জ্যোৎস্না দেব প্রয়াত, রহড়ায় শেষ হয়ে এলো লোকায়তিক ধারায় সমৃদ্ধ একটি সময়কাল

ড. কল্যাণ চক্রবর্তী
আমাদের ভারত, ৮ এপ্রিল: মায়েরা একটি প্রবাদ বলতেন, “সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে’। তার উদাহরণ ছিলেন তখনকার রহড়া গ্রামের জ্যোৎস্না দেব। তাঁর স্বামী অতুল দেব ছিলেন রেলের গার্ড। একবার সাক্ষাৎ মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছিলেন অতুলবাবু। তখন পাড়ায় জ্যোৎস্না পিসির পবিত্রতার কথা, তাঁর মধুর ব্যবহারের কথা, তাঁর দেবভক্তির কথা মুখে মুখে প্রচারিত হয়েছিল রমণী মহলে। তাদের বিশ্বাস ছিল স্ত্রীর জন্যই ফিরে এসেছেন তাঁর স্বামী। এমনই ভক্তিমতী মহিলা।

পূজা-পার্বণে পাড়াসুদ্ধ লোককে নিমন্ত্রণ করে খাওয়াতেন। নানান কাহিনি পড়ে ছোটোবেলায় যে চিত্রকল্পের উদয় অনবধানেই করে ফেলে শিশু, আমাদের সময়ে পাড়ার খুদেদের প্রত্নপ্রতিমায় জ্যোৎস্না পিসিও ছিলেন বেহুলার মতোই এক নারী।

আমার মা ডাকতেন ‘কাকিমা’। তিনি মা-কে ডাকতেন ‘ভাস্তি’। বহু ছোটোবেলা থেকেই দেখেছি আমাদের পারিবারিক যোগাযোগ, কোনো মতাদর্শই আমাদের এই যোগাযোগকে বিচ্ছিন্ন করতে পারেনি।

মায়ের যদি কাকিমা হন, সম্পর্কে আমার দিদা অথবা দিদিমা হন। কিন্তু পাড়াতুতো সম্পর্কে ডাকতাম ‘পিসি’। পাড়ায় এইরকম সম্পর্ক তখন হতো। একই বাড়ির নানান জনকে নানান ভাবে ডেকে ফেলতাম, তাতে কোনো মহাভারতই অশুদ্ধ হতো না। ওনার বড় আর মেজোছেলেকে ডাকতাম ‘তরুণ মামা’, আর ‘অরুণ মামা’; কিন্তু মেয়েকে ‘মিনুদি’, ছোটোছেলেকে ‘পীযূষ দা’! পীযূষ দা আমার বাল্যবন্ধু, বয়সে আমার চাইতে কিছুটা সিনিয়র। ওরা প্রথমে ভাড়া থাকতেন মিশনপাড়ার রাইমোহন চক্রবর্তীর বাড়ির দালানে দু’টি ঘর আর বারান্দা নিয়ে। সেই বাড়িতে আমরাও টিনের চালের বাড়িতে ভাড়া থাকতাম। পরে আনুমানিক ১৯৭২ সাল নাগাদ রাইমোহনবাবুর গৃহের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে তিনকাঠা পরিমাণ জমি কিনে বাড়ি করলেন তারা৷ একটি বড় ঘর, সঙ্গে ছোট্ট একটি ঘর তৈরি করে গৃহপ্রবেশ। বাকী ঘর, দোতালা অনেক পরে হয়েছে৷ খুব অস্পষ্ট মনে আছে, বাড়ি তৈরির আগে ইঁটের পাঁজা, বালি, স্টোনচিপস্ রাখা থাকতো উত্তরের ফাঁকা জায়গায়। সে বালি নিয়ে আমরা বাচ্চারা খেলতাম। পীযূষ দা নতুন ইঁটের সাজানো পাঁজার উপর বসে আমাদের খেলা মনোযোগ দিয়ে দেখতো। সেই থেকে পীযূষ দা আর আমি বন্ধু হয়ে গেলাম। তাই আমার উপর পিসির যত্নও কিছুটা বেশি হল৷

আজ দুপুরে খবর পেলাম মায়ের সেই কাকিমা নেই। শ্বাসকষ্ট ও কিডনি জনিত সমস্যার কারণে গত কয়েকদিন রোগ-ভোগের পর আজ দুপুর বারোটা নাগাদ পরলোকগমন করেছেন। মৃত্যুকালে বয়স হয়েছিল ৮৪ বৎসর।

এই পিসির বাড়িতে আমার নিমন্ত্রণ পাওয়ার শুরু তাদের গৃহপ্রবেশে। নাড়ু হয়েছিল মনে আছে। আমাদের হাত ভরে গিয়েছিল নাড়ু আর লাড্ডুতে। ছাদে সত্যনারায়ণ পুজো, শনিপুজো নিয়মিত করাতেন তিনি। বেশ ধুমধাম করেই পুজো হতো, প্রচুর নৈবেদ্য দেওয়া হত, অনেক দুধ নেওয়া হত সেদিন, আমরাও খুশি হতাম। পাড়াসুদ্ধ সবাই প্রসাদ পেতাম। আগের দিন বাড়িতে বাড়িতে নিজে জানিয়ে যেতেন নিমন্ত্রণের কথা। পেটপুরে সিন্নি, ফল-ফলাদি পাতে পড়তো। গ্রীষ্মের মাসে নানান মরশুমি ফল, সঙ্গে বাড়ির পেয়ারাও। দু’টো ভালোমানের পেয়ারাগাছ ছিল পিসিদের জমির সীমানায় পুকুর ধারে। গ্রীষ্ম-বর্ষায় তাতে অগুন্তি সুস্বাদু ফল। সব সময়ই সেই গাছে ওঠার অনুমতি ছিল। অর্থাৎ বিচার করে দেখতাম, এ তো সেল্ফিশ-গার্ডেন নয়! ছাদ থেকে তো পেড়ে নেওয়া যেতো বড় সাইজের পেয়ারা৷ ছিল নারকেল গাছ। পাড়াসুদ্ধ সবাইকে বিলোতেন নারকেল। তাঁর বাগানের শখ। অতসী, মোরগঝুঁটি (Cockscomb), মধুমালতি ওই বাড়িতেই প্রথম দেখি। সবসময় লাউ/কুমড়ো/চাল কুমড়োর লতানে গাছ। বীজ ফেলে দড়ি টেনে তুলে দেওয়া হতো ছাদে৷ উনি বলতেন, “চাল ভরা কুমড়ো লতা/লক্ষ্মী বলেন আমি তথা।” একবার দেখি ছাদ ভরে পাকা চালকুমড়ো ধবধব করছে। আমার দিদা বড়ি দেবেন, তাই পাকা চালকুমড়োর আঁতি মেশানো হবে। পিসি দুটো চাল কুমড়ো তুলে নিতে বললেন ছাদ থেকে। বোঁটায় রোঁয়া, প্রথমে ছিঁড়তে পারলাম না। উনি রান্না করতে করতে ছাদে এলেন, হাঁটুর সমস্যা সেই ছোটকাল থেকেই দেখে আসছি। তবুও ব্লেড দিয়ে চালকুমড়ো কেটে একটা আমার হাতে, একটা নিজে দিতে এলেন আমার দিদার কাছে। যতবার কোনো না কোনো সব্জি লাগিয়েছেন, পাড়াপড়শিকে বিলিয়ে তবে নিজে খেয়েছেন।

একটি লোকায়ত অভ্যাস ছিল তাঁর, সবসময় তৈরি গাছের একটি উত্তম ফল রেখে দিতেন ‘বীছন’ বা পরের বারের বীজ তৈরি করবার জন্য। এভাবেই দেশী জাতের বীজ সংরক্ষণ করে এসেছেন ভারতীয় মহিলারা। পিসি পু্ঁইমাচাও করতেন নিয়মিত। এর পাকা বীজ থেকে বেগুনি রঙ বার করে দোল খেলতাম আমরা। বাড়ির দক্ষিণ দিকে প্রায় সময়েই কলাগাছ ভর্তি। নানান কাজে কলাগাছ দেখা শুভ লক্ষণ। কখনো মোচা এসেছে, কখন কলার কাঁদি। সে ফলেরও ভাগ পেতাম। কচি নিমপাতা তুললেও পাঠাতেন আমাদের বাড়ি। বাড়ির চারাপাশে বেড়া দিয়েছিলেন জীবন্ত গাছ দিয়ে, তার নাম রাংচিতা, বোটানিক্যাল নেম পেডিলেন্থাস। এর লাল কৌণিক ফুলে একটি ঢাকনি সরালে একবিন্দু মিষ্টি মকরন্দ পাওয়া যেতো। ছোটোবেলায় এটি বেশ মজা করে খেলার অঙ্গ হিসাবে পান করেছি। তাই পাড়ার বুড়োমানুষেরা আমাদের বলতেন ‘মৌটুসী’। কারণ মৌটুসী এইসব বুনোফুল থেকে বাঁকানো ঠোঁটে মধুপান করে। পরে শরীরের কারণে গাছপালার যত্ন নিতে পারতেন না তিনি, কিন্তু পুরনো দিনের গাছপালার কথা মনে করিয়ে দিলে খুশিতে ডগমগ করতেন।

পিসিদের বাড়িতে দেশী মুরগী পালন করা হতো। কাঠের কাঠামোয় নেটের জাল জড়িয়ে দিয়ে তাদের রাত্রিবাসের ব্যবস্থা ছিল। সারা পাড়া ঘুরে কেঁচো, মাটির পোকামাকড়, ঘাসের বীজ ইত্যাদি খেয়ে সন্ধ্যার মধ্যেই সিঁড়ির তলার বাসায় ফিরে আসতো মুরগীগুলো। কখনও সেই মুরগীকে বেজি, ভাম পেলে তুলে নিয়ে গেলে, খুবই কষ্ট পেতেন। তাঁর পালিত দেশী মুরগীর ডিম খেয়েছি। কখনো পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করলে একটা রেকাবিতে ‘মামলেট’ করে দিতেন। হলুদ ছাড়াই তার ঘন হলুদ রঙ চোখে পড়ার মতো। একবার ২৫ শে ডিসেম্বর বাড়িতে তৈরি করলেন কেক। মাটির উনুন, কোক কয়লার আগুন, উপরে নির্মাণ কাজে ব্যবহৃত কড়াইয়ে গরম বালি। তার মধ্যে পাত্রে ঢাকা কেকের নানান উপকরণ মেশানো মণ্ড। বালির তাপে পাত্রের ভেতরে ভেতরে হয়ে উঠছে কেক। মিষ্টি গন্ধে চারপাশটা ভুরভুর করছে। আমরাও কেক তৈরির কিছু উপকরণ কিনে পিসির বাড়িতে গেছি। ডিম আর বেকিং পাউডার কিনতে পারিনি, দামী ফলের কুচোও ছিল না। ওইসব সামগ্রী নিজেই দিয়ে দিলেন। আর তৈরি করে দিলেন টাটকা দুই দু’টো খাসা কেক। তার অপূর্ব স্বাদ। এমন কেক আর কোনোদিনই খাওয়া হয়নি।

এমন কোনো লোকায়তিক আচার ছিল না, যা তিনি পালন করতেন না। যা বাড়িতে পালন হতো না, তা প্রতিবেশীর বাড়িতে উৎযাপন করতে যেতেন। আম-বারুণী, অশোক ষষ্ঠী, নীল পুজো, চাপড়া ষষ্ঠী, অরণ্য ষষ্ঠী, দশহরা গোটা ষষ্ঠী ইত্যাদি। আমাদের বাড়িতে ইতুপুজোয় নিয়মিত আসতেন। কোনো বাড়িতে যেতেন নাটাই চণ্ডী ব্রতকথা শুনতে। পাড়ার নববধূকে আশীর্বাদ করতে আসতেন। আইবুড়ো ভাতেও পাড়ার মেয়েদের প্রাণখোলা আশীর্বাদ করতেন। সন্তান, স্বামী নিয়ে তাঁর পুণ্যবতীর ভরা সংসার। পাড়ার সমস্ত ছেলেমেয়েদের প্রতিই তাঁর বিশেষ আদর আপ্যায়ণ। আজ অশোকষষ্ঠীতে তিনি চলে গেলেন। বহু বছর আগে এক অশোকষষ্ঠীর কথা মনে পড়ছে। আমি তখন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ব্রতের অঙ্গ হিসাবে পাকা কলার মধ্যে অশোক ফুলের কুঁড়ি পুরে সন্তানবতী রমণীকে গ্রহণ করতে হয়। রহড়ায় তখন অশোক গাছ প্রায় ছিল না। যা ছিল, তাতে একটিও ফুল নেই। তিনি সেবার ফুল সংগ্রহ করতে পারেননি। আমি কল্যাণী থেকে জোগাড় করে দিয়েছিলাম অশোক ফুল। অনেকটা ফুল আর কুঁড়ি পেয়ে খুব আশীর্বাদ করেছিলেন সেদিন। আজ অশোকষষ্ঠী। প্রার্থনা করি দেবী ষষ্ঠীর সান্নিধ্য নিয়ে তিনি যেন স্বর্গের নন্দন কাননে বাগিচা রচনায় দেবীর নিত্য সঙ্গী হন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *