
অশোক সেনগুপ্ত
আমাদের ভারত, কলকাতা, ২৮ মার্চ:
“’আমার বাবা কার নামে গাড়ি কিনবেন, সেটা কুনাল ঘোষের বাবা ঠিক করবেন না।’’
আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে বসে সাংবাদিক সম্মেলন করে কুনাল ঘোষের অভিযোগের জবাব দিতে গিয়ে মঙ্গলবার এই মন্তব্য করেছেন সিপিআইএম নেতা শতরূপ ঘোষ। কুণালের অভিযোগ ঠিক না বেঠিক, সেটা অন্য প্রসঙ্গ। প্রশ্ন উঠেছে এভাবে শহুরে তথাকথিত শিক্ষিত বামপন্থী নেতার মুখে বাবা তুলে মন্তব্য কতটা সঙ্গত। রাজনীতি আজ কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে।
সামাজিক মাধ্যমে এই বিতর্কে স্পষ্টতই দুটো ভাগ। একদল ঘোরতর কুণাল বিরোধী। তাঁদের দাবি, কুণাল সুবিধাবাদী। কুণাল ধান্দাবাজ, আরও অনেক কিছু। কিন্তু তাতে শতরূপের কুকথার যথার্থতা দাঁড়ায় না।
বিতর্কের সূত্রপাত কুণাল ঘোষের অভিযোগ, বিধানসভা নির্বাচনে যার ঘোষিত সম্পত্তির পরিমাণ ছিল ২ লক্ষ টাকা, পার্টি হোলটাইমার হয়ে সেই শতরূপ ২২ লক্ষ টাকার গাড়ি কিনেছেন। বক্তব্যের স্বপক্ষে নথিপত্রও দাখিল করেছেন কুণাল। শতরূপ ঠাণ্ডা মাথায় এর জবাব দিয়ে দিলে অনেকটাই মাত্রা পেত বাম নেতার দাবি। পরিবর্তে বললেন, “কুণাল ঘোষের বাবার হয়তো নামে-বেনামে অনেক সন্তান। আর আমি আমার বাবার একমাত্র সন্তান। জেলে থাকার সময় ওর মাথায় কেউ মেরেছিল? আমার সখ-আহ্লাদ নিয়ে বেশি ভাববেন না প্লিজ। দরকারে আর্থিক তছরুপ বিভাগে জানান। ঘেউ ঘেউ করবেন না। আপনার দলের অর্ধেক লোক জেলে। এ সব করে আপনার দলের সবাই যে চোর সে কথা ঢাকতে পারবেন না। কুণাল যদি টেস্ট টিউব বেবি না হয়, আশা করি ওরও মা-বাবা আছে। আপনিও পার্থর মতো শখ-আহ্লাদ করুন। জীবন রঙিন করে তুলুন।”
শুরু হয়েছে প্রতিক্রিয়া। কেউ বলছেন, “খুব অন্যায় এবং অশালীনও“। কেউ বলছেন, “শতরূপের এত উষ্মার কারণ কী? কুণালের প্রশ্ন এবং অভিযোগের উত্তরের কি এরকম ভাষা হওয়া উচিত?” কেউ বলছেন, “ছিঃ। ন্যূনতম শিক্ষার চরম অভাব। শতরূপের ক্ষমা চাওয়া উচিত বাবা তুলে এরকম মন্তব্যর জন্য।”
১৯৬২ সালে ২২ বছর বয়সে সাংবাদিকতা শুরু করেছিলেন মিহির গঙ্গোপাধ্যায়। এ রাজ্যের অন্যতম প্রবীন এই রাজনৈতিক সংবাদদাতার কথায়, “শতরূপের এহেন বাক্যচয়ন অশোভন, অনুচিত, অপ্রয়োজনীয়। মন্ত্রী, জনপ্রতিনিধি তো বটেই, এমনকি যাঁরা রাজনৈতিক সাধারণ কর্মী তাঁদেরও জিভের ওপর লাগাম রাখতে হবে। তাঁদের কথায়, আচরণে মানুষের ওপর প্রভাব পড়ে।”
অতীতেও বাম নেতাদের কেউ কেউ নানা সময়ে কুককথার জন্য বিশেষভাবে পরিচিত ছিলেন। কিন্তু জেলা বা গ্রামীণ নেতাদের অনেকে স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে ওরকম নানা অপ্রিয় বিশেষণ ব্যবহার করেছেন। সিপিএমের নবীন, সম্ভাবনাময়, শহুরে নেতার মুখে এরকম কথা কতটা মানা যায়?
“একেবারেই মানা যায় না“— মন্তব্য আর এক অশীতিপর সাংবাদিক, একটি সাপ্তাহিকের সম্পাদক হিমাংশু হালদারের। গত শতকের পঞ্চাশের দশকের শেষ দিক থেকে রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন দীর্ঘকাল। অভিজ্ঞতার ঝুলি বেশ ভারি। এই প্রতিবেদককে বললেন, “১৯৭৫ সাল থেকে ১৯ মাস ১৮ দিন প্রেসিডেন্সি জেলে ছিলাম। বেশ কিছু কমিউনিস্ট নেতাকে খুব কাছ থেকে দেখেছি। এ রকম বাবা তুলে কথা বলা ভাবতেই পারি না। রাজনীতির একটা প্রধান শর্ত হল শিষ্টাচার। শিষ্টাচার কাকে বলে অতুল্য ঘোষ, প্রফুল্ল চন্দ্র সেনকে কাছ থেকে দীর্ঘদিন দেখে অনুভব করেছি। আজও মুগ্ধ হয়ে ভাবি ওঁদের সরল জীবনযাপনের কথা।“
প্রশ্ন উঠেছে, মুজঃফফর আহমেদ, প্রমোদ দাশগুপ্ত, বিমান বসু, সূর্যকান্ত মিশ্ররা কি তাহলে উত্তরসূরী তৈরিতে ব্যর্থ হলেন? তাঁদের হাতে তৈরি হলেন ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়, শতরূপ ঘোষের মত নবীন নেতারা? মানুষের একটা বড় অংশ বামেদের অপেক্ষাকৃত পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির বলেই বিশ্বাস করেন। অনেকদিন মন্ত্রী থেকেও অশোক ভট্টাচার্য, বিশ্বনাথ চৌধুরীরা তাঁদের সরল জীবনযাপনের জন্য মানুষের ভালবাসা পেয়েছেন। শতরূপ ঘোষের এই বিলাসী বাহন কি সেই বিশ্বাসকে আঘাত করবে না?