পূর্ববঙ্গের হিন্দুস্মৃতি বিশেষ সাপ্তাহিক সাক্ষাৎকার (৭) “হিন্দুদের জন্য পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য গঠিত হলেও আজও তাদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত হয়নি“— নিরঞ্জন রায়

“১৯৪৭ সালে বাংলা ভাগের মাধ্যমে বাঙালি হিন্দুদের জন্য পৃথক হোমল্যান্ড পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য গঠিত হলেও অদ্যাবধি বাঙালি হিন্দুদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত হয়নি। পশ্চিমবঙ্গের মালদা, মুর্শিদাবাদ, হাওড়া-হুগলী ও উত্তর ২৪পরগনার বিভিন্ন স্থানে অতি নগণ্য কারণে হিন্দুদের উপর নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে।”
“এখানে মনে রাখতে হবে যে ধর্মনিরপেক্ষতা মানে দুর্বলতা নয়। আমাদের চারপাশের রাষ্ট্রগুলো ধর্মনিরপেক্ষ নয়, অত্যন্ত মৌলবাদী। সুতরাং শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে আমাদের যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন।”

__________________________________
*দেশভাগের প্রত্যক্ষ শিকার। ‘ময়মনসিংহ সম্মিলনী’-র সহ-সভাপতি। দক্ষিণ কলকাতার একটি সুপরিচিত স্কুলের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক।*
———————————————————

অশোক সেনগুপ্ত, আমাদের ভারত, ২৮ মে:
প্রশ্ন ১) আপনার সঙ্গে পূর্ববঙ্গের সম্পর্কটা ঠিক কিরকম?

উত্তর— আমার সঙ্গে পূর্ব বঙ্গের সম্পর্কটা নাড়ির টান বা শিকড়ের টান। ১৯৩৭ সালের ২৬ নভেম্বর বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার হাসনপুর গ্রামে আমার জন্ম ও বড় হয়ে ওঠা। সুতরাং জন্মভূমি ছেড়ে আসার বেদনা এখনও ভীষণ ভাবে কষ্ট দেয়।

প্রশ্ন ২) পূর্ব বঙ্গের হিন্দু নিধনের ব্যাপারটা কোন সময়ে, কীভাবে আপনার মনে দাগ কেটেছিল?

উত্তর— ১৯৪৭ সালে পূর্ব বাংলা পূর্ব পাকিস্তান গঠিত হওয়ার পর থেকেই হিন্দু নিধন ব্যাপারটা ব্যাপক ভাবে শুরু হয়। অবশ্য তার আগেও ইতস্ততঃ বিচ্ছিন্ন ভাবে হিন্দুদের বাড়ি ঘরে অগ্নি সংযোগ, দোকান পাটে লুটতরাজ, জমি জমা বেদখল ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য আকারে বৃদ্ধি পায়। আমার শৈশব মনেও একটা ভয়াবহ আতঙ্ক ও নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি হয়।

প্রশ্ন ৩) কেন সাবেক পূর্ববঙ্গ এবং পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দু জনসংখ্যা এভাবে কমে গেল?

উত্তর— নিরাপত্তাহীনতার কারণে আমরা গ্রাম থেকে ময়মনসিংহ শহরে বাসাবাড়িতে চলে এলাম। গ্রামের বাড়িতে রয়ে গেলেন শুধু বিধবা ধনপিসি। তিনি বলতেন, “যে ভিটাতে জন্মাইছি, সেইখানেই মরব। দেশ-ত্যাগ করব না।”

শহরের পরিস্থিতিও ক্রমাগত খারাপ হতে থাকে। প্রায়শই রাতে কোথাও না কোথাও হিন্দুদের বাড়ি ঘরে অগ্নি সংযোগের ঘটনা ঘটেছে। এই পরিস্থিতিতে ভয়ে, আতঙ্কে ও নিরাপত্তাহীনতার কারণে পূর্ব পাকিস্তান থেকে দলে দলে হিন্দুরা দেশত্যাগ করে হিন্দুস্তান বা ভারতে শরনার্থী হিসেবে চলে আসেন। এই ধারা এখনও অব্যাহত রয়েছে।

বিগত সাত দশক ধরে ওপার বাংলা থেকে সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বী জনগোষ্ঠী এপার বাংলায় চলে এসেছেন— একথা ধ্রুব সত্য। দেশবিভাগের পূর্বে পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দু জনসংখ্যা ছিল ৩২/৩৩ শতাংশ, আর এখন তা কমে হয়েছে ৭/৮ শতাংশ। হিন্দুদের এই দেশত্যাগের কারণ কী? তাদের বাসস্থান ছিল, বস্ত্র ছিল, খাদ্য ছিল। কিন্তু ছিল না নিরাপত্তা, ছিল না বাক-স্বাধীনতা, ছিল না নিজ ধর্ম পালনের অধিকার, ছিল না স্বাধীন নাগরিকত্বের অধিকার। একটি বাস্তু সাপও সহজে ভিটাত্যাগ করে না, আর সংবেদনশীল মানুষ কতটা যন্ত্রনা-ব্যথা নিয়ে তাঁর পৈতৃক ভিটা-মাটি ত্যাগ করে শরনার্থী হয়ে এপার বাংলায় চলে আসতে বাধ্য হয়েছেন!

প্রশ্ন ৪) ওই পরিস্থিতিতে দু’দেশের প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকা কী ছিল?

উত্তর— ১৯৪৭ সালে দ্বি-জাতি তত্বের ভিত্তিতে ভারত বিভাজনের সময় থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দুরা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে গণ্য হয়। তাদের বিষয় সম্পত্তি, ব্যবসা-বাণিজ্য ও স্বাধীনভাবে জীবন-যাপনের নিরাপত্তা চলে যায়।
তখন থেকেই শুরু হয় হিন্দুদের ক্রমাগত দেশত্যাগের ঘটনা। এই পরিস্থিতিতে তৎকালীন দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকা মোটেও সন্তোষজনক ছিল না। ক্ষমতা লাভের আগ্রহই তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল। সুষ্ঠু ভাবে জনসংখ্যার বিনিময়ের কোনও বাস্তবায়নের পরিকল্পনা ছিল না। ধর্মীয় ভিত্তিতে দেশভাগ পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দুদের জীবনে নেমে আসে এক দুর্বিষহ দুর্গতি। তাঁদের মনে প্রশ্ন জাগে— এ কেমন স্বাধীনতা!

১৯৫০ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নেহেরু ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলির মধ্যে দুই দেশের সংখ্যলঘুদের নিরাপত্তার জন্য একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। গঠিত হয় সংখ্যালঘু কমিশন। কিন্তু বাস্তবে এর কোনো কার্যকর পদক্ষেপ বা ভূমিকা নেওয়া হয়নি। প্রতিবাদে ড: শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় নেহেরুর মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন। নেহেরু-লিয়াকত চুক্তি সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়।

প্রশ্ন ৫) মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে পূর্বপাকিস্তানে হিন্দুদের অবস্থা কীরকম ছিল?

উত্তর— ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালি জাতীয়তাবাদের ও ধর্মনিরপেক্ষতার চেতনার বিকাশ লাভ হলেও তা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ১৯৭৫ সালে জাতির পিতা শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ডের পর তা বিনষ্ট ও পরিত্যক্ত হয়। রাষ্ট্রপতি এরশাদের আমলে সংবিধানে ইসলামকে বাংলাদেশের রাষ্ট্র ধর্ম বলে গৃহীত হয় এবং উগ্র মৌলবাদের উত্থান ঘটে। স্বাধীন বাংলাদেশে এখনও মৌলবাদী প্রভাব যথেষ্ট পরিমাণে বিদ্যমান।

প্রশ্ন ৬) কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও কি ওপার থেকে এপারে আসার ঢল অব্যাহত রয়ে গেছে?

উত্তর—মাদ্রাসা শিক্ষার বিস্তারের ফলে উগ্রপন্থীরা নানা কারণে হিন্দুদের উপর অত্যাচার ও মন্দির বা পূজামণ্ডপে আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে।
সুতরাং বাংলাদেশে হিন্দুরা নিরাপদ অবস্থায় নেই। সুযোগ পেলেই তাঁরা ওপার থেকে এপারে চলে আসেন। পশ্চিমবঙ্গ আবার ধর্মীয়ভাবে বিপন্ন।

প্রশ্ন ৭) সাম্প্রদায়িকতা পশ্চিমবঙ্গের অবস্থাকে কীভাবে প্রভাবিত করেছে?

উত্তর— পশ্চিমবঙ্গ এখন ধর্মীয় ভাবে কিছুটা বিপন্ন। কয়েক দিনের মধ্যে হাওড়া জেলার বিভিন্ন জায়গায় যেভাবে হিংসাত্বক ঘটনা ও অবরোধ আন্দোলন সংঘটিত হয়েছে তা খুবই উদ্বেগজনক। এটা শুধু যাত্র প্রচার নয়, বাস্তব পরিস্থিতি।

১৯৪৭ সালে বাংলা ভাগের মাধ্যমে বাঙালি হিন্দুদের জন্য পৃথক হোমল্যান্ড পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য গঠিত হলেও অদ্যাবধি বাঙালি হিন্দুদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত হয়নি। পশ্চিমবঙ্গের মালদা, মুর্শিদাবাদ, হাওড়া-হুগলী ও উত্তর ২৪পরগনার বিভিন্ন স্থানে অতি নগণ্য কারণে হিন্দুদের উপর নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। ওই সব এলাকায় বসবাসকারী হিন্দুরা আদৌ নিরাপদ নন।

ভারত একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। এখানে সকল ধর্মাবলম্বীদের স্বাধীনভাবে বসবাসের অধিকার আছে। কিন্ত তাই বলে যেখানে হিন্দুদের বসতি অপেক্ষাকৃত কম, তারা নির্যাতিত হবে? সব দিক পর্যালোচনা করলে মনে হয় পশ্চিমবঙ্গ আবার ধর্মীয়ভাবে বিপন্ন। ইদানিং সামান্য ধৰ্মীয় ভাবাবেগ নিয়ে যে অশান্তি ও হিংসাত্বক কার্যকলাপ সংঘটিত হচ্ছে তা খুবই চিন্তার বিষয়! রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলা বিনষ্টকারীদের কঠোর হস্তে দমন করা প্রয়োজন। এখানে মনে রাখতে হবে যে ধর্মনিরপেক্ষতা মানে দুর্বলতা নয়। আমাদের চারপাশের রাষ্ট্রগুলো ধর্মনিরপেক্ষ নয়, অত্যন্ত মৌলবাদী। সুতরাং শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে আমাদের যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন।

প্রশ্ন ৮) বিএনপি-র চেয়ে আওয়ামি লীগ বাংলাদেশের হিন্দুদের কাছে কি বেশি আদরনীয় নয়?

উত্তর— আগামী বছরে (২০২৪) বাংলাদেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হাওয়ার কথা। যদি বি এন পি ক্ষমতায় আসে, আমার অনুমান হিন্দুদের অবস্থা আরও খারাপ হবে। কারণ বিএনপির সঙ্গে জামাতের ও অন্যান্য মৌলবাদী সংগঠনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বা জোট রয়েছে। তাছাড়া বিএনপির চেয়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে ভারত সরকারের সম্পর্ক অপেক্ষাকৃত ভালো।

আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে বাংলাদেশে হিন্দুদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে ভারত সরকারের চাপ সৃষ্টি ও আলোচনার সুযোগ থাকবে। তবে একথা ঠিক যে বর্তমান পরিস্থিতির উন্নতি না হলে বাংলাদেশে হিন্দুদের বসবাস করা খুব কঠিন হবে।

প্রশ্ন ৯) বিজেপি সরকার ভারতে কেন্দ্রীয় স্তরে আসার পরেও কেন বাংলাদেশের হিন্দুরা যথেষ্ঠ মনোবল পেলেন না?

উত্তর— ভারতে কেন্দ্রীয় স্তরে বিজেপি সরকার আসার পরেও বাংলাদেশের হিন্দুরা যথেষ্ট মনোবল পায়নি, কারণ বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র নীতির কোনও পরিবর্তন হয়নি, বরং উগ্র মৌলবাদের উত্থান ঘটেছে। তাছাড়া ধর্মভীরু হিন্দুরাও যথেষ্ট সঙ্ঘবদ্ধ নয়।


ছবি: ১৯৯৬ সালের ২২ ডিসেম্বর, ঢাকায় বঙ্গভবনে তৎকালীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মাননীয় বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদকে একটি কাশ্মীরি শাল উপহার হিসেবে প্রদান করছেন ময়মনসিংহ সম্মিলনীর প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক শ্রী নিরঞ্জন রায়।

প্রশ্ন ১০) বাংলাদেশে হিন্দুদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আপনার অনুমান কী?

উত্তর— বাংলাদেশে হিন্দুদের কোনও ভবিষ্যৎ নেই, কারণ তাঁরা জানেন উগ্র মৌলবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে বাঁচার শক্তি ও সাহস তাঁদের নেই। সুতরাং ভবিষ্যতে বাংলাদেশে কোনো হিন্দু থাকতে পারবে না।
***

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *