পশ্চিমবঙ্গ সৃষ্টির ইতিবৃত্ত

রজত মুখার্জি

আমাদের ভারত, ২০ জুন: আজ সেই ঐতিহাসিক ২০শে জুন, যে দিনটিকে আমরা অত্যন্ত কৃতজ্ঞচিত্তে “পশ্চিমবঙ্গ দিবস” হিসেবে পালন করে থাকি।

কিন্ত পশ্চিমবঙ্গ দিবস পালনের উদ্দেশ্য বা এই বিশেষ দিনটির তাৎপর্য সম্পর্কে আমরা অনেকেই হয়তো ঠিকঠাক অবহিত নই কারণ পূর্বতন কংগ্ৰেস, বাম বা বর্তমানের তৃণমূল সরকার সুকৌশলে আমাদের এই ইতিহাস জানতে দেয়নি। এই ইতিহাস আমাদের স্কুল কলেজের কোনও পর্যায়ের পাঠ্যক্রমে রীতিমত ইচ্ছাকৃত ভাবে লিপিবদ্ধ করা হয়নি। বাম কংগ্রেসের মনে সবসময় একটা ভীতি কাজ করত যে পশ্চিমবঙ্গ সৃষ্টির প্রকৃত ইতিহাস সামনে এলে তাদের রাজনৈতিক অস্তিত্বের মারাত্মক একটা সংকট দেখা দিতে পারে।

আসুন একনজরে দেখে নেওয়া যাক পশ্চিমবঙ্গ সৃষ্টির কারণ সমূহ।

১৯৪৭ সালের গোড়ার দিকে ক্ষমতার লোভে আক্রান্ত কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ স্বীকার করে নিলেন বৃটিশ শাসকের প্রস্তাবিত ভারত ভাগের সিদ্ধান্ত। এখানে মাউন্ট ব্যাটেনের দূরদর্শী কূটনৈতিক চক্রান্ত ও ক্ষমতালোভী জিন্নার প্রবল ইচ্ছাশক্তি বৃটিশদের মনোরথ পূরণে ভীষণ ভাবে সহায়ক হয়েছিল। অগ্রপশ্চাত বিবেচনা না করেই তদানীন্তন কংগ্ৰেসী নেতৃবৃন্দ হয়ে উঠেছিলেন বৃটিশ শাসক দলের ইয়েসম্যান, যে কারণে বৃটিশ শাসকদের অভীষ্ট চরিতার্থে কোনও রকম বেগ পেতে হয়নি।

সে সময় অবিভক্ত বাংলার মোট জনসংখ্যার ৫৫% ছিল মুসলিম ও অবশিষ্ট ৪৫% হিন্দু। মুসলিম সমাজের চিরাচরিত রীতি অনুসরণ করেই মুসলিম লীগ দাবি তুলল যে গোটা বাংলাই পাকিস্তানকে দিতে হবে, যেহেতু সংখ্যাধিক্য তখন মুসলিমদের পক্ষে। এই দাবি গৃহীত হলে অসমও বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত এবং কালক্রমে সেটাও চলে যেত পাকিস্তানের মানচিত্রে। কিন্তু মুসলিম লীগের এই চক্রান্ত বিফল হল, বাধ সাধলেন ভারত কেশরী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ই একমাত্র ব্যক্তি, যিনি তাঁর বিশাল রাজনৈতিক দূরদর্শিতা বলে বুঝতে পেরেছিলেন ইসলামী পাকিস্তান কখনোই হিন্দুদের জন্য বসবাসযোগ্য তো হবেই না বরঞ্চ কালের আবহে তা পরিণত হয়ে উঠবে বসবাসের অযোগ্য এক নরকে। সেইজন্য তিনি দাবি করলেন, ভারত ভাগ করলে বাংলাকেও ভাগ করে বাংলার হিন্দুপ্রধান অঞ্চলগুলি নিয়ে একটা ‘পশ্চিমবঙ্গ’ সৃষ্টি করতে হবে, যা হবে হিন্দুপ্রধান ভারতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গরাজ্য।

একেবারে রনংদেহী মনোভাব নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ সৃষ্টির দাবিতে প্রচার করার জন্য শ্যামাপ্রসাদ চষে বেড়ালেন সমগ্র বঙ্গ এবং বলা বাহুল্য, হিন্দুদের স্বার্থ রক্ষার্থে তাঁর এই মহান কর্মযজ্ঞে পেয়ে গেলেন অনেকেরই নিঃশর্ত সমর্থন, যা তাঁকে মানসিক ভাবে অনেকটাই বলীয়ান করেছিল। তাঁর এই লড়াইয়ে প্রত্যাশিত ভাবেই সমর্থন পেয়েছিলেন কংগ্রেসেরও। সেই সময়কার একাধিক বাঙালি হিন্দু মনীষীরা, যেমন সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, যদুনাথ সরকার, রমেশচন্দ্র মজুমদার প্রমুখ বিদ্বজন অকুন্ঠ সমর্থন করলেন শ্যামাপ্রসাদ ও তাঁর হিন্দুপ্রধান বাঙালী হোমল্যান্ড সৃষ্টির দাবিকে। এই বিপুল জন সমর্থনের জেরেই বঙ্গীয় আইনসভা একরকম বাধ্য হল বাংলা ভাগ করার প্রস্তাব পাশ করতে। সে দিনটা ছিল ২০শে জুন ১৯৪৭।

শ্যামাপ্রসাদের অদম্য জেদ ও নিরলস প্রয়াসে সেদিন পশ্চিমবঙ্গ সৃষ্টি হয়েছিল বলে আমরা বাঙালি হিন্দুরা নিজেদের ভূমি পেয়েছিলাম, যার ফলশ্রুতি স্বরূপ আমরা আজ সগর্বে নিজেদের ভারতীয় বলে দাবি করতে পারছি। অন্যথায় আজ আমরা ইসলামী রাষ্ট্রে সংখ্যালঘুর তকমা নিয়ে পরাধীনতার নির্মম শৃঙ্খলে আবদ্ধ থাকতে বাধ্য হতাম।

বঙ্গ বিভাজন হল এবং তা হল দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতেই। শ্যামাপ্রসাদের আশঙ্কাকে সত্য প্রমাণিত করেই পূর্ব পাকিস্তান (অধুনা বাংলাদেশ) থেকে একে একে এদেশে আসতে শুরু করলেন নির্যাতনের শিকার হওয়া হিন্দুরা। ভূমিচ্যুত হতে থাকলেন ভূমিদস্যুদের আগ্রাসনে। নারীর সম্ভ্রম অরক্ষিত, ধর্ষণ সহ বিভিন্নভাবে লালসার শিকার হতে শুরু করলেন হিন্দু বাড়ির মা বোনেরা।

আক্ষেপের বিষয় এই যে পূর্ববঙ্গ থেকে রাতের অন্ধকারে পালিয়ে এসে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নেওয়া আত্মবিস্মৃত বাঙালী এখানে এসে আবার সাম্যবাদের বুলি আউড়ানো শুরু করেছে যার ফলস্বরূপ আজ আবারও একবার এই পশ্চিমবঙ্গের বুকে হিন্দুদের “নিজভূমে পরবাসী” হওয়ার উপক্রম। ২০২১ নির্বাচন পরবর্তী একটার পর একটা ঘটে চলা হিন্দু নিপীড়নের সংবাদ আজ আর কারো অজানা নয়। মেরুদন্ড বন্ধক রাখা মিডিয়া সে সমস্ত সংবাদ পরিবেশন না করলেও সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে কিছুই আজকাল গোপন থাকে না। তবুও আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ যে শ্যামাপ্রসাদের আত্মবলিদানকে আমরা কিছুতেই বিফলে যেতে দেব না, বুক দিয়ে আগলে রাখব আমরা আমাদের এই হোমল্যান্ড কে।

“এ লড়াই সেই সে লড়াই, সকল লড়াই ঘুচিয়ে দেবার এ লড়াই বহু দিনের বাকির হিসেব চুকিয়ে দেবার। এ লড়াই আঁধার চিরে, আলোর তোরণ পরশ করার এ লড়াই তোমার আমার এ লড়াই সর্বহারার।”
আজকের এই দিনটিতে সমগ্র পশ্চিমবঙ্গ বাসীর পক্ষ থেকে মহাপুরুষ শ্যামাপ্রসাদের চরণে দন্ডবৎ প্রণতি। তোমার আসন শূণ্য আজি হে বীর পূর্ণ করো।
(তথ্য এবং মতামত লেখকের নিজস্ব, এজন্য আমাদের ভারত দায়ি নয়।)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *