তিনি বীর সন্ন্যাসী, বীরপূজা যদি শিখতে না পারি তবে তাঁর জন্মদিন পালন বৃথা

বলেছিলেন ধর্ম অনুসরণ করলেই দেশ গৌরবান্বিত হবে। ধর্ম পরিত্যাগ করলে রাষ্ট্রীয় মৃত্যু অনিবার্য।…..
বলছেন, যে দেশের প্রাণ ধর্ম, ভাষা ধর্ম, ভাব ধর্ম সে দেশকে ধর্মের মধ্য দিয়েই সব করতে হবে।

ড. কল্যাণ চক্রবর্তী
আমাদের ভারত, ১২ জানুয়ারি: স্বামী বিবেকানন্দ বীর, তিনি সন্ন্যাসী, তিনি যোদ্ধা। বীরপূজা যেহেতু মানুষের জন্মগত প্রবৃত্তি, যুদ্ধ যেহেতু আমাদের সর্বত্রই করতে হবে, তাই আমরা মহাপুরুষদের মধ্যে যোদ্ধৃত্ব রূপ খুঁজি আর সহজেই পেয়ে যাই হিন্দু বীর সন্ন্যাসী স্বামী বিবেকানন্দকে। বিবেকানন্দ মানবজাতির মৌলিক চিন্তা ভাবনার কথা বলেছেন। আগুনের ভাষায় যুবকদের মধ্যে অসীম শক্তি সঞ্চার করেছেন, নতুন উদ্যমে হিন্দু যুবককে উদ্বুদ্ধ করেছেন, আত্ম-চেতনা জাগিয়ে দিয়েছেন। বলেছেন, “তোমার মধ্যে অসীম শক্তি, তুমিই আনন্দময়।” তিনি বলেছেন এগিয়ে যাবার কথা, “Arise, awake and stopnot till the goal is reached.” বলেছেন, শক্তিই জীবন এবং শক্তির শুভ প্রয়োগই ধর্ম। আমরা তাঁর জীবনীপাঠ করে ধর্মের জন্য শুভঙ্করী শক্তি প্রয়োগ করি। আমরা যোদ্ধা হই, আমরা ভারতবর্ষে বীর-পূজা করি। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে শক্তির ও ধর্মের শুভ প্রয়োগ ঘটাতে চাই। স্বামীজি সেই বিবেক-শুভ্র বিবেকানন্দ।

স্বামীজির সনাতনী ভারতবর্ষ: স্বামীজী ভারতবর্ষ বলতে হিন্দুদের ভারতবর্ষই বুঝতেন। মনে করতেন, খ্রিষ্টান মিশনারি ও নানান সংস্কার সভাগুলির হিন্দুদের প্রতি ঘৃণা ও হিংসার পরিমাণ এত বেশী যে, সে বিষয়ে তাদের কাছে কোনও রকম প্রশ্ন করা সম্পূর্ণ অর্থহীন। প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছিলেন–এরা কেন হিন্দুদের সংস্কার-চেষ্টার বিরোধী হবেন? এরা কেন এইসব আন্দোলনের প্রবল শত্রু হয়ে দাঁড়াবেন? (আমার সমরনীতি, বিবেকানন্দ রচনা সমগ্র) বিবেকানন্দের স্বজাত্য বোধের উৎস ছিল হিন্দুত্ব – “হিন্দুজাতি সমগ্র জগত জয় করিবে।” তিনি বলেছেন, হিন্দুসমাজে যে সমস্ত বিশেষ দোষ রয়েছে, তা বৌদ্ধধর্মজাত, তার উত্তরাধিকারস্বরূপ এই অবনতি। প্রাচীন ভারতে হিন্দুদের ইসলাম ধর্ম গ্রহণকে তিনি ‘বেশ্যাবৃত্তি’-র সাথে তুলনা করে তিরস্কার করেছেন। হিন্দু সমাজত্যাগী মুসলিমদের স্বামীজী ‘দেশের শত্রু’ বলে চিহ্নিত করেছেন। বলেছেন, কোনো লোক হিন্দুসমাজ ত্যাগ করে অন্যধর্ম গ্রহণ করলে সমাজে শুধু যে একটি লোক কম পড়ে তা নয়, একটি করে শত্রু বৃদ্ধি হয়। তিনি বেদান্ত দর্শনকে মহাসত্য বলে মনে করেছেন। তিনি বলেছেন, “কেবল বেদান্তই সার্বভৌম ধর্ম হতে পারে, আর কোনো ধর্মই নয়।”

ভারতবর্ষ হিন্দুপ্রধান দেশ। “এ দেশে সেই বুড়ো শিব ডমরু বাজাবেন, মা কালি পাঁঠা খাবেন আর কৃষ্ণ বাঁশি বাজাবেন এ দেশে চিরকাল। যদি না পছন্দ হয়, সরে পড় না কেন।” ১৮৯৩ সালের ২০ সেপ্টেম্বর শিকাগো ধর্মমহাসভায় খ্রিষ্টানদের উদ্দেশ্য করে বলেন, “তোমরা খ্রিষ্টানেরা পৌত্তলিকদের আত্মাকে উদ্ধার করবার জন্য তাদের কাছে ধর্মপ্রচারক পাঠাতে খুবই উৎসাহী, কিন্তু বল দেখি অনাহার ও দুর্ভিক্ষের হাত থেকে দেহগুলো বাঁচাবার জন্য কোনো চেষ্টা কর না কেন? ভারতবর্ষে ভয়ংকর দুর্ভিক্ষের সময় হাজার হাজার মানুষ খিদেয় মৃত্যুমুখে পড়ে, কিন্তু তোমরা খ্রিষ্টানরা কিছুই করনি। তারা ভাত চাইছে আর আমরা তাদের পাথরের টুকরো তুলে দিচ্ছি। ক্ষুধার্ত মানুষকে ধর্মের কথা শোনানো বা দর্শনশাস্ত্র পড়ানো হল তাকে অপমান করা।” তিনি পরিষ্কার করেই বলে দিয়েছেন যদি কোনও সম্প্রদায়ের ওঙ্কারোপাসনায় আপত্তি থাকে, তবে তার নিজেকে হিন্দু বলবার অধিকার নেই। মনে করেছেন কেবল তখনই কেউ প্রকৃত হিন্দুপদবাচ্য যখন ঐ নামটিতে তার ভেতরে বৈদ্যুতিক শক্তি সঞ্চারিত হয়। যখন যেকোনো দেশীয়, যেকোনো ভাষাভাষী হিন্দু নামধারী হলেই পরমাত্মীয় বোধ হবে, যখন হিন্দুনামধারী যে কোনও ব্যক্তির দুঃখকষ্ট তার হৃদয় স্পর্শ করবে, নিজের সন্তান বিপদে পড়লে যেরকম উদ্বিগ্ন হয় তার কষ্টেও সেরকম উদ্বিগ্ন হবে, তখনই তিনি প্রকৃত হিন্দু হয়ে উঠবেন। তিনি হিন্দুদের মধ্যে পরস্পর বিরোধ ভুলে, চারিদিকে প্রেমের প্রবাহ বিস্তার করতে বলেছেন। ক্রিসমাস ডে-কে অতিক্রম করতে চেয়েছিলেন স্বামীজি– অস্বীকার করার উপায় নেই স্বামী বিবেকানন্দ ছিলেন হিন্দু ধর্মের মাহাত্ম্য কীর্তনীয়া। শিকাগোতে তিনি হিন্দুধর্মের প্রচারের জন্যেই গিয়েছিলেন। তিনি খ্রিস্টান মিশনারীদের সুস্পষ্টভাবে জানিয়েও দেন, ভারতবর্ষ কখনই অধ্যাত্মসম্পদে দরিদ্র নয়, দরিদ্র অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানে। মনে রাখতে হবে স্বামীজি অন্য ধর্ম থেকে ভাব নেবার ব্যাপারে খুবই selective ছিলেন। যীশুর সামাজিক সাম্যনীতি তাঁর প্রাণ স্পর্শ করে থাকবে, জগতের কল্যাণের জন্য যে ত্যাগ দরকার হয়, তার রসদও যীশুখ্রিস্টের মধ্যে তিনি পেয়ে থাকবেন। ঔপনিবেশিক শাসনে থাকবার পর মানুষ স্বভাবতই তাদের ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়, নতুবা নানান মত ও পথে তা অতিক্রমণ করতে মনস্থ হয়, কখনও কখনও ঔপনিবেশিক শক্তির মান্য ধর্মকে তীব্রভাবে অস্বীকার করার মানসিকতা জন্মায়। ব্রিটিশ শাসনে থেকে স্বামীজি হয়তো সেই ধর্মীয় পরিমণ্ডল অতিক্রম করার জন্য তাদের ধর্মীয় সেরা দিনটিকেই গ্রহণ করেছিলেন। আর সেই দিনটির মধ্যে হিন্দুধর্মের নবযুগের ইতিহাস রচনা করতে চাইলেন।

১৮৮৬ সালের বড়দিনের পূর্বসন্ধ্যায় (১৩ ই পৌষ, ১২৯৩) নয়জন গুরুভাই হুগলীর আঁটপুর গ্রামে বাবুরাম ঘোষের (শ্রীরামকৃষ্ণ পার্ষদ, পরবর্তীকালে স্বামী প্রেমানন্দ) বাড়িতে উপস্থিত হয়ে ভারতের অধ্যাত্মিক ও সামাজিক কল্যাণে সন্ন্যাস গ্রহণের সংকল্প করলেন। অন্যদিনও তো করতে পারতেন, কারণ আঁটপুরে তার বেশ কয়েকদিন আগেই তিনি পৌঁছেছিলেন। মনে রাখতে হবে ১৮৮৬ সালেই আগষ্ট মাসে ঠাকুরের শরীর যায়। সে বছর ক্রিসমাসের আগের দিন অশ্বত্থ তলায় ধুনি জ্বেলে তাঁরা বসলেন গভীর ধ্যানে, তারপর ঈশ্বর আলোচনা। জানা যায়, স্বামী বিবেকানন্দ যীশুখ্রিস্টের কথা সেদিন বলেছিলেন। এখন প্রশ্ন এইভাবে দিনটি পালনের পরও পরবর্তীকালে পুরীতে গিয়ে সেই বাবুরাম মহারাজই কেন খ্রিস্টান পাদ্রীদের ধর্মপ্রচারে জনসমাগমকে বিভ্রান্ত করার জন্য এবং স্বধর্ম চেতনাকে জাগ্রত করার জন্য ‘হরিবোল হরিবোল হরিবোল’ ধ্বনি দিয়ে উত্তাল করেছিলেন এবং উপস্থিত মানুষকে তাতে সামিল করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন? আর তাতে সফলও হয়েছিলেন।

দ্বিতীয় ঘটনা ১৮৯২ সালের ২৫, ২৬, ২৭ শে ডিসেম্বরের; স্থান কন্যাকুমারী। আবারও ২৫ ডিসেম্বরকে ব্যবহার করলেন স্বামীজি। স্বামীজি অখণ্ড ভারতের স্বপ্ন দেখেছিলেন। ডাইনে-বামে-পশ্চাতে ঢেউ আর ঢেউ, অগণিত অনন্য, মহাসাগরের বুকে মিশে যেতে চায় সাগর আর উপসাগর–অনাদি কাল থেকে তাদের অভিসার যাত্রা।

১৮৯২ সালের ২৫ শে ডিসেম্বর; আকাশের এক তারা এসেছেন মত্যসাগরের ত্রিকোণ প্রেমের জলধারায় নীলকর দিয়ে। সুনীল জলধি থেকে সন্তানসম ভারতবর্ষের আবির্ভাব; মহাকালের সেই মহান অধ্যায় দেখতে এসেছেন সপ্তর্ষিমণ্ডলের এক আশ্চর্য নক্ষত্র; তার অতীত আর ভবিষ্যৎ মেলাবেন সমাধিতে বসে। পাশেই সমুদ্র-তনয়া কন্যাকুমারী। বড়দিন-ই বটে, তার প্রাক্কালে পায়ে হেঁটে কন্যাকুমারী পৌঁছেছেন স্বামী বিবেকানন্দ, তারপর মূল ভূখণ্ড থেকে সাগর-সঙ্গমে ৫০০ মিটার সাঁতরে ভারতীয় পাহাড়ের শেষ বিন্দুতে পৌঁছলেন তিনি। দেখলেন অখণ্ড ভারতের স্বপ্ন, তারপর অতুল্য কিন্তু অভুক্ত ভারতের জন্য গ্রহণ করলেন এক অধ্যাত্মিক সংকল্প। ধ্যানের শঙ্খনাদে একাদিক্রমে তিনদিন কাটলো–২৫, ২৬, ২৭ শে ডিসেম্বর। যে খ্রিস্টান ধর্ম মানুষকে ‘পাপী’ বলে, সেই ধর্মের প্রতিবাদ কেবল স্বামীজিই করেননি, করেছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণও।

মানুষ দেবতা, মানুষ ব্রহ্ম, সে পাপী হবে কীভাবে? সে অমৃতের সন্তান, সে পবিত্র, সে পূর্ণ। পূর্ণতা প্রাপ্তির সব যোগই তার মধ্যে আছে। উপনিষদের ঋষির মত আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন, “শৃণ্বন্তু বিশ্বে অমৃতস্য পুত্রা আযে ধামানি দিব্যানি তস্থুঃ।” হে অমৃতের পুত্রেরা, শোন–আমি এই অজ্ঞানের অন্ধকার থেকে আলোয় যাওয়ার রাস্তা পেয়েছি। আমি সেই প্রাচীন মহান পুরুষকে জেনেছি, যিনি সকল আঁধারের ওপারে, মৃত্যুকে অতিক্রম করে। এই প্রাচীন বাণী শুনিয়ে তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন হিন্দুধর্মে আমাদের পাপী বলতে চাওয়া হয় না। আমরা ঈশ্বরের সন্তান, আমরা মর্ত্যভূমির দেবতা। মানুষকে পাপী বলার মত মহাপাপ আর নেই। এ যে মনুষ্যত্বের স্বরূপের ওপর একটা মিথ্যের কলঙ্ক আরোপের প্রচেষ্টা। স্বামীজী এই ভুল বদলে দিতে চেয়েছেন। শুধু তাই নয়, ব্রাহ্মসমাজের শশিপদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের হিন্দু বিধবা আশ্রমের জন্য তিনি বিদেশে বক্তৃতা দিয়ে টাকা তুলে পাঠিয়েছেন কেবল খ্রিস্টান ধর্মান্তরিত ভারতীয় বিদূষী মহিলা রামাবাইয়ের তৈরি বিধবা আশ্রমকে ঔচিত্য দেখানোর জন্য। কারণ এই মহিলাসহ অন্যান্য খ্রিস্ট-ধর্মাবলম্বী ও মিশনারিরা গলা মিলিয়ে ভারতীয় বিধবাদের দুঃখের অতিরঞ্জন করতেন, স্বামীজির তা না-পসন্দ ছিল। হিন্দু ধর্মের প্রচারে আনুকূল্য পাবার জন্য যতটুকু যীশু-ভজনা দরকার স্বামীজি তাই করেছেন। তিনি জানতেন একদিন শ্রীরামকৃষ্ণ প্রচার ধারায় অখণ্ড ভারতবর্ষ সহ প্লাবিত হবে বিশ্বের নানান অংশ, তাই বড়দিনের মত দিনটির মধ্যে হিন্দু ধর্মের মাহাত্ম্য কীর্তনের বীজ বপন পূর্বেই করে দিলেন তিনি। এটা কলোনিয়াল প্রভাবমুক্তিরই সাধনা, সাধনা ২৫ শে ডিসেম্বরকে অতিক্রমের। এই দিনে বরং বেশী করে শ্রীরামকৃষ্ণের ও স্বামী বিবেকানন্দের স্মরণ-মনন ও পূজন জরুরী। জরুরী শ্রীরামকৃষ্ণ-স্বামীজি যুগলবন্দীর আরাধনা। খ্রিস্টের মধ্যে শ্রীরামকৃষ্ণকে না দেখে শ্রীরামকৃষ্ণের মধ্যেই যীশুখ্রিস্টকে আবিষ্কার করার সাধনা বরং অতি উৎসাহীদের শুরু করা উচিত। সম্প্রীতির বার্তা দিতে বরং ক্রিস্টানরা প্রভু যীশুর মধ্যে শ্রীরামকৃষ্ণকে খুঁজে নিক।

রামনামে মত্ত স্বামীজি: ১৮৮৬ সালের ৭ জানুয়ারি, তখনও নরেন্দ্রনাথ স্বামী বিবেকানন্দ হয়ে ওঠেননি। কল্পতরু দিবস অতিবাহিত হয়েছে (১৮৮৬ সালের ১ লা জানুয়ারি)। শ্রীরামকৃষ্ণ তখন অসুস্থ। তাঁকে নরেন্দ্রনাথ বলছেন, এখন থেকে তাকে প্রত্যহ বলে দিতে হবে সেদিন সাধন ভজন কীভাবে করবেন। শ্রীরামকৃষ্ণ সেদিন তাঁর আদরের নরেনকে নিজের কুলদেবতা রামের ইষ্টমন্ত্র দিলেন। নরেনের শ্রীরাম ভজনা শুরু হল। শ্রীম(মাস্টারমশাই)-র দিনলিপি উদ্ধৃত করে স্বামী প্রভানন্দ লিখেছেন সেই কথা। ১৩ ই জানুয়ারি শ্রীম দেখছেন, নরেন্দ্রনাথ পাগলের মতো রামনাম গাইছেন; অবশেষে ১৬ ই জানুয়ারি নরেনকে শ্রীরাম সন্ন্যাসীবেশে দর্শন দিলেন। আর ১৯ শে জানুয়ারি নরেন্দ্রনাথসহ নিরঞ্জন প্রমুখ সেই সন্ন্যাসীবেশী রামের মতো রামাইৎ সাধুর বেশ ধারণ করলেন। নরেনের গেরুয়াবেশে মা ভুবনেশ্বরী যারপরনাই চিন্তিত হলেন। নরেন যে সপার্ষদ সন্ন্যাসী হতে চান এবং তা ক্ষত্রিয় রামের সন্ন্যাস-বেশী রূপে তা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। পিতৃসত্য পালনের জন্য শ্রীরাম বনবাসী হয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর ক্ষাত্রধর্ম অক্ষুণ্ণই ছিল। শ্রীরামের এই অনন্য রূপের মধ্যেই রয়েছে চিরন্তন ভারতবর্ষের শাশ্বত চিন্তন; শৌর্যশালী অথচ তাপসমালী। ভারতবর্ষের তপোবনে ভারতীয় সভ্যতার অনন্য উপাচার আর নগর-রাজধানে বিক্রমশালী প্রজারঞ্জন রাজা– এ দুয়ের এক অমিত মেলবন্ধন হল শ্রীরামের সন্ন্যাসরূপ। স্বামী বিবেকানন্দ যে বীর সন্ন্যাসী হয়ে উঠেছেন তা হয়তো এই রঘুবীরেরই সাধনায়। গুরু শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর প্রিয় শিষ্যকে কুলের ইষ্টনাম দিয়ে সেই সাধনার ধারাকে পরিপুষ্ট করেছেন, বাঙ্গলাতে শ্রীরাম সংস্কৃতিকে পুনরুজ্জীবিত করেছেন। বাঙ্গলার ধর্মীয় সংস্কৃতিতে শ্রীরামচন্দ্রকে পূজন-আরাধন যে প্রচলিত ছিল তা কবি কৃত্তিবাসের ‘শ্রীরাম পাঁচালী’-ই অমোচ্য প্রমাণ।

ধর্মের জন্য স্বামীজির শক্তি-সংহতি: স্বামীজী বলছেন, “গীতাপাঠ অপেক্ষা ফুটবল খেলিলে তোমরা স্বর্গের আরও নিকটবর্তী হইবে।” “You will understand the Gita better with your biceps, your muscles, a little stronger.” বলছেন, “আমি এমন মানুষ চাই যাদের মাংসপেশী লোহা দিয়ে তৈরি, স্নায়ুগুলি ইস্পাত দিয়ে তৈরি আর এই দেহের মধ্যে এমন মন থাকবে যা বজ্রের উপাদানে গঠিত।” তিনি মনে করতেন দুর্বলতাই পাপ। শুভঙ্করী কাজে শক্তির প্রয়োগ প্রয়োজন। জগতের কল্যাণের জন্য, সমাজের মঙ্গলের জন্য শক্তির প্রয়োগই হচ্ছে ধর্ম। স্বামীজী মনে করতেন শারীরিক দৌর্বল্য আমাদের এক তৃতীয়াংশ দুঃখের কারণ। আমরা যে একসঙ্গে মিলতে পারি না, পরস্পরকে ভালোবাসি না, তোতাপাখির মত কথা বলে যাই, আচরণে পশ্চাৎপদতা দেখাই–তার আসল কারণ হল আমরা শারীরিকভাবে দুর্বল। বেদের প্রার্থনায় তাই বলের উপাসনা, সামর্থ্যের উপাসনা, শক্তির উপাসনার কথা পাই–

“তেজেহসি তেজো ময়ি ধেহি। বীর্যমসি বীর্যং ময়ি ধেহি। বলমসি বলং ময়ি ধেহি। ওজোহস্যোজি ময়ি ধেহি।”

হে তেজস্বরূপ, আমায় তেজস্বী কর; হে বীর্যস্বরূপ, আমায় বীর্যবান কর; হে বলস্বরূপ, আমায় বলবান কর; হে ওজঃস্বরূপ, আমায় ওজস্বী কর।

ঋগ্বেদ সংহিতা উদ্বৃত করে বলছেন একচিত্ত হওয়াই সমাজ গঠনের রহস্য। “সং গচ্ছধ্বং সং বদধ্বং সং বো মনাংসি জানতাম।”

হিন্দু-বৌদ্ধ ধর্মের সমন্বয় ও স্বামীজি: স্বামী বিবেকানন্দ বৌদ্ধদের অজ্ঞেয়বাদ, জৈনদের নিরীশ্বরবাদ, গুরুগোবিন্দ সিংহের মতবাদের জায়গা হিন্দুধর্মে আছে বলে মনে করতেন। ১৮৯৩ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর শিকাগো ধর্ম মহাসভার ষোড়শতম দিনের অধিবেশনে তিনি বললেন, “Hinduism cannot live without Buddhism, nor Buddhism without Hinduism…the Buddhists cannot stand without the brain and philosophy of the Brahmins, nor the Brahmin without the heart of the Buddhist. This separation between the Buddhists and the Brahmins is the cause of the downfall of India.”

বৌদ্ধধর্ম ছাড়া হিন্দুধর্ম বাঁচতে পারে না। হিন্দুধর্ম ছেড়ে বৌদ্ধধর্মও বাঁচতে পারে না। ব্রাহ্মণের ধীশক্তি ও দর্শনের সাহায্য না নিয়ে বৌদ্ধরা দাঁড়াতে পারে না। বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্যের এই বিচ্ছেদই ভারতবর্ষের অবনতির কারণ। তিনি তাই দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন, “Let us then join the wonderful intellect of the Brahmin with the heart, the noble soul, the wonderful humanising power of the Great Master.”
তাই তিনি ‘প্রবুদ্ধ ভারত’ পত্রিকা প্রকাশে উদ্যত হয়েছিলেন ব্রাহ্মণের অভিনব ধীশক্তির সঙ্গে লোকগুরু বুদ্ধের হৃদয়, মহান আত্মা ও অসাধারণ লোককল্যাণশক্তি যোগ করতে।বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের হিন্দুধর্মের সাথে একই ছায়ার নিচে আনতে চেয়েছিলেন। ‘প্রবুদ্ধ’ কথাটির মধ্যে রয়েছেন হিন্দুদের দশাবতারের অন্যতম শেষ অবতার বুদ্ধ (প্র+বুদ্ধ = প্রবুদ্ধ)। তিনি মনে করতেন গৌতমবুদ্ধের সঙ্গে ভারত জুড়লে হিন্দুধর্মের সঙ্গে বৌদ্ধধর্মের সম্মিলন ঘটবে।

“I repeat, Shakya Muni came not to destroy, but he was the fulfilment, the logical conclusion, the logical development of the religion of the Hindus.” হিন্দুদের মনে কোন আঘাত না দিয়ে বৌদ্ধদের আকৃষ্ট করতে চেয়েছিলেন তিনি। এ প্রসঙ্গে আমাদের মনে পড়বে ‘প্রবুদ্ধ ভারতের প্রতি’ শীর্ষক তাঁর বিখ্যাত কবিতাটি– “আবার প্রবুদ্ধ হও! এ নিদ্রা, মৃত্যুতে নয়, জীবনেই ফিরাতে আবার, এ শুধু বিশ্রাম, যাতে চোখে ভাসে নতুন স্বপ্নের অদম্য সাহস। দেখো, হে সত্য, পৃথিবী চায় তোমাকেই, তুমি মৃত্যুহীন।”

স্বামী বিবেকানন্দ ও শিখধর্ম: ১৯০৩ সালের গ্রীষ্মকাল, মেদিনীপুর পৌঁছেছেন ভগিনী নিবেদিতা। দেশপ্রেমী যুবকেরা উল্লাসে চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘হিপ্ হিপ্ হুররে’। ‘না, না’; বারণ করে উঠলেন নিবেদিতা। ‘এটা ইংরেজ জাতির বিজয়োল্লাস, ভারতীয়দের তা কিছুতেই ব্যবহার করা উচিত নয়, কখনই নয়।’ হাত তুলে তিনি উচ্চৈস্বরে তিনবার বললেন — ‘ওয়া গুরুজীকি ফতে। বোল বাবুজীকি খালসা।’ গুরুর জয়, গুরুদেবের জয়, তিনিই আমাকে বাঁচিয়েছেন, তারই কৃপায় রক্ষা পেয়েছি। একদা এই ধ্বনি বীরত্বের লীলাভূমি পাঞ্জাবে বীরেন্দ্র দেশপ্রেমিক শিখেরা দিগ্ মন্ডল কম্পিত করে উচ্চারণ করত মোঘল শিখের রণে। দক্ষিণেশ্বরে নানকপন্থী সাধুরা আসতেন শ্রীরামকৃষ্ণ সান্নিধ্যে। তাঁরা শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে আধ্যাত্মিক আলোচনায় অংশ নিতেন। ১৮৮৩ সালের ২১ শে ডিসেম্বর, দিন উল্লেখ করে কথামৃতে রয়েছে, “অপরাহ্নে নানকপন্থী সাধু আসিয়াছেন। হরিশ, রাখালও আছেন। সাধু নিরাকারবাদী। ঠাকুর তাঁহাকে সাকারও চিন্তা করিতে বলিতেছেন।” (শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত, প্রথম খন্ড)। অনেকসময় পঞ্চবটীর তলায় এসে বসে থাকতেন নানকপন্থী সাধুরা। ঠাকুরের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল তাদের, যোগাযোগ ছিল চানক বা বর্তমান বারাকপুর পল্টনের সিপাই কুঁয়ার সিং-এর সঙ্গে। তিনি ঠাকুরকে ‘নানক’ জ্ঞানে শ্রদ্ধা করতেন; কারণ ঠাকুরের মধ্যে তো ধর্মের, সকল ধারার, সকল পন্থার বিকাশ! চানকের শিখ ও অন্যান্য সিপাইদের ঠাকুর আধ্যাত্মিক শিক্ষা দিয়েছেন, অভ্যাস যোগ করতে বলেছেন। এইভাবেই হিন্দু-শিখ ধর্মকে কাছাকাছি এনে ফেলছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ।

এবার ঠাকুরের শিষ্য স্বামীজির উপর বর্তালো হিন্দু-শিখ সমন্বয়-নদীতে জোয়ার আনতে। ‘হিন্দুধর্মের সাধারণ ভিত্তি’ বিষয়ে লাহোরে ধ্যান সিং-এর হাবেলীতে শিকাগো বিজয়ের পর ১৮৯৭ সালে বক্তৃতা দিলেন স্বামীজি (দ্রষ্টব্য: বিবেকানন্দ রচনা সমগ্র, অখণ্ড বাংলা সংস্করণ, নবপত্র প্রকাশন, কলকাতা, পৃ. ৭৭০-৭৭৬)। বললেন, “এখানেই অপেক্ষাকৃত আধুনিক কালে দয়াল নানক তাঁর অপূর্ব বিশ্বপ্রেম প্রচার করেন। এখানেই সেই মহাত্মা তাঁর প্রশস্ত হৃদয়ের দ্বার খুলে এবং বাহু প্রসারিত করে সমগ্র জগৎকে — শুধু হিন্দুকে নয়, মুসলমানদেরও পর্যন্ত আলিঙ্গন করতে ছুটে গিয়েছিলেন। এখানেই আমাদের জাতির শেষ এবং মহামহিমান্বিত বীরগণের অন্যতম গুরু গোবিন্দ সিংহ জন্মগ্রহণ করেন।……. আমাদের মধ্যে কী কী বিভিন্নতা আছে তা প্রকাশ করবার জন্যে আমি এখানে আসিনি। এসেছি আমাদের মিলনভূমি কোথায় তাই অন্বেষণ করতে। কোন ভিত্তি অবলম্বন করে আমরা চিরকাল সৌভ্রাতৃসূত্রে আবদ্ধ থাকতে পারি। কোন ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হলে যে বাণী অনন্তকাল ধরে আমাদের আশার কথা শুনিয়ে আসছে, তা প্রবল থেকে প্রবলতর হতে পারে, তা বোঝার চেষ্টা করতে আমি এখানে এসেছি।” দেখা যাচ্ছে বহুধা বিদীর্ণ ধর্মীয় মতবাদের মাঝে যোগসূত্র স্থাপনে অনন্য প্রয়াস-সাধনে হাত দিয়েছেন বীর সন্ন্যাসী। শিখ গুরুর মতই তিনি বীর। স্বামীজি বলেছিলেন, “বর্বর জাতির আক্রমণ-তরঙ্গ বারবার আমাদের এই জাতির মস্তিষ্কের ওপর দিয়ে চলে গেছে। শত শত বছর ধরে ‘আল্লা হো আকবর’ রবে ভারতের আকাশ মুখরিত হয়েছে। আর সেই সময় এমন কোনো হিন্দু ছিল না যে প্রতি মুহূর্তে নিজের বিনাশের আশঙ্কা করেনি।” (লাহোরে প্রদত্ত স্বামীজির বক্তৃতা, বিষয়: হিন্দুধর্মের সাধারণ ভিত্তি, তথ্যসূত্র: ঐ, পৃ. ৭৭১)।

শিখপন্থার মানুষের কাছে স্বামীজির বার্তা ছিল, “যদি পারি তাহলে আমাদের পরস্পরের মিলনভূমি আবিষ্কার করার চেষ্টা করব এবং যদি ঈশ্বরের কৃপায় এ সম্ভব হয় তাহলে ঐ তত্ত্ব কাজে পরিণত করতে হবে।”

ধর্ম ভারতবর্ষের আত্মা: স্বামীজী রাষ্ট্রের আত্মার কথা বলেছেন। বলেছেন এই আত্মাতে যতদিন না ঘা পড়ে, ততদিন সেই রাষ্ট্রের মৃত্যু নেই। স্বামীজী উদাহরণ দিচ্ছেন রাষ্ট্রের আত্মা বা রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয়ত্ব যেন সাপের মাথার মণি, যেন রূপকথার জগতে রাক্ষসীর প্রাণভোমরা। যতক্ষণ রূপকথার সাপের মাথায় মণি থাকবে ততক্ষণ তাকে মারা যাবে না। যতক্ষণ রাক্ষসীর প্রাণভোমরা-রূপ ক্ষুদ্র পাখির ভিতর তার প্রাণ ততক্ষণ তাকে মারা যাবে না। সাপ বা রাক্ষসীকে মারতে হলে মাথার মণি সরাতে হবে, সেই প্রাণপাখিকে টুকরো করে কেটে ফেলতে হবে। স্বামীজী বলছেন, ভারতবর্ষের যে রাষ্ট্রীয় সৌধ, ভারত রাষ্ট্রের যে মেরুদণ্ড তার আত্মা রয়েছে ধর্মে। ভারতের রাষ্ট্রীয় জীবন নিহিত আছে হিন্দুধর্মে। তিনি ভারত রাষ্ট্রের মন ও প্রাণপ্রবাহের স্বরূপ চিহ্নিত করেছিলেন। বলেছিলেন ধর্ম অনুসরণ করলেই দেশ গৌরবান্বিত হবে। ধর্ম পরিত্যাগ করলে রাষ্ট্রীয় মৃত্যু অনিবার্য। বৈদেশিক আগ্রাসনকারীর অত্যাচারে মন্দিরের পর মন্দির ধবংস হয়েছে, নেমে এসেছে নানাবিধ আক্রমণ, ধ্বংসলীলা। কিন্তু অত্যাচারের স্রোত সামান্য বন্ধ হওয়ামাত্র পুনরায় উঁকি মেরেছে মন্দিরের চূড়া, স্পষ্টতর হয়েছে পুনরাভ্যুত্থানের চিহ্ন। ধ্বংসাবশেষ থেকে উত্থিত হয়েছে নতুন জীবন, সে জীবন অটল-অচল ভাবে বিরাজ করেছে আগের মতই। রাক্ষসীর প্রাণ-পাখির মত ভারতবর্ষের ধর্ম-রূপ প্রাণ-পাখিকে বিনাশ করা যায়নি বলেই এত সয়ে এ জাতটা বেঁচে গেল। হাজার হাজার বছরের স্বভাব — তা মরবেই বা কী করে? স্বামীজী ভারতবর্ষের এই জাতীয় চরিত্র বদলের কথা বলেননি। তাঁর মতে যে নদী পাহাড় থেকে হাজার ক্রোশ নেমে আসে তাকে ফের পাহাড়ে ফিরিয়ে দেওয়া যায় না। বলছেন, যদি এ দশ হাজার বৎসরের জাতীয় জীবনটা ভুল হয়ে থাকে তো এখন উপায় নেই, এখন একটা নূতন চরিত্র গড়তে গেলেই মরে যাবে বই তো নয়। বলছেন, যে দেশের প্রাণ ধর্ম, ভাষা ধর্ম, ভাব ধর্ম সে দেশকে ধর্মের মধ্য দিয়েই সব করতে হবে। “রাস্তা ঝেঁটানো, প্লেগ নিবারণ, দুর্ভিক্ষগ্রস্তকে অন্নদান, এসব চিরকাল এদেশে যা হয়েছে তাই হবে, অর্থাৎ ধর্মের মধ্য দিয়ে হয় তো হবে, নইলে ঘোড়ার ডিম, তোমার চেঁচামিচিই সার..।”

ভারতবর্ষের পক্ষে ধর্মের মধ্য দিয়ে ছাড়া কাজ করবার যে অন্য উপায় নেই তা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় স্বামীজী জানিয়েছেন। শুধু তাই নয়, সতর্ক করে তিনি বলেছেন ধর্ম ছেড়ে জড়বাদসর্বস্ব সভ্যতার অভিমুখে ধাবিত হলে ভারতবর্ষের সুবিশাল রাষ্ট্রীয় সৌধ তিনপুরুষ যেতে না যেতেই বিনষ্ট হবে, হিন্দুর মেরুদন্ড ভেঙ্গে যাবে। এ প্রসঙ্গে স্বামীজীর পরামর্শ হল, যে অমূল্য ধর্মসম্পদ উত্তরাধিকার সূত্রে আমরা পেয়েছি তা প্রাণপণে ধরে রাখতে হবে। এখানেই তিনি থেমে থাকেননি। বলেছেন, তোমরা ধর্মে বিশ্বাস কর বা নাই কর, যদি জাতীয় জীবনকে অব্যাহত রাখতে চাও, তবে তোমাদিগকে এই ধর্মরক্ষায় সচেষ্ট হইতে হইবে। তিনি একহাতে দৃঢ়ভাবে ধর্মকে ধরে অন্য হাত প্রসারিত করতে বলেছেন শেখবার জন্য, বলেছেন সেই শিক্ষণীয় বিষয় যেন হিন্দুজীবনের মূল আদর্শের অনুগত হয়। “What we want are western science coupled with Vedanta and Brahmacharya as the guiding motto.” এটিই হচ্ছে নতুন যুগের বিশ্বায়নের মূলমন্ত্র। পাশ্চাত্য বিজ্ঞানের সঙ্গে বেদান্তের সমন্বয়, যার মূলে থাকবে ব্রহ্মচর্য। স্বামীজী শিক্ষা ও ধর্মকে ভিন্ন ভিন্ন করে দেখাননি। ধর্ম হচ্ছে শিক্ষার ভেতরকার সার জিনিস। শিক্ষার লক্ষ্য মানুষ গড়া, ধর্মের লক্ষ্যও তাই। ধর্ম ও শিক্ষা একে অপরের পরিপূরক, বিকাশ ধারার দুই পথ। উভয়ের উদ্দেশ্যই মানুষের মধ্যে ঈশ্বরের বিকাশ। “Religion is the idea which is raising the brute unto man, and man unto God.”

স্বামীজীর শিক্ষাভাবনায় ধর্মের একটি বিরাট ভূমিকা ছিল। তিনি বলেছেন, যাহাতে তাহারা নীতিপরায়ণ, মনুষ্যত্বশালী ও পরহিতরত হয় এই প্রকার শিক্ষা দিবে। ইহারই নাম ধর্ম।… ধর্মের যাহা সার্বজনীন সাধারণ ভাব তাহা শিখাইবে। দেশের শিক্ষাদর্শনের সঙ্গে শিক্ষার ভাবসামঞ্জস্য থাকার কথা বলেছেন। শিক্ষা যেন জাতির নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের অনুগামী হয়। স্বামীজী পূর্বের মত ব্রহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন, ব্রহ্মচর্যকে শিক্ষার বিশেষ সহায়ক বলে অভিহিত করেছেন। ব্রহ্মচর্য একাগ্রতার সহায়ক ও অসীমশক্তি দায়ক যা বিদ্যার্থীর বিদ্যা অর্জনে একান্ত প্রয়োজনীয়। এতে আত্ম সংযমের অনুশীলন হয়, প্রবল সক্রিয়তা আর ইচ্ছাশক্তি জাগরূক হয়।

উপসংহার: স্বামীজি বলেছেন, সমগ্র বিশ্বে একটি ধর্ম কখনই থাকতে পারে না। বলেছেন, কোনো ধর্মকেই ঘৃণা করা উচিত নয়। সেই তিনিই শিয়ালকোটে ‘ভক্তি’ বিষয়ক বক্তৃতা দিতে গিয়ে বললেন, “যে ধর্ম অন্যায়-কাজের পোষকতা করে সেই ধর্মের প্রতিও কি সম্মান দেখাতে হবে? এর উত্তর ‘না’ ছাড়া আর কি হতে পারে? এই সব ধর্ম যত শীঘ্র দূরীভূত করা যায় ততই মঙ্গল। কারণ ঐ ধর্মের দ্বারা লোকের অকল্যাণই হয়ে থাকে।” (স্বামীজির শিয়ালকোটে প্রদত্ত বক্তৃতা, বিষয় — ভক্তি; সূত্র: বিবেকানন্দ রচনা সমগ্র (অখণ্ড বাংলা সংস্করণ, নবপত্র প্রকাশন, কলকাতা, পৃ. ৭৬৮)। হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, শিখ–বিশ্বের এই চারটি ধর্মের উৎসভূমি ভারতবর্ষ। আলাদা ধর্ম বলা হলেও তা যে আদতে একই ধর্মের কুসুমোদ্যানে প্রস্ফুটিত পৃথক ফুল – সেই শাশ্বত সত্যটি প্রকাশ করাই বর্তমান ভারতে একান্ত জরুরী।

আপনাদের মতামত জানান

Please enter your comment!
Please enter your name here