শ্বেতাম্ভর ধরা নিত্যা……….

ডা: রঘুপতি ষড়ঙ্গী

আমাদের ভারত, ১৬ ফেব্রুয়ারি:
‘বৃহদারণ্যক্’ উপনিষদ এর ঋষি প্রার্থনা করেছেনঃ
ওঁ অসতো মা সদ্গময়।
তমসো মা জ্যোতির্গময়।
মৃত্যের্মা অমৃতং গময়।
ওঁশান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।
হে পরমেশ্বর! আপনি আমাদের এই নশ্বর অসত্য জীবনকে সত্যের পথে উন্নত করুন। মোহময় অজ্ঞানতার অন্ধকার থেকে জ্ঞানের আলোকময় পথে উন্নীত করুন যাতে এই পার্থিব মৃত্যুলোক থেকে আমরা আধিভৌতিক আধিদৈবিক এবং অধ্যাত্মিক এই তিন অশান্তি থেকে মুক্ত হয়ে অমৃতের পথে পাড়ি দিতে পারি।

সত্য-অসত্য, আলো-আঁধার, মৃত্যু -অমৃতত্ব এই দ্বন্দ্বের মধ্যেই এ যেন সব জীবেরই কামনা। আর কামনা পুরণের একটিই অন্তরায় আর তা হলো…. অজ্ঞানতা। জীবের বাস্তব অজ্ঞানতা হরণ কল্পেই তো দেবী সরস্বতীর রূপরেখা। সারদা’র বন্দনা। মা দুর্গার কন্যা হিসাবে লক্ষ্মী বা সরস্বতী সম্পর্ক পুরাণাদি কল্পিত হলেও তা কখনোই আমাদের বেদ অনুমোদিত নয়। সরস্বতী স্বয়ং ঋক্ বেদ বন্দিত এক বৈদিক দেবতা। ঋগ্বেদের ১ম মন্ডল এর ৩য় সূক্তের ১০ম এবং ১১শ ঋক্ থেকে পাইঃ
” পাবকা নঃ সরস্বতী বাজেভির্বাজিনীবতী।
যজ্ঞং বষ্টূ ধিয়াবসু।।
চোদয়িত্রী সুনৃতানাং চেতন্তী সুমতীনাং।
যজ্ঞং দধে সরস্বতী।।
লক্ষণীয়, এই সূক্তের প্রথমে অশ্বিনী-দ্বয়কে, ইন্দ্রদেবকে এবং বিশ্ব দেবগণের উদ্দেশ্যে মঙ্গল প্রার্থনা করে ক্ষান্ত হননি বিশ্বামিত্র ঋষির পুত্র মধুচ্ছন্দা। শেষে, সেই সরস্বতীর আরাধনা। কারণ, তিনি যে ‘চোদয়িত্রী’……. মানে সুমেধার প্রেরয়িত্রী, জ্ঞানের অধিষ্ঠাত্রী।
তাঁরই কৃপাবলে সত্যের প্রেরণায় সু-মেধার উন্মেষে ও বিদ্যার নিত্য অনুশীলনেই অভীষ্ঠ লাভ করা সম্ভব হয়।
সংস্কৃতে সৃ ধাতু গতৌ অর্থে হয় ‘সরস্’। সরস্ এর সাথে ঙীপ্ প্রত্যয় যোগে নিষ্পন্ন হয় ‘সরস্বতী’ শব্দ।
বর্তমানে সংস্কৃত সৃ ধাতু এর অর্থ গতিময়তা তাই ‘সরস্’ মানে তরল বা বৃহৎ-অর্থে নদী বুঝালেও বৈদিক আভিধানিক অর্থে ‘জ্যোতি’ বুঝায়। অর্থাৎ কিনা, বিকাশে ব্যাকুল গতিময় যে জ্যোতি তিনিই প্রকৃত সরস্বতী। যদিও ঋক্ বেদের সংহিতাকারদের মধ্যে এ বিষয়ে অল্প বিস্তর মতান্তর আজও আছে। তবু একথা নিশ্চিত করেই বলা যায়, প্রবাহ মানে জ্ঞানের প্রবাহ বা জ্ঞানের গঙ্গাকে বোঝানো হচ্ছে যা কখনোই স্থবির নয়, যার গতি অনন্ত অর্নবের অভিমুখে (আসলে,”যতদিন বাঁচি, ততদিন শিখি”)।
আবার ঋগ্বেদে এমন ও আছে “অম্বিতম্বে নদীতমে দেবীতমে সরস্বতী”।

আসলে, ঋক্ বেদের আমলে গঙ্গা বা যমুনার চেয়ে সরস্বতী নদীর প্রাধান্য ছিল অনেক বেশি। নিত্যদিন ঊষাকালে সরস্বতী নদীর তট আশ্রমবাসী ঋষি-কুমার আর সাম গায়কেরা তাদের বেদমন্ত্র উচ্চারণে মুখর করে তুলতেন। সনাতন ভারতীয় ধ্রুপদী ঝঙ্কারের সেই শান্ত সামগীতি’র প্রতিক–ই হয়তো এই বীণা। সরস্বতী বিধৌত ব্রহ্মাবর্ত (প্রাচীন ভারতবর্ষ) ছিল গুরুকূল-বাসীদের সাধন এবং অনুশীলনের আদর্শ স্থান। “বেদ- বেদান্ত-বেদাঙ্গ বিদ্যাস্থানেভ্যঃ এ বচ”। এ তো গেল সরস্বতী নামের পিছনে থাকা বৈদিক ছোট্ট ইতিহাস। আবার, মহাভারত থেকে এমনও জানা যায় যে সরস্বতী এবং দৃষদ্বতি (বর্তমানে লুপ্ত) এই দুই নদীর মধ্যবর্তী পবিত্র সমভূমিতে “সারস্বত যজ্ঞ” অনুষ্ঠিত হতো।

এরপরে এলো পুরাণ এর আধিপত্য। ‘পদ্মপুরাণ’, ‘বায়ুপুরাণ’. ‘গরুর পুরান’, ‘মার্কণ্ডেয় পুরাণ’ সহ আর ও অনেক পুরাণেই সরস্বতী নামের উজ্জ্বল উপস্থিতি চোখে পড়ে। বায়ু পুরাণে ব্রহ্মা’র হৃদয় থেকে সৃষ্ট এই দেবী প্রজাপিতা ব্রহ্মারই ঘরনী। যা থেকে নাকি এই বিশ্ব-সংসারের রচনা। গরুর পুরাণে ইনি “অষ্ট কলা-যুক্তা”.….. শ্রদ্ধা-ঋদ্ধি -কলা -মেধা-তুষ্টি-পুষ্টি-প্রভা ও স্মৃতির একমাত্র আধার। আর পদ্মপুরাণ এর বর্ণনার সাথে মনের মাধুরি মিশায়ে–ই তো আমাদের দেবী প্রতিমার নির্মাণ।
তন্ত্র মতে (বিশেষতঃ শ্রীশ্রীচণ্ডী’তে) মহাকালী মহালক্ষ্মী আর সরস্বতী এক ও অভিন্ন তত্ত্ব। অং থেকে ক্ষং এই পঞ্চাশটি বর্ণই দেবীর সারা দেহ হিসেবে কল্পিত হয়েছে।
শুম্ভ-নিশুম্ভ বধ করার ঠিক পূর্বেও মা আমাদের জ্ঞানদাত্রী মূর্তিতেই বিরাজমানা……” একৈবাহং যগত্যত্র দ্বিতীয়াকা মমাপরা?”
আবার, “মধুকৈটভ বধ্” অধ্যায়ে মোহে অন্ধ, রাজা সুরথ’কে দেবী মেধা-ঋষি’র মুখ দিয়েও শুনিয়েছেন সেই জ্ঞানেরই বাণী।
” সা বিদ্যা পরমা মূক্তির্হেতুভূতা সনাতনী” অর্থাৎ অবিদ্যা মায়াতে ভরা এই মৃত্যুলোক থেকে চির মুক্তির পথ একটাই, তা হলো সনাতনী ব্রহ্মবিদ্যা।
হিন্দুদের স্বীকৃত দেবী হয়েও বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের মানুষদের কাছেও তিনি সমানভাবে বরণীয়া আদরণীয়া। জৈনদের ষোলোজন বিদ্যাদেবীর অন্যতমা এই বাগদেবী।
বেদ থেকে বাল্মীকি, বেদব্যাস থেকে কালিদাস, বিদ্যাপতি থেকে কৃত্তিবাস বঙ্কিমচন্দ্র থেকে রবীন্দ্রনাথ আর নজরুল থেকে প্রভাবতী দেবী সহ বর্তমান শতাব্দীর কবি সাহিত্যিক কে নেই এই বাণী-বন্দনার তালিকায়? বঙ্কিমচন্দ্রের প্রথম দেখা ঠিক ব্রাহ্ম-ধর্মের একান্ত পৃষ্ঠপোষক, কবিগুরু’র “জীবনস্মৃতি” থেকে জানা যায়, বালক রবীন্দ্রনাথের সাথে ২১ বছরের যুবক বঙ্কিমচন্দ্রের প্রথম দেখা হয়েছিল সরস্বতী পূজার মঞ্চেই, সেই ৩১শে জানুয়ারি, সালটা ছিল ১৮৭৮। আবার, “পুরস্কার” সভার “পাত্র-মিত্র অমাত্য আদি” উঠে গেলে কবিগুরু তাঁর “সোনার তরী” তে চেপে একান্তে এভাবেই জানাচ্ছেন তার হৃদয়ের আকুতিঃ
“প্রকাশো জননী নয়ন সম্মুখে
প্রসন্ন মুখছবি।
বিমল মানসসরস-বাসিনী
শুক্লবসনা শুক্লহাসিনী
বীনাগঞ্জিত মঞ্জূভাষিণী
কমলাকুঞ্জাসনা……”
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, ব্রহ্মবাদীর চোখে এই “প্রসন্ন মুখ ছবি” টি তবে কার? বৈষ্ণব পদাবলীকারদের বাদ দিলে মাতা সরস্বতীর সাথে কালিদাসের সম্পর্কও নাকি বড়ই নিবিড়। কথিত আছে, বিদুষী পত্নী বিদ্যাবতীর লাঞ্ছনা সহ্য করতে না পেরে মূর্খ কালিদাস পুকুরে প্রাণ বিসর্জন করতে গেলে স্বয়ং মা–ই নাকি তাঁর জীবন রক্ষা করেন। তাঁরই আশীর্বাদে নাকি মহাপন্ডিত হয়ে ‘মেঘদূত’, ‘রঘুবংশ’, ‘কুমারসম্ভব’ কাব্য এবং ‘মালবিকাগ্নিমিত্রম্’ এর মতো আরো বহু নাটক রচনা করেন সেই কালিদাস।
জন্মস্থান নিয়ে তাঁর নানা মুনির নানা মত আছে। কেউ বলেন উজ্জয়িনী, কারোর মতে কাশ্মীর। আবার কোনো কোনো বিদ্বজ্জন কলিঙ্গ বলে দাবি করলেও আমাদের বীরভূম জেলার নানুর ব্লক এর ‘বেলুটি’ গ্রামের ইতিহাস- নিরপেক্ষ দাবিদারের সংখ্যাও নেহাৎ কম নয়।

নানুরের এক প্রাচীন ঢিবি খনন করে পাওয়া গেছে গুপ্ত যুগের মুদ্রা,বেশ কিছু ব্যবহৃত সামগ্রী, খন্ডিত সরস্বতীর প্রস্তর মূর্তি সহ এক প্রাচীন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ। লোকশ্রুতি, দস্যু কালাপাহাড় একদিন মা’কে খন্ডিত করলেও আজও ৬ খন্ডের দেবী সরস্বতী সেখানে নিত্য পূজিতা হন। মহাকবির স্মৃতি রক্ষার্থে এই ঢিবির উপরে গড়ে উঠেছে মহাকবি কালিদাস উচ্চ বিদ্যালয়। প্রতিবার সরস্বতী পুজোতে দেশ-বিদেশের অসংখ্য বিদ্যার্থীদের উপস্থিতিতে আজও খ্যাতির শিরোপা পায় অখ্যাত এই বেলুটি গ্রাম অভিজ্ঞান শকুন্তলম্ এর কল্যাণে।

আর হুগলীর চন্দননগরে? “সন্তান- সংঘ ক্লাব” এর সরস্বতী পূজার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এসে স্বয়ং কাজী নজরুল রীতিমতো শুনিয়ে গেছেন স্বরচিত কবিতা। কোথাও আবার ইসলাম ধর্মের লোক হয়েও তিনি সরস্বতীর সেবককেই উদ্দেশ্য করে জানিয়েছেন তাঁর অনুযোগ।
“পূজারী কাহারে দাও অঞ্জলি
মুক্ত ভারতী ভারতে কই?”
কোথাও আবার ‘রবিহারা’ হয়ে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন নিজেরই মনোবেদনা……
” তব রসায়িত রসনায় ছিল নিত্য
যে বেদ-বতী
তোমার লেখনী ধরিয়াছিলেন
যে মহা সরস্বতী…….”
আবার প্রখ্যাত কোনও লেখক বা প্রথিতযশা কোনও সাহিত্যিক না হয়েও সারদ বন্দনা থেকে মুক্ত থাকতে পারেননি স্বয়ং আমাদের নেতাজীও। রামমোহন ছাত্রাবাসে এসে কলকাতার সিটি কলেজের ৫০ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে সরস্বতী পুজোতে নিষেধাজ্ঞা জারির কথা শুনে পূজা-পন্থী ছাত্রদের উদ্দেশ্যে তিনি তাঁর অকুণ্ঠ সমর্থন জ্ঞাপন করতে ভুলে যাননি সেদিন।

তাইতো সারা ভারতজুড়েই মাঘ মাসের বসন্ত পঞ্চমী মানে মহাসমারোহে মহানন্দে শুরু হয় হংসবাহিনী’র আরাধনা। ভারতবর্ষ বাদ দিয়েও বাংলাদেশ, নেপাল, জাপান, ভিয়েতনাম, মায়ানমার ইন্দোনেশিয়াতে ও সারদার সাদর সম্ভাষণ। আর আমাদের পশ্চিমবঙ্গের কথা যদি বলেন তাহলে তো বলতেই হয়, বিদ্যালয়- মহাবিদ্যালয়- বিশ্ববিদ্যালয়- গ্রন্থাগার টপকে দেবী নিজেই চলে আসেন যেন গ্রাম বাংলার মাটির দাওয়াতেই।
পদ্মপুরাণ এর বর্ণনা অনুযায়ী
“শ্বেতপদ্মাসনা দেবী শ্বেত- পুষ্পোপশোভিতা
শ্বেতাম্বরা ধরানিত্যা শ্বতগন্ধানুলেপনা।
শ্বেতাক্ষর সূত্রহস্তা
শ্বেত চন্দনচর্চিতা
শ্বেতবীণা ধরা শুভ্রা
শ্বেতালঙ্কার ভূষিতা।”
……শুভ্রবসনা দেবী সাদা চন্দনের চর্চিতা শ্বেত অলংকার যুক্তা। হাতের অক্ষ মালাটি ও সাদা। এক হাতে থাকে বই অন্য হাতে অভয় মুদ্রা। আর কোলে রাখা আলতো করে আদর এর বীণা। শান্ত বদনে শ্বেতহংসের ওপর স্মিত হাস্যে বিরাজিতা।

উত্তর ও দক্ষিণ ভারতে যদিও দেবীকে ময়ূরবাহনা চতুর্ভূজা মূর্তিতেই দেখতে পাওয়া যায়।

সাহিত্যে এবং অঞ্চল বিশেষে দেবীর নাম ও বিভিন্ন। কোথাও তিনি ভারতী, কোথাও সারোদা, আবার কোথাও তিনি ব্রাহ্মী, বিরাজ, বাগদেবী, বাগেশ্বরী শতরূপা, মহাশ্বেতা এবং আরো কতো! এতগুলো যাঁর নাম এমনই যার মহিমা “অন্নদা-মঙ্গল” কাব্যের কাব্যকার নদিয়ার সেই ভারতচন্দ্রই বা দেবীকে নিয়ে কিছু লিখবেন না তাঁর সেই ত্রিপদী ছন্দ সে কি কখনো হয ? তাই রায়গুণাকর মহাশয় ও লিখছেনঃ
“বেদ বিদ্যা মন্ত্র তন্ত্র বেনু-বীণা আদি যন্ত্র
নৃত্য গীত বাদ্যের ঈশ্বরী।”
আর মাতা সরস্বতী সম্পর্কে ভারতীয় সনাতন সংস্কৃতির পরম্পরা টি ও বড়োই প্রাসঙ্গিক
“বন্দিতা সিদ্ধগন্ধর্ব্বৈর্চ্চিতা দেবদানবৈঃ
পূজিতা মুনিভিঃ সর্ব্বৈঋষিভিঃ স্তূয়তে সদা।”

………….মুনি’রা যার কৃপালাভে নিত্য পূজা করেন, বৈদিক ঋষিরা যাঁকে তুষ্ট করতে সদা ব্যস্ত থাকেন সিদ্ধ বা গন্ধর্বেরা পর্যন্ত যে দেবীর অর্চনা করেন সেই বাগদেবী’কে বাদ দিয়ে বেদ উপনিষদ্ এর সনাতন ভারত-ভাবনা মনে আসবেই বা কী করে? প্রজ্ঞা- সৃজনশীলতা সুমেধা-সমৃদ্ধি’র নাম–ই যে সরস্বতী। জয়তু বাক্ দেবী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *