমার খাবার যে পড়ে গিয়েছিল, আমার খাওয়া হয়নি একথা সাধুবাবা কি করে জানলেন? যাইহোক আর বেশি চিন্তা না করে ফলগুলি খেয়ে নিলাম। সাধুবাবা মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করে বললেন, যা এবার নিজের জায়গায় ফিরে যা, একটু বিশ্রাম নিয়েনে, কাল অনেক খাটুনি আছে।