প্রয়াত শিক্ষক অলক কুমার নিয়োগীর স্মরণ-সভায় কথাঞ্জলি

ড. কল্যাণ চক্রবর্তী
আমাদের ভারত, ১২ নভেম্বর: নামের বানানটা কী — ‘অলোক’, ‘অলক’ না ‘আলোক’ — এই নিয়ে সংশয় অনেকরই ছিল। কিন্তু সকলেই নিঃসংশয় ছিলেন যে, তিনি গণিতের উচ্চ-আকাশের অসম্ভব সাদা একটি মেঘ; আমাদের ধরাছোঁয়া দুঃসাধ্য। তিনি এবার একেবারেই বৃত্তের বাইরে চলে গেলেন।

আমার সমস্ত প্রিয় মাস্টারমশাইদের আন্তরিক শ্রদ্ধা জানিয়েও বলছি, রহড়া রামকৃষ্ণ মিশনে এবং এতদঞ্চলে অলকবাবু আর সন্তোষবাবুর আলাদা সম্মান, পৃথক এক প্রতিপত্তি এবং অমল অবস্থান ছিল। তার বহুবিধ কারণও অবশ্য ছিল।

দু’জনেরই সাবজেক্টের উপর ছিল অসাধারণ দখল। সেই সুবাদে মস্ত বড় বড় ভিত তৈরি করে দিয়েছিলেন বহু ছাত্রকে। তারা নানান জায়গায় হয়েছেন লব্ধ-প্রতিষ্ঠ। অর্থাৎ সাফল্য সংবাদে, সাকসেস স্টোরিতে তাঁরা ছিলেন শিরোনামে। তাঁর গুণীছাত্রের অনেকে রীতিমতো দেবতার আসনে বসিয়েছিলেন। অঙ্কের দেবতা। যেন অলক মেঘের মতোই উঁচু মেঘে, অসম্ভব উচ্চ অবস্থানে আসন।

মাধ্যমিক পরীক্ষার আগে তাঁর শেষ ক্লাসটি করে যেদিন আশ্রমে ফিরছি, প্রকৃতির অহেতুকী আহ্লাদে সেদিনই দেখলাম সূর্যাস্তের আলোক-ছটা পড়েছে এক সাদা-জামা সাদা-প্যান্ট পরিহিত দীর্ঘ, সৌম্যদর্শন অঙ্কের দেবতাতে। এক অসাধারণ, অলোক-জনপ্রিয়তার মাঝে নিমগ্ন এক গণিত-নির্জনতা। অঙ্ক সেদিন কিছুটা কষতে পারতাম বটে। তবুও মনে হল, তিনি এক গণিত-সম্ভব দেবতা। পুরো বারাকপুর মহকুমায় অথবা পুরো চব্বিশ পরগণা জেলায় শিক্ষক হিসাবে সবচাইতে খ্যাতি ছিল তাঁর। কালো ব্ল্যাকবোর্ডের ব্যাকগ্রাউণ্ডে খড়িমাটির কলম ধরলে সাদা সাদা খই ফুটে উঠতো। তাঁর অঙ্কের নন্দনতত্ত্ব ছিল দেখবার মতো বিষয়। তিনি নিজেকে বলতেন ‘এমন কিছু না’ অর্থাৎ AKN, Alok Kumar Niyogi. আমাকে ডাকতেন ‘কল্যাণজী আনন্দজী’।

সেই সময়ও ছিল, যখন দরিদ্র ছাত্রের প্রয়োজনে মাস্টারমশাইরা কিছুটা সময় বরাদ্দ রাখতেন। রহড়া মিশনের ইংরেজির শিক্ষক বিশ্বেন্দ্র নারায়ণ সান্যাল, গণিতের সন্তোষ ভট্টাচার্য এবং অলক কুমার নিয়োগী, জীবনবিজ্ঞানের গোপাল গুছাইত তাদের অন্যতম। মিশনের বাইরে কল্যাণ নগর বিদ্যাপীঠের ইংরেজির শিক্ষক সিতাংশু মুখার্জি, ওখানকারই রসায়নের শিক্ষক প্রদীপ কুমার চক্রবর্তী এবং পানশিলা দেশবন্ধু নগর বিদ্যামন্দিরের ভূগোলের শিক্ষক জিতেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী তেমনই শিক্ষক ছিলেন। যারা তাদের ব্যাচে অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া ছাত্রদের জন্যও কয়েকটি আসন ফাঁকা রাখতেন৷ যে নামগুলি উল্লেখ করলাম, হয়তো তাঁদের বাইরেও কেউ থাকতে পারেন, যারা এইরকম দরিদ্র ছাত্রদের পাশে থেকেছেন। তাদের সংখ্যা পরে একেবারেই কমে যায়।

আমার পিতাকে অকালে হারানোর ফলে আমাকে রহড়া বালকাশ্রমে অনাথ ছাত্রদের ভবনে থাকতে হয়েছিল। কিন্তু আশ্রম কর্তৃপক্ষের বিশেষ অনুমতি নিয়ে আমি ক্লাস নাইন-টেনে অঙ্ক করার জন্য সপ্তাহে তিনদিন দুই ঘন্টা করে সন্তোষবাবুর কাছে এবং ইংরেজির জন্য সপ্তাহে একদিন দুই ঘন্টা বিশ্বেন্দ্রবাবুর কাছে পড়তে গিয়েছি নিখরচায়। অলকবাবু নিখরচায় আমাকে ক্লাস ইলেভেন-টুয়েলভে সপ্তাহে তিন দিন গণিত, পদার্থবিদ্যা এবং রসায়ন পড়িয়েছেন। তাদের অবদান কৃতজ্ঞ চিত্তে স্মরণ করি।

অলকবাবু সাধারণ মানুষকেও কতটা সম্মান দিতেন ব্যক্তি অভিজ্ঞতা থেকে একটি উদাহরণ দিই। হায়ার সেকেন্ডারিতে ওঁর কাছে পড়ছি। কিছুদিন পর অলকবাবু আমাকে বললেন, সব ছাত্রের অভিভাবকের সঙ্গেই তো পড়া শুরুর আগে একবার কথা হয়েছে। তোমার অভিভাবককেও একদিন দেখা করতে বোলো। তোমার পড়ার অগ্রগতি সম্পর্কে জানাবো, পরিবারের অংশগ্রহণ বিষয়েও অবহিত করাবো। মা-কে জানালাম সে কথা। মা স্যারের বাড়ি একদিন বিকেলে গেলেন। তখন স্যার কোনো এক ব্যাচে পড়াচ্ছিলেন, কাজেই বাড়ির কেউ জানালেন, এখন দেখা হবে না, পরে কোনো সময় আসবেন। মা চলে এলেন। বিষয়টি পরে স্যার জানতে পেরে আমাকে কোচিং-এ সকলের সামনে বললেন, আমার খুব ভুল হয়ে গিয়েছে, আমি তো সময় উল্লেখ করে দিইনি তোমাকে, তাই তিনি ফিরে গেছেন, এরজন্য আমি ক্ষমা চাইছি। তুমি একদিন তোমার বাড়িতে আমাকে নিয়ে চলো, আমি সস্ত্রীক তোমার বাড়ি গিয়ে মায়ের সঙ্গে দেখা করে আসবো। মা-কে বলতেই তিনি অত্যন্ত লজ্জা পেলেন। স্যার আমার ভাঙা বাসাবাড়িতে সব সময় স্বাগত। কিন্তু এত গুণী একজন শিক্ষক স্রেফ এই কারণে আমাদের বাড়িতে ছুটে আসবেন, এটা হতেই পারে না। মা বললেন, তিনি সময় দিলে আমিই আর একবার যাবো। অবশেষে রবিবার এক বিকেলে আমি আর মা গেলাম স্যারের বাড়ি। স্যার, ম্যাডাম এবং পরিবারের অন্যান্যরা আমাদের আপ্যায়ন করলেন। পুরো বিকেলটা তারা আমাদের সঙ্গে নানান বিষয়ে কথা বললেন। আমিও অকালে বাবাকে হারানোর কথা বললাম। আমার আশ্রম জীবনের কথা। কীভাবে চলছে সংসার, সেসব কথা খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করলেন তিনি। বললেন, পড়াশোনার প্রয়োজনে যেকোনো খরচ যোগাতে তিনি প্রস্তুত, আমি যেন তাঁকে বলি। নিখরচায় তাঁর কাছে পড়াটুকু নেওয়া ছাড়া, আর কোনো আর্থিক সুবিধা না নিলেও, স্যারের এই সহযোগিতার আশ্বাস আমাদের আপ্লুত করেছিল। সেইদিন বিকেলে প্রায় দেড়-দুই ঘন্টার কথোপকথন আজও মনে রেখেছি। স্যার সাধারণত কোনো ছাত্রের প্রণাম নেন না। সেদিন, হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোনোর পর এবং ১৯৯৩ সালে West Bengal Agricultural Service (Admn)-এ যোগদান পর্বে আমি তিনবার তাঁর পদধূলি মাথায় নিয়েছি। গ্রুপ-A গেজেটেড অফিসার হিসাবে চাকরি পাওয়ায় তিনি এত খুশি হয়েছিলেন, বলেছিলেন তোমার সাফল্য রহড়ার অনাথ ছাত্রদের জন্য একটি প্রেরণা হয়ে থাকবে, আমি তোমার গল্প ওদের কাছে করবো। আর যেদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পদে যোগদান করলাম, সেদিনও মাথায় হাত রেখে অনেক কথা বলেছিলেন। তাঁর এত ছাত্র! তারা বড় বড় জায়গায় প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন! কিন্তু আমায় বললেন, একজন আশ্রমের ছাত্রের প্রতিষ্ঠা আমার কাছে আরও বড় বিষয়। স্বামী পুণ্যানন্দজী রহড়া বালকাশ্রম তৈরি করেছিলেন এইরকম কল্যাণদের নির্মাণ করবেন বলেই। সেদিন তিনি বললেন, রহড়ার অনাথ ছাত্রদেরও তিনি একসময় পড়িয়েছেন। রহড়া-খড়দার সর্বকালের সেরা ব্যক্তিত্ব স্বামী পুণ্যানন্দজী মহারাজ, একথাও জানালেন।

স্যারের সঙ্গে পড়াশোনা ছাড়াও আরও কয়েকবার আলাপচারিতা করার সৌভাগ্য হয়েছিল। ১৯৯১ সালে ‘সোনাইবার্তা’ নামক স্থানীয় একটি সংবাদ পাক্ষিক এবং ২০০০ সালে সাপ্তাহিক সংবাদপত্র ‘সংবাদ এখন’ সম্পাদনা করার সময়। তাঁর হাতে পত্রিকার প্রথম সংখ্যার কপি তুলে দিয়ে এসেছিলাম। সেই পরিপ্রেক্ষিতেই তিনি রহড়া-খড়দার নানান সময়ের স্মৃতিচারণ করেছিলেন। পত্রিকার জন্য লেখা না দিলেও তাঁর স্থানীয় ইতিহাস ভাবনা আমাকে যথেষ্ট উৎসাহিত করেছিল। এলাকার সমস্ত খবরেই তিনি আপডেট থাকতেন। একান্ত আলাপচারিতায় জানতে পারি, তাঁর সাহিত্যপাঠের কথা, ভ্রমণ-আগ্রহ ও ভ্রমণ কাহিনী পাঠের কথা, প্রায় সমস্ত ধরনের খেলাধূলার কথা, ভালো ছায়াছবি দেখার কথা বললেন। সারাদিন পড়ানোর গতানুগতিকতার মধ্যেও তাঁর বিনোদন-অনুভূতি যে পরিপূর্ণ মাত্রায় ছিল, তা জানার সৌভাগ্য হয়েছে। তিনি বলেছেন, প্রত্যেকেই জীবনে বিশেষ একটি কাজ নিয়ে এসেছেন, সেটিই নিখুঁত পারিপাট্যে, নির্ভুল ভাবে সম্পন্ন করে যেতে হবে — এটাই সিদ্ধিলাভের উপায়। নানান দিকে ছড়িয়ে যাওয়া নয়, তলিয়ে যাওয়া নয়, ভেসে যাওয়া নয়। সচেতন মনে, সজ্ঞানে একটি নির্দিষ্ট বিষয়ের মধ্যেই নিরন্তর অবগাহন স্নান করতে হয়। তাতেই তৃপ্তিলাভ হওয়া চাই, উৎকর্ষতা বৃদ্ধি করা চাই। অপচয় তিনি পছন্দ করতেন না — না সময়, না পয়সা। জীবনের প্রতিটি সেকেন্ডকে সরস্বতী এবং প্রতিটি পয়সাকে লক্ষ্মীজ্ঞান করতে হয়, তবেই ‘সোনার দোয়াত-কলম’ হয়।

তাঁর স্মরণ-মনন অনুষ্ঠানে আজ তাঁকে শ্রদ্ধা জানানোর সুযোগ পেয়ে মনে হচ্ছে এক উচ্চ মেঘের পানে একটি সাদা ফুল পাঠাতে পেরেছি। তিনি গ্রহণ করলে কথাঞ্জলি সার্থক হবে। তাঁর আত্মার চিরশান্তি কামনা করি। হরি ওঁ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *