জয় লাহা, দুর্গাপুর, ২৬ অক্টোবর: চলতি বছরে তিনবার ভারী বর্ষায় দামোদরের জলে প্লাবিত হয়েছে গ্রাম। লোকসান হয়েছে প্রায় ৬০০ একর জমির কয়েক লক্ষ টাকার নানান ফসলের। মাথায় হাত পড়েছে ঋণে জর্জরিত চাষিদের। জল নামতেই দামোদর তীরবর্তী বন্যা বিদ্ধস্ত দুর্গাপুর লাগোয়া সোঁনাইচন্ডীপুর গ্রাম সংলগ্ন নদীপাড় বাঁধানোর কাজ শুরু করল দুর্গাপুর সেচ দফতর। যুদ্ধকালীন তৎপরতায় কাজ হওয়ায় খুশী গ্রামবাসীরা।
উল্লেখ্য, দুর্গাপুর শিল্পশহর লাগোয়া দামোদর নদীর তীরে সোঁনাইচন্ডীপুর। প্রায়ই ৪০টি পরিবারের বসবাস। দুর্গাপুর লাগোয়া হলেও বাঁকুড়া জেলার মেজিয়া ব্লকের অধীনে গ্রামটি। দামোদরের তীরে মানাচরে চাষবাসই জীবনজীবিকা। বিগত ৪০ বছর ধরে ওই এলাকায় বসবাস করছে। বহু আবেদনর পর জুটেছে ভোটার কার্ড, আধারকার্ড। গ্রামে কোনও উন্নয়নের ছিঁটেফোঁটাও জোটেনি। না আছে রাস্তাঘাট, না আছে পানীয় জলের সরকারি ব্যাবস্থা। জবকার্ড থাকলেও একশ দিনের কাজ জোটে না। এমনকি বিদ্যুত পরিষেবাটুকুও গ্রামে পৌঁছায়নি। বছর খানেক আগে কমিউনিটি হল তৈরী করে দিয়েছে মেজিয়া পঞ্চায়েত সমিতি।রেশনকার্ড থাকলেও নদী পেরিয়ে ৫ কিলোমিটার দূরে যেতে হয় রেশন তুলতে। এককথায় চরম বঞ্চনার শিকার বলে দাবি গ্রামবাসীদের। তবে দীর্ঘদিনের গ্রামবাসীদের লড়াইয়ের পর সম্প্রতি বাঁকুড়া জেলাপ্রশাসন সার্ভে করে। তাতে সোঁনাইচন্ডীপুরকে মেজিয়া ব্লকের বানজোড়া পঞ্চায়েতের অন্তর্ভুক্তি করা হয়। তারপরই তৈরী হয়েছে নতুন ভোটারকার্ড। গত পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে ভোটারকার্ড হাতে পায় গ্রামবাসীরা। গ্রামের ৭৭ জন ভোটার। গ্রামের কমিউনিটি হলে বুথ। বাঁকুড়া লোকসভার (২৪৭নং) ৯৫ নং বুথ সোনাইচন্ডীপুর। ২০১৯ সালে লেকসভায় প্রথম ভোট দেয় গ্রামবাসীরা। ভেটাধিকার পেলেও আক্ষেপ বসত ও চাষজমির পাট্টা না পাওয়ায়।
দামোদরের চরে প্রায় ২০০ একর জমিকে চাষ উপযোগী করে তুলেছে। বালি মাটিতে ফলছে সোনার ফসল। মূলত সারা বছরই সব্জি চাষ বেশি হয়। সরষে, ধনে, মুলো, গাজর, বিট, পালং শাক, বেগুন, ভুট্টা, পেঁপে, কুল, কলা, বিভিন্ন ধরনের কপি, ঢেঁড়স, পটল, বাদাম নানান চাষে নজির রয়েছে। বিদ্যুৎ না থাকায় পাম্প বসিয়ে সেচের জল ব্যাবহার করে। উৎপন্ন সব্জির একমাত্র বাজার দুর্গাপুর বেনাচিতি, স্টেশন বাজার, চন্ডিদাস ও মামড়া বাজার। কৃষির ওপর নির্ভরশীল গ্রামবাসীরা। মতুয়া সম্প্রদায় ভুক্ত হলেও বছরে একবার ধুমধাম করে কালি পুজো করে। তবে চলতি বছর একের পর ঘুর্নী ঝড়, নিম্নচাপের ভারী বর্ষায় দামোদর উত্তাল হয়ে ওঠে। আর তার জেরে দামোদরের জলে প্লাবিত গোটা সোনাইচন্ডীপুর গ্রাম। জলের তলায় প্রায় ৬০০ একর চাষ জমি তলিয়ে যায়। নষ্ট হয়েছে বাদাম চাষে। তার পরও নষ্ট হয় ভুট্টা, বেগুন, পটল, করলা, শসা, ঝিঙে চাষে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। জল জমে পচে নষ্ট হয়েছে ভুট্টা, পটল সহ সবরকম সব্জি। জল নামতেই রুজির তাগিদে নতুন করে চাষে নেমেছে চাষীরা। নতুন করে বাঁচার লড়াই শুরু করেছে। জল নামতেই ভেঙে পড়া মাটির ঘরবাড়ী মেরামতের কাজ শুরু করে বাসিন্দারা।
ক্ষতিগ্রস্ত চাষী হরেন তালুকদার, দুলাল মাহালি, আনন্দ বিশ্বাস প্রমুখ জানান,” ধার দেনা করে চাষ করেছিলাম। বাদাম প্রচুর লোকসান হয়েছে। সব্জিতে সেই লোকসান কাটিয়ে ওঠার আশা দেখেছিলাম। কিন্তু বন্যায় সেসব নষ্ট হয়েছে। তাই এবার শীতকালিন সব্জির ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। রঙিন ফুলকপি, বাঁধাকপি, গাজর, পেঁয়াজ, পেঁপে চাষের বীজ ফেলা হয়েছে। আলুও বসানো হয়। বন্যায় চাষে যে লোকসান হয়েছে।” বন্যা বিদ্ধস্ত গ্রামের দুর্দশার খবর প্রকাশিত হতেই নড়েচড়ে বসে রাজ্য সেচ দফতর। জল নামতেই গ্রামে দফায় দফায় পরিদর্শনে ছুটে যায় দুর্গাপুর সেচ দফতরের আধিকারিকরা। দুর্গাপুজো শেষ হতেই যুদ্ধকালীন তৎপরতায় সোনাইচন্ডীপুর লাগোয়া দামোদরের পাড় বাঁধানোর কাজ শুরু হয়। গত কয়েকদিন ধরে চলছে নদীর পাড় বাঁধানোর কাজ। সেচ দফতর সুত্রে জানা গেছে, শাল বল্লি দিয়ে নদীর পাড়ে বেড়া হচ্ছে। তারপর ক্রেট ও হাইডেনডিট পলি ব্যাগ মাটি বালি ভর্তি করে বসানো হবে। তাতে নদীর পাড় মজবুত হবে। এবং জলস্রোতে ওই বাঁধানো পাড়ে সেরকম কোনও ক্ষতি হবে না। এবং তাতে গ্রামে জল ঢোকাও ঠেকানো সম্ভব হবে।
দুর্গাপুর সেচ দফতরের আধিকারিক গৌতম ব্যানার্জি বলেন, “সেনাইচন্ডীপুর গিয়েছিলাম। কিভাবে দামেদরের প্লাবন থেকে গ্রাম ও চাষজমিকে বাঁচানো যায়, তার জন্য নদী পাড় বাঁধানোর কাজ শুরু হয়েছে। এখন আপাতত ৮০০ মিটার বাঁধানো হবে। তাতে গ্রাম ও চাষজমি দুটোই প্লাবনের হাত থেকে রক্ষা পাবে। পরে আবারও কয়েক’শ মিটার বাঁধানো হবে।” এদিকে নদীর পাড় বাঁধানোর কাজ শুরু হওয়ায় খুশী সোনাইচন্ডীপুরবাসী।