কলকাতা মেডিক্যাল কলেজকে করোনা হাসপাতাল করা কতটা যুক্তিযুক্ত

ড. রাজলক্ষ্মী বসু
আমাদের ভারত, ১১ মে: করোনা সন্ত্রস্ত কলকাতা এবং রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চল। যে মুহূর্তে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য প্রতিনিধি দল এ রাজ্যে অনেক প্রতিবন্ধকতা অসহযোগিতার মধ্যেও পরিদর্শন সম্পন্ন করে গেল, কো মরবিডিটি তত্ত্ব পানসা হয়ে করোনায় নতুন নতুন মৃত্যু আর আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ল।

সংক্রমক রোগের জন্য সংখ্যাতত্ত্ব মুখ্য ভূমিকা পালন করে সেই রোগকে প্রতিহত করার জন্য। রাজ্যের সদ্য সিদ্ধান্ত হল, ৮৮ কলেজ স্ট্রিটকেও করোনা হাসপাতালে রূপান্তরিত করা। করোনা আক্রান্তের জন্য বা কেবল মাত্র করোনা চিন্তকদের জন্য এ কিছুটা স্বস্তির বাতাস আনলেও আদতে তা কতটা বলিষ্ঠ সিদ্ধান্ত? মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের রোগী পরিষেবার নানান ক্ষেত্র বিচার করলে বোঝা যাবে , খুব কিছু স্বাস্থ্যকর স্বাস্থ্য সিদ্ধান্ত নয়। প্রথমেই বলব, যে সকল মেডিক্যাল কলেজে এম ডি( ডক্টর অফ মেডিসিন) বিশেষ করে ডি এম (ডক্টরেট ইন মেডিসিন) পঠন পাঠন হয় সেগুলিকে কোভিড হাসপাতাল করাটাই বা কতটা যুক্তিযুক্ত? কারণ এই দুটি পাঠ্যক্রমে সবটাই নিজস্ব বিষয় সংক্রান্ত রোগী পরিষেবার সাথে ওতঃপ্রোত ভাবে যুক্ত। সব ক্ষেত্রেই তাই স্পেশালিটি পরিষেবা সরকারি ভাবে স্হগিত।

মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আপাতত হিমাটোলজি বা কার্ডিওলজির পাকা হাত মাথা গলাচ্ছে করোনা চিকিৎসাতে। কিন্তু মনে করাতে চাই করোনা চিকিৎসক বা এর স্পেসালাইজড ডাক্তার সে অর্থে হয় না। পথ্য, স্যালাইন আর পর্যবেক্ষণ এই হল আপাত অস্ত্র। পথ্য বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেওয়া হচ্ছে। Lopinavir, Ritonavir, Chloroquine, hydroxychloroquine, Azithromycin, Remdesivi বা আরো কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা ওষুধ তালিকাভুক্ত। Hydroxychloroquine এর গ্রহণযোগ্যতাও যথেষ্ট। এই সব পথ্য পরামর্শ অনুযায়ী নন স্পেসালিস্ট বা আপাত কম অভিজ্ঞ চিকিৎসক দিতে পারেন। তার জন্য মেডিক্যাল কলেজের মতো পরিকাঠামো কি সত্যিই খুব প্রয়োজন? এর ফলে যে কেবল এম ডি বা ডি এম চিকিৎসকদের শিক্ষাবর্ষের ক্ষতি তা নয়, মুখ থুবড়ে পড়ছে অন্য জটিল সংবেদনশীল রোগীর পরিষেবা। একমাত্র এই মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ব্ল্যাড ক্যান্সারের বিশেষ কিছু চিকিৎসা হয়। হার্ট ট্রান্সপ্লান্টের কারিগর এখানেই। উদাহরণস্বরূপ রক্ত পরীক্ষা নিরীক্ষার এবং চিকিৎসার প্রতিদিনের ফর্দ একবার দেখা যাক।

প্রতি মাসে মোটামুটি গড়ে ৪ টি শিশু, ১০ জন পুরুষ এবং ৪ জন মহিলা ক্যান্সারের কেমোথেরাপি এখান থেকেই নেন। এবার জিজ্ঞাসা, এই পরিষেবা এরা কোথায় পাবেন? সময়ে কেমোথেরাপি না পেলে কি হয় তা আশাকরি সবাই জানি। এক রক্ত বিভাগেই আউট ডোর যে যে দিন খোলা থাকে তাতে রোগী ২০০ এর আশপাশে। রক্ত বিভাগ খুব কম সরকারি হাসপাতালে আছে। এরা কি করবেন? থ্যালাসেমিয়া ও হিমোফিলিয়া কিন্তু করোনার চাইতে কোনও অংশে কম মারাত্মক নয়। এই কঠিন রোগের কমপক্ষে ১৫০ রোগীর কি হবে? সংক্রমণের ভয় নেই তাই এই রোগীরা কি বাড়িতে বসেই জীবন মৃত্যু লড়াই করবে? নির্দিষ্ট দিনে অ্যাকিইউ লিউকিমিয়া রোগী ৭০ এর কাছে ঘোরাফেরা করে। একই ভাবে মায়োলোমা লিমফোমা এবং ট্রান্সপ্লান্ট ক্লিনিকে পরিষেবার দিনে কমপক্ষে ৫০ জন রোগী আশা নিয়ে আসেন।

এবার খোঁজ করি ক্রোনিক লিউকেমিয়া রোগীদের, যারা প্রতি শনিবার ১০০ জন মতো চিকিৎসা হেতু দূরদূরান্ত থেকে আসতেন। এই সকল ব্ল্যাড ক্যান্সারের ঠিকানা এখন কোথায়! বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট কেবলমাত্র এই হাসপাতালেই হয়। এবার একটাই সহজ জিজ্ঞাসা, এই যে রোগীর তালিকা, যারা মূলত মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মুখাপেক্ষী, তাদের পরিবর্ত চিকিৎসা কোথায় কি ভাবে কখন হবে? করোনা চিকিৎসা যেহেতু কোনও বিশেষেজ্ঞের বিভাগ দাবি করেনা তাই যে হাসপাতালে এতোগুলো বিশেষজ্ঞ পরিষেবা বিনা মূল্যে পাওয়া যায়, তাকে অযথা ভেঙে দেওয়ার পিছনে কি যৌক্তিকতা এবং এর পরবর্তী সময়ে কতদিনে হাসপাতালের স্বাভাবিক ছন্দ ফিরবে তাই বড় চ্যালেঞ্জ।

শম্ভুনাথ পন্ডিত, বাঘাযতীন হাসপাতাল বা রামরিকলাল হারালালকা হাসপাতালের ( ভবানিপুর) মতো এমন বেশ কিছু ঠিকানা আছে যেখানে কোনও পঠন পাঠন বিভাগ নেই, নেই কোনও অতি বিশেষজ্ঞ বিভাগ, কিন্তু আছে পর্যাপ্ত বেড। তাই এই ধরনের হাসপাতালে করোনা চিকিৎসা করলে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের অতি গুরুত্বপূর্ণ সংবেদনশীল বিশেষজ্ঞ পরিবেষ্টিত বিভাগে তালা পড়ত না এবং রোগীর জীবন মরণ সীমারেখা দূরত্ব বজায় রাখত।
(তথ্য এবং মতামত লেখকের নিজস্ব)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *