করোনায় গর্ভপাতে লকডাউন

ড .রাজলক্ষ্মী বসু
আমাদের ভারত, ৩১ মে: করোনা ভাইরাস যে কী বিষম যন্ত্রণার কোলে উপনীত করেছে তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। পশ্চিমের তথাকথিত উন্নত দেশে মৃত্যু উপত্যকা তৈরি করেছে জীব না জড়ের মধ্যবর্তী এক না দেখতে পাওয়া বস্তু। মৃত্যু যেমন বেহিসেবী হল, খুব অদ্ভুত ভাবে করোনা আবহে জন্মও হলো বেহিসেবী। আমরা সভ্যতার রাজপথে থামতে শিখিনি। জীবন সৃষ্টি না থামারই লক্ষন।

খুব অদ্ভুত ভাবে এই ভাইরাস উপদ্রুত সময়েই জন্ম হার বৃদ্ধি পেল বা ব্যাকরণগত ভাবে বললে জন্ম নিয়ন্ত্রণ কমলো। গর্ভপাতের ক্ষেত্রে এক নিম্ন গতি পরিলক্ষিত হচ্ছে সারা বিশ্বব্যাপী। অনেক সম্ভাব্য মায়েরা ভাবী সন্তানকে এই ভাইরাস অভিশপ্ত সময়ে ভূমিষ্ঠ করতে চাইছেন না। কিন্তু গর্ভপাতেও আপাত “না” শুরু হয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রেই এপ্রিল এর মাঝামাঝি এক রিপোর্ট থেকে জানা যায় , কানসাস অঞ্চলের গর্ভবতীরা দুশ্চিন্তা দিশেহারা, তারা গর্ভপাত চাইছেন। কিন্তু শাসন ও এই মুহূর্তের রাষ্ট্রীয় নিয়ম তাতে বাধ সাধছে। যেহেতু অর্থনৈতিক ধাক্কা এই মরকের প্রধান প্রাপ্য, তাই উদভ্রান্তের মতন সম্ভাব্য মায়েরা ফোন করছেন সন্তানের জন্ম না দেওয়ার জন্য।

টেক্সাস অঞ্চল আবার করোনা যুদ্ধে বিপুল ব্যয় করছে। তাই গর্ভপাত এ মুহূর্তে “non essential” বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। অনেক গর্ভবতী এমতাবস্থায় মার্কিন দেশের এক প্রদেশ থেকে অন্য প্রদেশে ছুটছেন, এই আশাতে যদি গর্ভপাত টুকু করানো যায়। কী পাবে ভূমিষ্ঠ শিশু এই দুর্যোগে! এই ভাবনায় মার্কিন দেশের গর্ভবতীরা নিজের স্বাস্থ্য সুরক্ষা সব ভুলে টেক্সাস থেকে জর্জিয়া পর্যন্ত যাওয়ার যুদ্ধ থেকেও বিন্দুমাত্র পিছপা নন। এমতাবস্থায় টেক্সাস সহ বিভিন্ন অঞ্চলে “anti abortion” দল বিক্ষোভ শুরু করেছে। তাদের দাবী, গর্ভপাত সবসময়ই essential পরিষেবার আওতায় রাখা উচিত। অদ্ভুত এক পরিস্থিতিতে সভ্যতা বিরাজমান।

গর্ভবতী এবং তার পরিবারের গর্ভপাতের চাহিদা বাড়ছে কিন্তু বাজারে জোগান শূন্য। এমন রিভার্স ব্যবসায়িক গ্রাফ খুব কম ক্ষেত্রেই পরিলক্ষিত হয়। এমন অনেক পরিবার আছে যাদের এই মুহূর্তের উদ্বেগ হল বাড়িভাড়া, চিকিৎসা, আর সন্তানের সুরক্ষা। তাই সন্তান ভূমিষ্ঠ করার কথায় তারা আতঙ্কাগ্রস্হ। এমনকি যারা Planned parenthood চেয়েছিলেন, করোনার ফলে তারাও এখন দোলাচলে। কেমন হবে সেই শিশু, আগামী সেই ভাবনাই এখন গর্ভবতীদের দুশ্চিন্তা। ক্লিনিকের বিষাক্ত বাতাস কেন তার ভূমিষ্ঠ সন্তান গ্রহণ করবে এ ভাবনায় সন্তান প্রসব এখন কেবলই যন্ত্রণায় ভরা।

গর্ভবতীদের মনে জোর ফেরানোর জন্য এখন রমরমিয়ে উঠছে টেলি মেডিসিন ব্যবস্থা। ব্যবসা ঠিক তার পথটি খুঁজে নিতে জানে। শুধু কি তাই, মন নামক অদৃশ্য রসায়নটির মেরামত করার কারিগররাও এই সুযোগে চুটিয়ে বাজার দখল করছে। মন ভালো রাখতেই নতুন অতিথিকে আমন্ত্রণ করার কথা বলছেন অনেক মনোবিদ। কিন্তু যুদ্ধের সময় শিশু কি সত্যিই সব সুরক্ষা, যত্ন পায়?

নিউইয়র্ক টাইমস এর এক সমীক্ষায় বলছে- আগামী ন’মাসে জন্মহার হঠাৎ করে বৃদ্ধি পাবে। তারা আরো এক নির্মম সত্যি বলেছে, “if you are running for your life, you are not making babies।” এমতাবস্থায় গর্ভনিরোধক বিক্রির হারও সর্বোচ্চ। Pill Club নামটা অবাক লাগলেও এমনই এক সংস্থা গড়ে উঠেছে ঐ দেশে। যারা অনলাইনে জন্মনিয়ন্ত্রনের সব পরামর্শ এবং নিরোধক সরবারহ করছে। চাহিদা কমপক্ষে ৩০% বৃদ্ধি পেয়েছে। সবচেয়ে সমস্যায় আছেন অর্থনৈতিক ভাবে কমজোরি মার্কিন কৃষ্ণাঙ্গরা। তাদের জন্য গর্ভপাত এখন খাদ্যের চাইতেও বেশি প্রয়োজনীয়। গাটম্যাচার ইন্সস্টিটিউট এর এক গবেষণা বলছে- little X program অর্থাৎ যা ও দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিবার পরিকল্পনার ধারক বাহক, তারাও ৪৬% পরিষেবা গরিব কৃষ্ণাঙ্গ পরিবারের জন্য কমিয়েছে। ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে ওদেশের টেলিমেডিসিন সংস্থাগুলি ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে আবেদন রাখে তারা যেন গর্ভপাতের বড়ি বিক্রি করতে পারে। কারণ, এফ ডি এ দ্বারা তা এখনও সম্মত না। একটা উদাহরণ দিলেই প্রয়োজনের গুরুত্ব পরিস্কার হবে। এক টেক্সাস প্রদেশেই প্রতিবছর গড়ে ৫ লক্ষের বেশি গর্ভপাত হয়। এবার যদি মার্কিন দেশের ৫০টি প্রদেশের বেশির ভাগই আইনের ভ্রূকুটি দেখায় তাহলে হঠাৎ করে জন্মহার বৃদ্ধি পাবে এবং শিশু সুরক্ষা এই অর্থনৈতিক মন্দায় কতটা সুষ্ঠু ভারসাম্যযুক্ত হবে তাও বড় জিজ্ঞাসা।

আরো এক চিরাচরিত হিসেবের উল্টো চিত্র দেখা যাচ্ছে ইংল্যান্ড ফ্রান্স স্কটল্যান্ড আয়ারল্যান্ডে। এসব দেশে গর্ভপাতের হার তুলনামূলক কম হলেও করোনা পরিস্থিতিতে তারাই আজ গর্ভপাতের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছে। মনে রাখতে হবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই ব্যবস্থাকে সমর্থন করে। self managed abortion বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা দ্বারাই স্বীকৃত এবং তা সর্বদাই essential এবং medically necessary care এর আওতায় আসে। তাই এই মুহূর্তে আমেরিকার মতো যে দেশ গর্ভপাতের উপর চোখরাঙানি দেখাচ্ছে তারা কিন্তু আইন গর্হিত আইনের দ্বারা করোনা সময়ের অপব্যবহার করছে। শুধু কি তাই? রাষ্ট্র সঙ্ঘের আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনও বলে The rights to sexual and reproductive health and bodily autonomy র কথা। তাই স্বেচ্ছায় গর্ভপাত গর্ভবতীর একান্ত নিজস্ব সিদ্ধান্ত এবং গর্ভ অধিকার। liberal abortion law র জনক ছিল আমেরিকা। কিন্তু কি এমন হল যে তারাই একশো আশি ডিগ্রি ঘুরে গেল!

প্রসঙ্গত বলা ভালো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার যে Model list of Essential Medicines আছে তাতেও গর্ভপাত বড়ি জায়গা করে নিয়েছে। করোনা লন্ডভন্ড আর্থিক ও সামাজিক পরিস্থিতিতে তার ব্যবহার অন্যান্য দেশে বৃদ্ধি পেলেও খোদ মার্কিন দেশেই তাতে “না” চিহ্ন, যা পূর্বে উল্লিখিত। The American college of obstetricians and gynecologists মার্চ মাসের শুরুতেই বলে Donot support COVID19 responses that cancel or deny abortion procedures- তা সত্ত্বেও Temporary Restrictic Order ( TRO) কর্তা হয়েছে করোনায়। হঠাত্ এখনই এই। TRO কেন ব্যবহার করা হয়েছে তাও বড় জিজ্ঞাসা।

আমেরিকান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েসনও এই কঠিন মুহূর্তে গর্ভপাতেরকে জরুরী প্রয়োজনের তালিকায় আনার পক্ষে কিন্তু ফল কিছু হয়নি। এই মুহূর্তে বিশ্বের তথাকথিত শীর্ষ উন্নত দেশ আমেরিকা এবং অনুন্নত দেশ আফ্রিকায় গর্ভপাত নিয়ে সমান্তরাল পরিস্থিতি। চিকিৎসা, গর্ভপাতের পথ্য, বড়ির অভাব, নিরোধকের আমদানির শ্লথতা সব মিলিয়ে কেনিয়াসহ আফ্রিকার নানান অঞ্চলে কোভিড সময়ের গর্ভপাতের ছুটি। এতে কেবলমাত্র কেনিয়াতেই কমপক্ষে ১০ লক্ষ নবজাতক ভূমিষ্ঠ হবে। গর্ভনিরোধকের জন্য এরা মূলত এশিয়ার দেশগুলোর উপর ভরসা করে। কোভিড মোকাবিলায় রপ্তানি দেরি হওয়ায় অযাচিত অন্তঃসত্ত্বার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। গর্ভপাতের সব পরিকাঠামো বন্ধ। পরিস্থিতি এতোটাই মারাত্মক যে কোভিড সমস্যা মোকাবিলার পাশাপাশি Sweidesh International Development Cooperation Society কেবলমাত্র গর্ভপাতের জন্য ১.৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার DKT international নামক সংস্থার মাধ্যমে কেনিয়া এবং উগান্ডায় সাহায্য স্বরূপ দিয়েছে।

এমতাবস্থায় আমাদের দেশও লড়াইয়ের বাস্তব রূপটি মেলে ধরেছে। শুধু কোভিড ১৯ মোকাবিলাই নয়, কোভিড ১৯ আতঙ্কিত গর্ভবতীদের গর্ভপাতের পূর্ণ সমর্থন এবং করোনার পূর্ববর্তী সময়ের মতোই সহযোগিতা করছে আমাদের দেশ। লকডাউনে প্রায় ২.৩৮ মিলিয়ান অনামন্ত্রিত গর্ভাবস্হার হিসেব মিলেছে যার ১.৪৫ মিলিয়ানই চিকিৎসক দ্বারা গর্ভপাতের সুযোগ নেন। পরিবার পরিকল্পনার সবরকম পরিষেবা যদি মে মাসের শেষের মধ্যে না দেওয়া যায়, তাতে প্রায় ২৭.১৮ মিলিয়ান গর্ভবতীর এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকছে। অনুরক্ষিত গর্ভপাতের সংখ্যা বেড়ে ১.০৪ হতে পারে এবং প্রায় আড়াই হাজার গর্ভবতীর মৃত্যুর সম্ভাবনা থেকে যাচ্ছে। গত ১৪ ই এপ্রিল ভারত সরকার করোনা জর্জরিত সময়ে মোট ২০টি essential health service এর মধ্যে গর্ভপাতটিও রাখে। লকডাউনের জন্য বহু দম্পতি তৎক্ষনাৎ গর্ভপাতের জন্য যেতে পারছেন না ঠিকই কিন্তু একমাত্র আমাদের দেশেই abortion helpline number খোলা হয়েছে। থমসন রয়টার্সের তথ্য অনুযায়ী এদেশে বেশ কিছু পরিবার আর্থিক লড়াইয়ে র ভয়ে এই পরিস্থিতিতে এতোই আশঙ্কিত যে পাছে কণ্যা সন্তান ( ভ্রূণ পরীক্ষা ছাড়াই) হয় তাই গর্ভপাতের জন্য উৎকন্ঠিত।

গর্ভপাতকে জরুরী পরিষেবায় রাখলেও নিরোধক ব্যবস্হা লকডাউনে অনেকটাই নড়বড়ে। কারণ স্বাস্থ্য পরিষেবার ফোকাসে এখন করোনা। তাই কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য ও পরিবার সুরক্ষা মন্ত্রক রাজ্যগুলিতে Intrauterine contraceptives device ( IUCD) এবং স্টেরিলাইজেশন পরিষেবায় আপাত ভাটার নির্দেশ দিয়েছে। গত ২০ই মার্চ থেকেই এই পরিষেবাতে ঘাটতি আসে। প্রান্তিক গ্রামের বহু ভাবী মায়ের দশা ” শৈলবালা” র মতো। তারা অনেকেই গর্ভ সংক্রান্ত পরিষেবা পাচ্ছেন না। গর্ভপাতের জন্য দূর পথে আসার সাহস অনেকের নেই। শিশুর অনুমতি ছাড়াই এক অনিশ্চিত সময়ে তারা ইচ্ছের বিরুদ্ধে প্রসব করবেন। তবুও তুল্যমূল্য বিচার করে বলব, করোনা কষ্টে আমেরিকার মতো দেশ স্বেচ্ছা গর্ভপাত বা জন্মনিয়ন্ত্রনের বিষয় যখন এড়িয়ে যায়, তখন আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশ অনেকটাই উন্নত মানসিকতা প্রদর্শন করে। হবে নাই বা কেন, মহাভারতের আদি পর্বে গঙ্গার সাথে আমাদের পরিচয়। তিনি যে সাত সন্তান কে জলে ভাসিয়ে দেন তাতো গর্ভপাতেরই রূপক। এই কঠিন সময়েও তথাকথিত উন্নত দেশ আর উন্নয়নশীল দেশের জীবনভঙ্গিমার পার্থক্য স্পষ্ট। এই একটা ব্যবস্থার মধ্যে দিয়েই করোনা সময়ের একটি দেশের পরিবার, বিবাহ, যৌনজীবন, শ্রেণি এবং মহিলার অবস্থানের কতটা প্রকৃত একাডেমিক আর কতটা মেকি তা ধরা পড়েছে। মৌলিক ভাবে না হলেও ঐ উন্নত দেশে যে নারীস্বাধীনতা সংজ্ঞার কিছু পরিবর্তন হলো এবং নারী পুরুষ সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন কিছু উপাদানের সংযুক্তি এবং সামাজিক অধিকার পুনর্লিখন হলো তা নিয়ে সংশয়ের অবকাশ নেই। ব্যক্তিজীবনের গণতান্ত্রিকরণের পথে এখনো তথাকথিত উন্নত দেশ যে পিছিয়ে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সেকেন্ড সেক্স ( মহিলা) এই পরীক্ষাতেও সেকেন্ড ই থেকে গেল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *