রাজ্যপাল–মুখ্যমন্ত্রী সংঘাত! রাজ্যপালের সাংবিধানিক ক্ষমতা কতটা?

ড. রাজলক্ষ্মী বসু
আমাদের ভারত, ২৬ এপ্রিল: এ আমাদের লজ্জা যে এই দুর্যোগের দিনেও রাজনৈতিক কলহের ঊর্ধ্বে আমাদের সংস্কৃতি উন্নীত হতে পারেনি। কলহ দুই বা একাধিক রাজনৈতিক দলের মধ্যে হলে তা-ও মন্দের ভালো। কিন্তু যদি তা রাজ্যপাল বনাম মুখ্যমন্ত্রী হয়, তা সবার চোখ ছানাবড়া করবেই। এই রাজ্যের রাজ্যপাল মাননীয় জগদীপ ধনকর মহাশয় রাজ্য সরকারের কোনো কাজের খতিয়ান জানতে চাইলে বা পরামর্শ দিলে বা করোনা মহামারিতে স্বাস্থ্য চিত্র বিষয়ে জিজ্ঞাসা এতো বিপত্তির কি কারণ এটাই তো সাধারণ নাগরিক হিসাবে স্পষ্ট নয়। সাধারণ নাগরিক হিসাবেও তা প্রশ্ন করার অধিকার আমার-আপনার সবার আছে। আমরা প্রয়োজনে জনস্বার্থ মামলা করতে পারি। সংবিধান সে স্বাধীনতা এবং আইন স্বীকৃতি সমর্থন করে। রাজ্যপালের অধিকার তাহলে কি?

গত ২৩ এপ্রিল মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী রাজ্যপাল মহাশয়কে পাঁচ পাতার চিঠি দেন। সেই চিঠির শুরুতেই তিনি (মুখ্যমন্ত্রী) রাজ্যপালের পূর্ববর্তী একটি চিঠির উল্লেখ করেছেন। রাজ্যপালের চিঠির বক্তব্যে তিনি আহত। মুখ্যমন্ত্রী ও রাজ্যপাল উভয়ই যে সাংবিধানিক পদ তা তিনি স্মরণ করিয়েছেন। এ কথা বহু ক্ষেত্রে আমাদেরও স্মরণ করাতে হয়। মুখ্যমন্ত্রী প্রথমে সাংবিধানিক পদ, তারপর দলনেত্রী। এবার জিজ্ঞাসা কে বেশি গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যপাল নাকি মুখ্যমন্ত্রী? হঠাৎ এ প্রশ্ন কেন? বিবাদের নকশায় ভরা মুখ্যমন্ত্রীর চিঠিতে বেশ কড়া বাক্য উল্লেখ রয়েছে— ‘you appear to have forgotten that I am an elected Chief Minister of a proud Indian state, you also seem to have forgotten that you are a nominated Governor…’ প্রথমেই জিজ্ঞাসা Proud Indian state-এর চিত্ররূপ বা রাজনৈতিক মর্যাদা রূপ কেমন হওয়া উচিত?

গর্বিত রাজ্যে আজ কেন তথ্য গোপনের এত কৌশল? কেন করোনা মৃত্যুকে কো-মরবিডিটি তত্ত্বের আড়াল করার প্রচেষ্টা? কোন রাজ্য কিট নেই বলে বা নিম্নমানের কিট বলে তর্ক করছে? এ মুহূর্তে ভারতের অন্য রাজ্যে প্রতি লক্ষ মানুষ পিছু ক-জনের করোনা পরীক্ষা হচ্ছে, আর আমাদের রাজ্যে ক-জনের? এ রাজ্য যে বহু পিছনে, এ রাজ্যের চিকিৎসক মহল কেন উত্তেজিত? পার্সোনাল প্রোটেকটিভ ইকুইপমেন্টনস বা অন্যান্য সরঞ্জামের অভাব বলে? কেন ত্রাণের চাল বা রেশন নিয়ে জোর রাজনীতি। খাদ্যমন্ত্রী কাউন্সিলরকে ধমক দেন রেশন বণ্টন নিয়ে। কেন বিরোধী দলের কেউ খাদ্য সামগ্রী দিতে গেলে রাজ্য পুলিশ বাধা দেয়। অনুমতি মেলে না সময়ে। গর্বিত রাজ্যের এই দশা যে দেশের মধ্যে লজ্জাজনক অবস্থায় উপনীত করছে। গর্বিত না এমন রাজ্য ত্রিপুরা, গোয়া, সিকিম তারা লকডাউন এবং বাকি সব নিয়মনীতি মেনে ও স্বাস্থ্য পরিষেবা দিয়ে রাজ্যকে করোনা মুক্ত করতে পেরেছে। কেরালা নিঃসন্দেহে করোনার বিরুদ্ধে সিংহের মতো লড়াই করছে।

গর্বিত নয়— এমন রাজ্য উত্তরপ্রদেশ, সেখানেও রেশন চুরির অভিযোগ নেই। শাকসবজির গাড়ি অঞ্চলে অঞ্চলে ভ্রাম্যমান। এই মুহূর্তে প্রশাসনিক অদক্ষতা এবং রাজনৈতিক নীতিহীনতায় এ রাজ্য গর্বিত না। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণ দল এ রাজ্যে আসলে টানা একদিন তাদের যখন তাচ্ছিল্য বহন করে অপেক্ষা করতে হয় এবং অনেক অসহযোগিতার পর তা সম্পন্ন করতে হয় তখন কি কেন্দ্রীয় অফিসে এ রাজ্যের মান বৃদ্ধি করে। হয়ত, এটাই আমাদের গর্বিত রাজ্য। আর উনি রাজ্যের গর্ব।

এবার কে সাংবিধানিক গুরুত্ব কতটা বজায় রাখেন। রাজ্যপাল সক্রিয়তার পথে না হাঁটলে এই প্রসঙ্গ হয়ত আসত না। সংবিধানের ১৫৫ ধারা অনুযায়ী রাজ্যপালকে নিয়োগ করেন রাষ্ট্রপতি এবং তিনি অপসারিতও করতে পারেন। সংবিধানের ১৬৩(১) ধারা বলে মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে মন্ত্রিমণ্ডলীর সদস্যরা রাজ্যপালকে সাহায্য ও পরামর্শ দিতে পারেন। সংবিধানের এই ধারা অনুযায়ী রাজ্যপাল রাজ্যের স্বার্থে নিজেও সিদ্ধান্ত নিতে পারেন বা প্রস্তাব দিতে পারেন। সংবিধানের কে পদ ভার বেশি রাখেন। ‘nominated Governor’ কিন্তু খুব হালকা পদ নয়। মাননীয়া, সংবিধানের ১৬৩(২) ধারাকেও মান্যতা দিতে হবে— সংবিধানের ধারানুযায়ী রাজ্যপাল যদি কোনো কাজ করেন সেক্ষেত্রে প্রশ্ন করা যাবে না। উপরন্তু ১৬৩(৩) ধারায় বলা হয়েছে, যদি মন্ত্রীমণ্ডলী কোনও প্রশ্ন উত্থাপন করেন তা কোনও কোর্টেই অনুসন্ধান করা যাবে না। অর্থাৎ সংবিধানের সীমাবদ্ধতার মধ্যে রাজ্যপাল মুখ্যমন্ত্রী উভয়েই রাজ্যের স্বার্থে কাজ করতে পারেন। পার্থক্য শুধু এই, যে পরিমণ্ডল রাজ্যবাসীর কাছে অনেক বেশি দায়বদ্ধ কিন্তু রাজ্যপাল নয়। এমন ধারণা পোষণ করা হয়।

মাননীয় রাজ্যপাল মুখ্যমন্ত্রীর পাঁচ পাতার চিঠির জবাবে পুনরায় চৌদ্দ পাতার উত্তর দেন। তিনি বারংবার বলেন, এ আমার-তোমার লড়াই নয় এই মুহূর্তে। এ হল সংকটের বিরুদ্ধে লড়াই, রাজ্যবাসীর প্রতি রাজ্যপাল দায়বদ্ধ। তিনি মনোনীত হলেও রাজ্যের দুর্দশার প্রতি ‘Nelson’s eye’ হয়ে থাকতে পারলেন না বলেই তো সংঘাত। খেয়াল রাখতে হবে সংবিধান বেশ কতগুলি ক্ষেত্রে রাজ্যপালের একক ক্ষমতা দিয়েছে, যেমন— ১) মন্ত্রিত্ব বাতিল, ২) বিধানসভা বাতিল, ৩) বিশেষ ক্ষেত্রে সংকটের পরিস্থিতিতে রাজ্যপাল কিন্তু মন্ত্রীমণ্ডলীর পরামর্শও শুনতে বাধ্য নন। ১৬৩ ধারা পরিষ্কার বলে সংবিধানে বর্ণিত রাজ্যপালের ক্ষমতা পালনে রাজ্যপাল মন্ত্রীমণ্ডলীর পরামর্শ মানতে বাধ্য নন। আর সে পরিস্থিতিগুলো হল— ১) রাজ্যে শান্তিশৃঙ্খলা বিঘ্নিত হলে রাজ্যপাল তাঁর ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেন, ২) রাজ্য মন্ত্রিসভাকে বরখাস্ত করা, ৩) পূর্বেই বললাম, বিধানসভা বাতিল করা, ৪) নির্বাচন তদারক, পথপ্রদর্শন এবং নিয়ন্ত্রণ, ৫) রাজ্যের পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান এবং অ্যাডভোকেট জেনারেলকে নিয়োগ করা। শুধু এখানই শেষ না, ১৬৭ ধারায় বলা হয়েছে, মন্ত্রিসভায় গৃহীত সিদ্ধান্ত রাজ্যপালকেই জানাতে হয় এবং কোনো আইন প্রণয়ন করতে হলে মুখ্যমন্ত্রীকে রাজ্যপালের সম্মুখীন হতে হয়। এককথায় প্রশাসন পরিচালনা ও আইন প্রণয়নের সব প্রস্তাব রাজ্যপালকেই জানাতে হবে।

গত পঞ্চায়েত নির্বাচনের (২০১৮) পরবর্তী সময় থেকেই রাজ্যপাল-মুখ্যমন্ত্রী প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয়। তৎকালীন রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠি ক্ষোভ ও উষ্মা প্রকাশ করে কেন্দ্রের কাছে রিপোর্ট পাঠান। সংঘাতের শুরু তারপরই।
সংবিধানের মলাট উলটে একটু ধৈর্য ধরে দেখতে হবে— পুনরায় দেখা যাক ১৫৪(১) ধারা, এই অনুচ্ছেদ বলে— ‘The executive power of the state shall be vested in the Governor.’ রাজ্যপাল মানে কেবল রাজভবন আর আরামের দিন— এমনটা নয়। তিনি শপথ গ্রহণের সময় ঈশ্বরের নামে বিবেকের কাছে শপথ করেছেন, রাজ্যবাসীর কল্যাণের জন্য তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করবেন। সুতরাং মানুষের প্রতি তিনি ভীষণভাবে দায়বদ্ধ। সংবিধান কখনই রাজ্যপালকে ঘুমিয়ে কাটাতে বলেনি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তিনি অতিসক্রিয় হতেই পারেন। ড. এস সি কাশ্যপ একদা বলেছিলেন, ‘there are certain areas where the Governor may have to use his own wisdom (OTICJ 127 constitution, page 214)।

মাননীয়া তাঁর চিঠিতে ‘যুক্তরাষ্ট্রীয়’ বিষয়টির উত্থাপন করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রীয় ঐক্যকে সুনিশ্চিত করতেই রাজ্যপাল মুখ্যমন্ত্রী সম্পর্ক শিষ্টাচারের ও সুষ্ঠু হওয়া বাঞ্ছনীয়। ‘নমিনেটেড’ রাজ্যপাল যে ক্ষমতা রাখেন এবার নিশ্চয়ই তা বিশেষ জনের বা জনেদের কাছে পরিষ্কার। মুখ্যমন্ত্রীও যেমন গুরুত্বপূর্ণ পদ রাজ্যপালও। তাই রাজ্যের কঠিন অবস্থায় সংবিধান ও সাংবিধানিক পদের মর্যাদা দেওয়া বিশেষভাবে প্রয়োজনীয়। অনেক অভাবের মধ্যে সমস্যা নিয়ে আমরা হাঁটছি। এমতাবস্থায় শিষ্টাচারের অভাব যেন বাড়তি সমস্যা তৈরি না করে। আমরা গর্বিত রাজ্যের নাগরিক হতে চাই। (মতামত লেখকের নিজস্ব)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *