তীর্থে তীর্থে পথে পথে, গঙ্গোত্রী ধাম দর্শন (নবম পর্ব)

স্বামী প্রৌঢ়ানন্দ
আমাদের ভারত, ২৭ ফেব্রুয়ারি: কালীকমলি ধর্মশালায় ফিরে এলাম। ঢুকেই প্রথমে গেলাম আশ্রম কর্তৃপক্ষের কাছে। জানতে চাইলাম এখান থেকে গঙ্গোত্রী যাবার বাস কাল সকালে পাওয়া যাবে কিনা। জবাবে তারা জানালেন, বাস এখন গঙ্গোত্রী পর্যন্ত যাচ্ছে না, রাস্তায় বরফ পড়ে রাস্তা বন্ধ আছে। গতকালই আপনাদের কলকাতা থেকে একজন তাঁর শিষ্য ভক্তদের নিয়ে গঙ্গোত্রী ধাম যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু মাঝ পথ থেকেই ফিরে এসেছেন।অক্ষয়তৃতীয়ার পর অর্থাৎ আরও কুড়ি দিন পর রাস্তা পরিষ্কার হলে তবেই ঐ পথে যাওয়া যাবে। কিন্তু কুড়ি দিন অপেক্ষা করার মতন সময় বা রেস্ত কোনটাই আমাদের নেই, তাই মন খারাপ করে রুমে এসে শুয়ে পড়লাম।খানিকক্ষণ সকলে চুপ করে শুয়ে থাকার পর নীরবতা ভঙ্গ করে আমি বললাম ঠাকুর মশাই কাল সকালে চলুন আমরা গঙ্গোত্রী গামী বাসে চেপে বসি, বাস যতদূর যায় আমরাও ততদূর যাব, তার পর অন্য চিন্তা করা যাবে। অমরদা একটু কিন্তু কিন্তু করলেও ঠাকুর মশাই আর আমার ঠেলায় শেষে নিমরাজি হয়ে গেলেন।

পরদিন ভোরবেলা উঠেই মুখ হাত ধুয়ে বাস আড্ডায় চলে এলাম। গঙ্গোত্রী ধামের দিকে কোন বাস যাবে জিজ্ঞাসা করে সেই বাসে চেপে বসলাম। তীর্থযাত্রীদের ভিড় এখন নেই, শুধুমাত্র স্থানীয় যাত্রী তাই বাসের ভিড়ও অনেক কম।খানিকক্ষণ পর বাস চলতে শুরু করল। ধীরে ধীরে উত্তর কাশি ছাড়িয়ে বাস উপরে উঠতে শুরু করল। হিমালয় তার অসম্ভব সুন্দর রূপের সাজি নিয়ে আমাদের কাছে মেলে ধরছে। দূরে সুউচ্চ পর্বতশ্রেণী, তাদের মধ্যে কয়েকটির চূড়া আবার তূষারাবৃত,তার উপর সূর্যর আলো পড়ে সোনালি বর্ন ধারন করেছে। দূরে মনে হচ্ছে পাহাড়ে যেন আগুন লেগেছে।

বাইরের রূপের নেশায় এমন মশগুল ছিলাম যে, বাসের কন্ডাক্টর অনেকক্ষণ ধরে ভাড়া চাইছেন বুঝতেই পারিনি। হুঁশ ফিরল যখন তিনি আমার হাতে হালকা টোকা মারলেন। কন্ডাক্টর জিজ্ঞাসা করলেন কোথায় যাবেন।উত্তরে জানালাম যতদূর বাস যাবে ততদূর যাব। বিস্ময়ে কন্ডাক্টর আমার মুখের দিকে তাকালেন। তাকে বুঝিয়ে বললাম, আসলে আমাদের গন্তব্য গঙ্গোত্রী ধাম কিন্তু শুনেছি এখন ওখান পর্যন্ত বাস যাবে না, তাই যতদূর এই বাসে যেতে পারি ততদূর যাব, তারপর চিন্তা ভাবনা করব কি করব। কন্ডাক্টর আর কথা না বাড়িয়ে আমাদের তিন জনের টিকিট করে দিলেন।

বাস তার নিজের গতিতে ছুটে চলেছে, মাঝে মাঝে থামছে স্থানীয় লোকজন ওঠানামা করছেন। এদের মধ্যে অনেকেই নীচের থেকে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে উপরে নিজেদের গ্রামে চলেছেন। অধিকাংশই গরিব, পাহাড়ি জমিতে সামান্য চাষ আবাদ করে নিজেদের সংসার চালান।কিন্তু চাহিদা এদের খুব কম থাকায় আর্থিক দৈনতা এদের মুখের হাসি টুকু কেড়ে নিতে পারেনি। বাসের মধ্যে অধিকাংশই স্থানীয় হলেও কয়েকজন তীর্থযাত্রীকে দেখলাম আমাদের মতনই উত্তর কাশি থেকে বাসে চেপে আছেন। কি জানি হয়তো বা আমাদের মতন এনারাও অজানাকে জানার দুর্নিবার আকর্ষণে পথে নেমেছেন।

বেলা প্রায় দশটা, ধরালু বলে একটি গ্রামে বাস থামল।ড্রাইভার জানালেন এরপর আর বাস যাবে না, কারন গ্লেশিয়ার পড়ে রাস্তা এখন বন্ধ। অগত্যা আমরা সবাই বাস থেকে নেমে এলাম। খুব সুন্দর গ্রাম এই ধরালু, একদম ছবির মতন সুন্দর। সামনে পিছনে যে দিকেই তাকাই পর্বতশৃঙ্গ আর তার পাদদেশে কুলুকুলু স্বরে বয়ে চলেছেন গঙ্গা। অনেকক্ষণ ধরে মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলাম, শেষে হুঁশ ফিরল এক অবাঙালি বয়স্ক ভদ্রলোকের কথায়। তিনি আমায় জিজ্ঞাসা করলেন, আপনারা কি গঙ্গোত্রী ধাম দর্শনে যাবেন? প্রশ্ন শুনে ভদ্রলোকের মুখের দিকে তাকালাম। বয়স প্রায় পঁয়ষট্টি হবে, মাথার চুল পুরো সাদা ধবধবে, মুখে আভিজাত্যের ছাপ। জিজ্ঞাসা করলাম আপনি কোথা থেকে আসছেন? উত্তরে উনি জানালেন আমি দিল্লি থেকে আসছি, আমার নাম অরুণ মিশ্র। কর্ম সূত্রে বহুদিন আমি কলকাতায় কাটিয়েছি। গঙ্গোত্রী ধাম দর্শন করব এ আমার বহু দিনের ইচ্ছা, কিন্তু এখানে এসে শুনছি রাস্তা বন্ধ। আমার বয়স হয়েছে আর কোনদিন এ পথে আসতে পারব কিনা জানি না। তাই এত দূর যখন এসে পড়েছি তখন ভাবছি বাকি পথ টুকু হেঁটেই চলে যাব, তাই ভাবলাম আপনাদের যদি সাথে পাওয়া যায়। খোঁজ করে জানলাম এখান থেকে গঙ্গোত্রী ধাম প্রায় দশ কিলোমিটারের মতন হবে।

গঙ্গোত্রী ধাম দর্শনের একটা সুপ্ত বাসনা মনের মধ্যে ছিলই, তাই এহেন একটা প্রস্তাব পেয়ে নেচে উঠলাম। বললাম অবশ্যই, চলুন ঠাকুরের নাম করে পথে নেমে পড়ি, তারপর যা অদৃষ্টে আছে দেখা যাবে।অমরদার সুগারের সমস্যা, অতটা রাস্তা হেঁটে গেলে যদি সুগার কমে গিয়ে বিপত্তি হয়, তাই স্থানীয় দোকান থেকে অমরদাকে দুটি লাড্ডু সহযোগে পেট ভরে খাইয়ে নিলাম আর তার সাথে আমরাও খেয়ে নিলাম। আমরা হেঁটে গঙ্গোত্রী ধাম যাব শুনে স্থানীয় লোকজনেরাও আমাদের উৎসাহিত করলেন, তারাই উদ্যোগী হয়ে আমাদের জন্য লাঠির ব্যবস্থা করে দিলেন। যাত্রার আয়োজন সম্পূর্ণ, এবার পথে নামার পালা। গঙ্গা মাতা কি জয় বলে আমরা চারজন পথ চলা শুরু করলাম। ওমা,পথে নেমে দেখি আরো তিনজন নেপালি তীর্থযাত্রী আমাদের সঙ্গে চলেছেন। কথায় কথায় জানতে পারলাম তারাও গঙ্গোত্রী যাবেন এবং ওখান থেকে জল নিয়ে যাবেন নেপালের পশুপতিনাথ মন্দিরে। ভাবছিলাম একা একা নিজেরা কি ভাবে যাব, কিন্তু এখন দেখছি আর একা নই এখন আমরা সাতজন।জীবনের এ এক বিচিত্র খেলা, একেলা পথে নামতে আমরা ভয় পাই কিন্তু একবার সাহস করে পথে নামলে পথই পথের সাথীকে খুঁজে নেয়, দূর তখন আর দূর থাকে না, ক্ষনিকের পরিচয়েই তখন দূরের মানুষ হয় একান্ত আপনার জন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *