দেখে এলাম পদ্মা সেতু

অশোক সেনগুপ্ত, আমাদের ভারত, ঢাকা, ৭ জানুয়ারি:
“হে পদ্মা আমার
তোমায় আমায় দেখা শত শতবার”
লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বাংলা গান-গদ্য-পদ্যে পদ্মার ছড়াছড়ি। এই পদ্মা কোনও না কোনও সময় পার হননি, এমন বঙ্গসন্তানের সংখ্যা কম। কিন্তু অনেক বঙ্গসন্তানের এখনও সৌভাগ্য হয়নি বহু আলোচিত পদ্মা সেতু অতিক্রম করার। প্রেস ক্লাব কলকাতা এবং বাংলাদেশ সরকারের সৌজন্যে রাষ্ট্রীয় সফরে এসে আমাদের সেই সুযোগটা হয়ে গেল।

শনিবার ভরদুপুরেও কুয়াশার ঘন চাদরে ঢাকা সেতু সংলগ্ন নানা অঞ্চল। ওপর থেকে নিচের অবস্থা ভাল দেখাও গেলনা। তার মধ্যেই যেটা আমাদের নজর কাড়ল, তা হল চরা। বিস্তীর্ণ অংশে চরার পরিমাণ অতীতের তুলনায় অনেকটাই বেড়েছে। সেই চরায় কোথাও বাড়িঘর, কোথাও সর্ষেক্ষেত, কোথাও কলাবন। সেতুর এক প্রান্তে শেখ রাসেলের নামে সেনানিবাস তৈরি হচ্ছে। সেই জায়গাটিও নাকি এক সময় ছিল নদীর অংশ।

ঢাকার মাওয়া থেকে ভাঙা পর্যন্ত পদ্মা সেতু বিশ্বের বড় বড় সেতুগুলোর মধ্যে একটি। গত ২৫ জুন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিকভাবে সেতুটির উদ্বোধন করেন। পদ্মা সেতু ৬.১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য এবং ১৮.১ মিটার প্রস্থবিশিষ্ট একটি অনন্য প্রকৌশল স্থাপনা। একটি বৃহৎ প্রকৌশল স্থাপনা হিসাবে পদ্মা সেতু নির্মাণ ছিল একটি অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং কাজ। এ দ্বিতল সেতুটি ১৫০ মিটার দৈর্ঘ্যবিশিষ্ট ৪১টি স্প্যানযোগে ৪০টি সেন্টার পিলারের ওপর স্থাপিত। প্রতিটি পিলার পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ১২২-১২৫ মিটার দৈর্ঘ্য এবং ৩ মিটার প্রস্থবিশিষ্ট ৬-৭টি স্টিল পাইলের ওপর স্থাপিত।

মসৃণ সুন্দর রাস্তা। ঢাকার দিক থেকে সেতুতে ওঠার ঠিক পরেই বাঁদিকে বিশাল সুদৃশ্য মঞ্চ। সেখানেই হয়েছিল সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। মঞ্চের পাশে দেওয়ালে শেখ মুজিবর রহমান ও শেখ হাসিনার মুখাবয়বের বিশাল ছবি। আমরা ১০-আসনের যে গাড়িতে ছিলাম, সেতু অতিক্রমের জন্য সেটির টোল লাগল ১,৩০০ টাকা। বাসের জন্য এই মাশুল ৫,০০০ টাকা। এই হার বাংলাদেশে অন্যান্য সেতুর টোলের চেয়ে অনেকটাই বেশি। সূত্রের খবর, এই টোল-বাবদ সরকার বাৎসরিক ১,২০০ কোটি টাকা ধার্য করেছে। মন্ত্রীদের গাড়ি পারাপারেও নাকি টোল লাগবে। তবে, টোলগেটে নয়, সংশ্লিষ্ট দফতর ওই টোলের অর্থ মিটিয়ে দেবে। আপাতত, একটি টোলগেট তৈরি হয়েছে। দেখলাম, অপর টোলগেট তৈরির কাজ চলছে।

অনেকের আশা, এই সেতুর জন্য বদলে যাবে অর্থনীতি। বিশেষ করে কৃষিতে নিঃসন্দেহে আসবে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। সেতুর কারণে বাড়বে কৃষিপণ্যের উৎপাদন। দ্রুত স্থানবদল হবে উৎপাদিত কৃষি পণ্যের। পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের ফলে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ১.২ শতাংশ বেড়ে যাবে। আর প্রতিবছর দারিদ্র্য নিরসন হবে ০.৮৪ ভাগ। এর মাধ্যমে আর্থসামাজিক উন্নয়নে দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার প্রায় ছয় কোটি মানুষের ভাগ্যে পরিবর্তন আনবে পদ্মা সেতু।

জীবনানন্দ দাসের ঠাকুমা অর্থাৎ সর্বানন্দ দাশ- এর স্ত্রীর নাম ছিল প্রসন্নকুমারী দাশ। তাঁরই মুখ থেকেই জীবনানন্দ শৈশবে বিক্রমপুর আর পদ্মা নদীর গল্প শুনেছিলেন। সে সব গল্পের মধ্যে ছিল অষ্টাদশ শতকের রাজা রাজবল্লভের স্মৃতি, যাঁর একুশ চূড়াযুক্ত প্রাসাদকে বলা হত ‘একুশ রত্ন’। সেই স্মৃতিই পরবর্তীকালে উঠে এসেছে কবির রূপসী বাংলা কবিতায়: “তবু তাহা ভুল জানি-রাজবল্লভের কীর্তি ভাঙে কীর্তিনাশা;
তবুও পদ্মার রূপ একুশরত্নের চেয়ে আরো ঢের গাঢ়“-(রূপসী বাংলা)।

বেশ কিছুদিন ধরেই দাবি আসছে এই সেতু জীবনানন্দের নামে চিহ্ণিত করার। ‘বঙ্গ আমার জননী আমার’ নামে একটি সংগঠনের সভাপতি অনুপম ঘোষ বলেন, “বাংলাদেশের সক্ষমতা ও গর্বের নাম পদ্মা বহুমুখী সেতু। আমাদের দেশে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, নারী জাগরণের কবি বেগম রোকেয়া, মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের নামে বিশ্ববিদ্যালয়-মহাবিদ্যালয়সহ নানা স্থাপনা রয়েছে। কিন্তু রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশের নামে কোনো স্থাপনা নেই। পদ্মা সেতু দক্ষিণবঙ্গের সঙ্গে গোটা দেশের মূল যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এই দক্ষিণবঙ্গের জেলা বরিশালে কবি জীবনানন্দ দাশ জন্মগ্রহণ করেছেন। সেই কারণে বৃহৎ এ স্থাপনার নামকরণ তার নামে প্রথমেই বিবেচিত হওয়া উচিত।”

পদ্মাকে নিয়ে কবিগুরু লিখেছেন,
“গোধূলির শুভলগ্নে হেমন্তের দিনে,
সাক্ষী করি পশ্চিমের সূর্য অস্তমান
তোমারে সঁপিয়াছিনু আমার পরান।”

আর ভূপেন হাজরিকার ‘গঙ্গা আমার মা পদ্মা আমার মা’ কীভাবে শ্রোতাদের চমৎকৃত করেছে, তা সকলেরই জানা। তবে, পদ্মা সেতু ঘুরে এসে মন ভালোর বদলে খারাপই হল। চরার দাপটে রূপকথার সেই পদ্মাও কী ভবিষ্যতে কোনও এক কালে তলিয়ে যাবে ইতিহাসের গর্ভে?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *