পূর্ববঙ্গের হিন্দু স্মৃতি (৯৫) বাড়িটির দিকে তাকালে আপনার চোখ আটকে যাবে এবং চোখ সরাতে বেগ পেতে হবে

আমাদের ভারত, ৯ মে: “ঢাকার ফরাসগঞ্জের বি কে দাস রোডের ৪৫ নম্বর বাড়িটির দিকে তাকালে আপনার চোখ আটকে যাবে এবং চোখ সরাতে বেগ পেতে হবে একথা আমি হলফ কেটে বলতে পারি। দ্বিতল এই বাড়িটির সামনের ফরাসি নকশা, বাঁকানো ঝুল বারান্দা, চূড়ার কারুকাজ, করিস্থিয়ান পিলার আর দোতলার বারান্দার নীচে আঙুরের থোকার মত ঝুলে থাকা লতা পাতার শিল্পকর্মটি আপনাকে বিস্মিত করবে। একটি ভগ্নস্তুপের মত ভবন তার ধ্বংসপ্রায় চেহারা দিয়ে এখনও যে আপনাকে আবিষ্ট করে দিতে পারে, তা এই বাড়িটির ক্ষেত্রে সত্য।

অনেকবার শুধু এই বাড়িটি দেখতে বিকে দাস লেনে গিয়েছি। প্রতিবারেই মনে শঙ্কা জাগে, না জানি কী ক্ষয়ে গেল, কী ধ্বসে গেল বাড়িটির দেহ থেকে। নিতান্ত কৌতূহল বসে ইন্টারনেটে বড় বাড়ির পুরনো দিনের ছবি খুঁজছিলাম। বাড়িটির চেহারা কেমন ছিল, সেটা দেখার আগ্রহ থেকেই এই খোঁজাখুঁজি। দুটি ছবি পেলাম যার একটি সম্মুখ ভাগের আর অপরটি অন্দর মহলের, যেখানে এলিভেটেড ওয়াকওয়ে এর পূর্ণ চেহারা দেখা যায়। পূর্ণ যৌবনে বাড়িটির সৌন্দর্য কেমন চোখ ধাঁধানো ছিল সে কথা ভেবে অবাক হই।

বরিশালের বড়ঘর এস্টেটের জমিদার ( কেউ কেউ বলেন যে সুদের কারবারি) ও সমাজ সেবক বসন্ত কুমার দাস (যার নামে এই বাড়ির সম্মুখের রাস্তাটির নাম করন হয় বিকে দাস লেন)। এর ভ্রাতা প্রসন্ন কুমার দাস এই বাড়িটি তৈরি করেন ১৯০৫ থেকে ১৯১০ সনের মধ্যে। এলাকার মানুষ এই বাড়িটিকে ডাকে বড় বাড়ি বলে।

কয়েকটি বৈশিষ্ট্যের জন্য এই বাড়িটি ঢাকার একটি ইউনিক স্থাপনা। এই বাড়িটি বহু আঙিনা বিশিষ্ট, এটার নির্মাণ শৈলী ফরাসি রকোকো (rococo) স্টাইলের আর সম্ভবত পুরানো ঢাকার একমাত্র এই বাড়িটিতেই এলিভেটেড ওয়াকওয়ে আছে; যেটি বহিঃমহল এর দোততলা ও অন্দর মহলের দোতলাকে একটি সার্কেলের মত যুক্ত হয়েছে দুই দিক থেকে। ওয়াক ওয়েগুলো বাড়ির সীমানায় উত্তর থেকে দক্ষিন দিকে স্থাপিত ভারী পিলারের উপর অবস্থিত। অন্দর মহল ও বহিঃমহলের মাঝে একটি বড় উঠোন বা কোর্ট ইয়ার্ড। অন্দর মহলের পেছনে আরও একটি কোর্টইয়ার্ড রয়েছে। বাড়িটি একহারা লম্বা। এটি দৈর্ঘ্যে ২৫০ ফুট ও প্রস্থে ৩৩ ফুট এর মত।

বর্তমানে এই বাড়িটি ব্যক্তি মালিকানায় বিভিন্ন দোকান, কারখানা ও গুদামের কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। বহিঃমহলের উপর তলায় অবস্থিত বই বাঁধাইয়ের মেশিনের ঝাকুনিতে কখন এটি ভেঙ্গে পড়ে সেটাই একটা আশঙ্কার বিষয়।

‘বড় বাড়ি’ ফরাশগঞ্জ এর অলংকার। আমাদের অতীত ঐতিহ্যের অনন্য নিদর্শন। এটি ধ্বংস প্রাপ্ত হলে, একটি অনন্য সুন্দর স্থাপনা হারাবে বাংলাদেশ। এটিকে রক্ষা বা সংস্কারের নানা কথা নানা সময়ে শোনা গেলেও দিনে দিনে এটি ক্ষয়ে যাচ্ছে অযত্নে ও অবহেলায়। প্রত্ন তত্ব বিভাগের উচিত এই বাড়িটিতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সংরক্ষণ করা।”

ঋণ— পথে প্রান্তরে, সোহেল মাহবুবুরের পোস্ট।
তথ্যসূত্র: ডেইলি স্টার, প্রথম আলো।
দুটি ছবিতে প্রায় পাঁচ দশক আগের এবং এখনকার বাড়ির একাংশ।
সঙ্কলন— অশোক সেনগুপ্ত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *