ভারত কি পৌত্তলিকতার পূজারী

ডাঃ রঘুপতি সারেঙ্গী, কোচবিহার, ২৫ অক্টোবর:
ঋষভদেব এর একশ পুত্র। এদের একাশি জন কর্মকাণ্ড চর্চা নিয়েই থাকলেন। ন’জন তৎকালীন সারা পৃথিবীর ন’টি দ্বীপ এর রাজা হলেন, আর ন’জন ‘নব যোগীন্দ্র’ রূপে গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে বিচরণ করে ব্রহ্মবিদ্যা বিতরণ করতে শুরু করলেন। বাকি রইলেন একজন। ইনি ভরত মহারাজ।
এনার নামেই এ দেশের নাম ভারতবর্ষ।
”ব্রহ্মবিদ্যাম তস্যাম রমতে ইতি ভারতঃ”.……..অর্থাৎ কিনা যেখানে মানুষ ব্রহ্মজ্ঞানের বিচার-বিশ্লেষণেই সদা রত। ধন-ধান্যে, মণি-মুক্তোতে, জ্ঞানে-প্রজ্ঞাতে আর মেধায় ভরপুর ভারত। সে ভারত সাধকের, সিদ্ধ-পুরুষের। সে ভারত ছিল এক আত্মা, এক প্রাণ–একাত্মতার, সে ভারত ছিল বিশ্বমানবতার, সেবা-সাত্ত্বিকতা-উদারতার।
সে সময়ে না ছিলেন শিব-কালী, না ছিলেন গণপতি বাপ্পা বা তা’র ভাই বোনেরা, না ছিল রাধা-কৃষ্ণ তত্ত্ব।
গতানুগতিক গুটি গুনে-গুনে জপ এ সবের বালাই ছিল না অথচ তাঁরা প্রত্যেকেই ছিলেন উচ্চস্তরের ঐশী শক্তিতে ভরপুর। ধ্যান এবং তপস্যাই ছিল এঁদের পূর্ণত্ব প্রাপ্তির একমাত্র পথ। হিন্দূ’র ভাষায় এটাই মুক্তি, ইসলামের কাছে এটাই জিন্নাৎ প্রাপ্তি, বুদ্ধদেব এর দৃষ্টিকোণে এটাই বোধিলাভ। জৈনদের কাছে নির্বাণ বা কৈবল্য।

ব্রহ্মজ্ঞানী ঋষি’র মন্ত্রচৈতন্য লাভ হলে বাকসিদ্ধি’র সাথে সাথেই অণিমা-লঘিমা-গরিমা ইত্যাদি শক্তি স্বাভাবিকভাবেই করায়ত্ব হয়। কামনা-বাসনার পরিসমাপ্তিতে জীবাত্মা তার স্বধামে গমন করে। ওঁ-কার বা পরমাত্মাতে লীন হয়।
সত্য যদি এটাই হয় তবে কালী-কৃষ্ণের, হর-পার্বতি’র বা
লক্ষ্মী_নারায়ণের আসার দরকার পড়লো কেন ?
না না এনারা আসেননি। আসতে চান ও নি। আসলে, আনা হয়েছে, বৌদ্ধিক বিচার শক্তির ক্ষীয়মাণতার কারণে।
ঋগ বেদে এঁদের নামটি পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যাবে না।

চিদাকাশে ব্রহ্মরূপে যিনি সদা সর্বদাই জীবদেহ আশ্রয় করে আছেন তাঁকে আজ আমরা খুঁজছি মাটির সাতরঙা প্রতিমাতে!
স্বর্গগত বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র কে মাতৃবআরাধনার সাত দিন (এ বছর তো আবার এক মাস) আগে থেকেই জানাতে হচ্ছে, “আশ্বিনের শারদ প্রাতে সেজে উঠেছে আলোক মঞ্জরী। ধরণীর বহিরাকাশে অন্তরিত মেঘমালা। পৃথিবীর অন্তরাকাশে জাগরিত জ্যোতির্ময়ী জগন্মাতার আগমনবার্তা। আনন্দময়ী মহামায়ার পদধ্বনী। অসীম ছন্দ বেজে উঠে রূপলোকে ও রসলোকে, আনে নব ভাব-মাধুরীর সঞ্জীবনী। তাই আনন্দিতা শ্যামলী মাতৃকার চিণ্ময়ীকে মৃণ্ময়ীতে আবাহন। শারদ শ্রী মন্ডিত প্রতিমা মন্দিরে মন্দিরে ধ্যান বোধিতা ।”
আসলে, কলিকালের স্বল্পায়ু আর অত্যল্প মেধা-বুদ্ধি সম্পন্ন আমরা ব্যোম বা নিরাকার ঈশ্বরের কল্পনা আমাদের চিন্তা-ভাবনার স্তরে আনতেই পারি না কিনা !
তাই তো বেদ-উপনিষদ পরবর্তী পুরাণ এর কালে এই দেব-দেবী দের রূপের কল্পনা। যে কার্য সিদ্ধির জন্য যে দেবীর কল্পনা তাঁর আকার-অবয়বও
তেমনি।

গণেশকে দিয়ে মহাভারতের মতো বিশ্ববরেণ্য মহাকাব্য লিখাতে হলে তো ছোট মাথা থাকলে হবে না, তাই হাতিকে কেটে বড়ো মাথার ট্রান্সপ্লানটেশন ! গোপীদের মন রঞ্জনের জন্য বঙ্কিমঠাম এর হাতে শুধুই বাঁশের বাঁশি। আবার অসীম ক্ষমতার অধিকারী অসুরকূল কে পরাস্ত করে পৃথ্বী’র সব অমঙ্গল নাশ করা দুটি মাত্র হাতে কী করে সম্ভব ? তাই তো মহামায়া’র দশ দশটি হাতে পৃথক পৃথক মারণ অস্ত্র, যা’র দৃশ্য স্বয়ং আলেকজাণ্ডারকেও ভাবিয়ে তুলেছিল ভারতে অনুপ্রবেশের আগে!

অথচ সনাতন বৈদিক ধর্মের নীতি আমাদের জানাচ্ছে,
” ন দেবো বিদ্যতে কাষ্ঠে
ন পাষাণে ন মৃণ্ময়ে।
ভাবে হি বিদ্যতে দেবঃ
তমাদ্ ভাবো হি কারণম্।”
অর্থাৎ ঈশ্বর কাঠেও থাকেন না,
পাথরেও নয়। মাটির তৈরী প্রতিমাতে–ও নয়। তাঁর স্থান মানুষের নির্মল মনে, শান্ত-সমাহিত চিত্তে।
তাই করোনা কম্পিত ভারতে এইবারটি অন্ততঃ প্রতিমা দেখার ঝুঁকি না নিয়ে নিজের ঘরে বসেই শুদ্ধচিত্তে আনন্দিত মনে, সবার সাথে বসে, টিভির পর্দাতেই দেবী দর্শণ করলেন..…ক্ষতি কী ?
🌹জয় মা দুর্গা !🌹

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *