পূর্ববঙ্গে হিন্দুদের স্মৃতি (৩৭) “ভিটেমাটি হারিয়ে ভারতে আসা শরণার্থীদের ভালোবাসা দিয়েছিলেন এক মা!“

আমাদের ভারত, ২৭ নভেম্বর: ওপার বাংলা থেকে কপর্দকহীন অবস্থায় কীভাবে অজস্র মানুষকে এপার বাংলায় চলে আসতে হয়েছিল, সেই সব কাহিনী আজ অস্পষ্ট হতে বসেছে। অরুণা মুখোপাধ্যায়রা আজ প্রায় হারিয়ে গিয়েছেন স্মৃতিপট থেকে। শুরুর শিরোনামে মৈত্রেয়ী সিনহারায় লিখেছিলেন ‘ডেলি নিউজরিল’-এ। সেটি শেয়ার করেছে ‘বঙ্গভিটা’ ফেসবুক গ্রুপ।

সময়টা ১৯৪৭ সাল। দেশভাগের কারণে চারিদিক তখন উত্তাল। ভিটেমাটি ছাড়া মানুষদের ভীড় সর্বত্র। আর বাকি জায়গাগুলোর মতো গুয়াহাটি স্টেশনেও তখন একই দৃশ‍্য। সহায় সম্বলহীন মানুষগুলো তখন খুঁজে বেড়াচ্ছে আশ্রয়। মাদার টেরেজার কথা তো সকলেই শুনেছি, কিন্তু খুব কমজনই জানি অরুণা দেবীর নাম।

সেই সময় অরুণা দেবী তাঁর স্বামীর সঙ্গে থাকতেন গুয়াহাটিতে। স্টেশন চত্বরে থাকা অসহায় মানুষগুলোকে দেখে মন কেঁদে উঠেছিল এই ভদ্রমহিলার। তিনি সিদ্ধান্ত নেন যেভাবেই হোক পাশে দাড়াবেন এই মানুষগুলোর। যেমনটি ভাবা ঠিক তেমনই কাজ। অবশ‍্য এই কাজে তিনি পাশে পেয়েছিলেন তাঁর স্বামীকে। দু’জন মিলে বালতি ভর্তি দুধ তুলে ধরেছিলেন ক্ষুধার্ত মানুষগুলোর সামনে।

বাড়ি ফেরার পথে বেশ কিছু উদ্বাস্তু মানুষ ও তাদের পরিবারকে নিয়ে এসেছিলেন নিজের সাথে। নাহ্, সেই মুহূর্তে তাঁর নিজেরও কিন্তু খুব বেশি কিছুই ছিল না। কারণ দেশভাগের ঠিক কিছুদিন আগেই স্বামীর সাথে গুয়াহাটি এসে উঠেছিলেন তিনি। সেই সদ‍্য গড়া নতুন সংসারেই জায়গা করে দিয়েছিলেন এই অসহায় মানুষগুলোকে। ছোট বাড়িতে জায়গার অভাবে বাধ‍্য হয়ে বাগানে ব‍্যবস্থা করেছিলেন মানুষগুলোর মাথা গোঁজার। তবে আশ্রয়টুকু দিতে পারলেও অতগুলো মানুষের মুখে অন্ন তুলে দেওয়ার মতো সাধ‍্য ছিল না অরুণা দেবীর। আর সেই আক্ষেপেই তিনি নিজেও অন্ন ত‍্যাগ করেন। বাকি জীবনটুকু শুধুমাত্র চা আর বিস্কুট খেয়েই কাটিয়েছেন।

সেদিন গুয়াহাটি স্টেশনে অসহায় মানুষগুলোর পাশে দাড়ানোটা শুরু ছিল মাত্র। এরপর অরুণা দেবী যতদিন বেঁচেছিলেন মানুষের সেবা করে গিয়েছেন। প্রাথমিক স্কুল থেকে শুরু করে সেলাই স্কুল, আঁকার স্কুল, গানের স্কুল খোলেন মানুষকে স্বাবলম্বী করে তোলার জন‍্য। অন‍্যের দুঃখে কাতর হওয়া এই মানুষটির আসল পরিচয় জানতে গেলে পিছিয়ে যেতে হবে বেশ কিছু সময়। ১৯১৬ সালে বিক্রমপুরে জন্ম নেন অরুণা দেবী। খানিক বড় হলে তার বিয়ে হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র যদুলাল মুখোপাধ‍্যায়ের সঙ্গে। পরবর্তীকালে তার স্বামী কটন কলেজের রসায়ন বিভাগের প্রধান হিসাবে নিজের চাকরি জীবন শুরু করেন। তবে তা খুব বেশিদিনের জন‍্য নয়।

দেশভাগের কিছুদিন আগের টালমাটাল পরিস্থিতিতেই তারা চলে আসেন গুয়াহাটি। এরপর ১৯৬৮ সালে যদুবাবু মারা যান। সংসারে তখন চার ছেলে ও এক মেয়ে। অরুনাদেবীর তিন ছেলেও আর বেঁচে নেই। বাকি এক ছেলে ও মেয়ে থাকেন বিদেশে। বারবার বলা সত্বেও কিন্তু তিনি সন্তানদের সাথে বিদেশে পাড়ি দেননি। তাঁর বক্তব্য ছিল, “বাঁচতে হলে এদেশেই বাঁচব, মরলেও এদেশেই।”

২০১৬ সালে এক পত্রিকার সাক্ষাৎকারে অরুণা দেবী বলেন, “যতদিন বাঁচবো কাজ চালিয়ে যাব মানুষের জন্য। এখনো শুক্লেশ্বরে গেলে ভিখারিদের দেখে কান্না পায়, কোন মুখে ভাত খাওয়ার কথা ভাবব?” ২০১৬ সালে প্রজাতন্ত্র দিবসে অরুণা দেবীকে সম্বর্ধনা দিয়েছিলেন তৎকালীন মুখ‍্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ। শুধু তাই নয়, এই মহীয়সী নারীর জীবন নিয়ে তথ‍্যচিত্র তৈরি করেছেন ববিতা শর্মা। মানুষের সেবায় ব্রতী থাকা এই নারী তাঁর পল্টনবাজারের বাড়ি ও পাড়ার স্কুলগুলি ছেড়ে কোথাও যেতে নারাজ ছিলেন। সেই মতোই নিজের সেই পল্টনবাজারের বাড়িতেই ২০১৮ সালের ২৩ এপ্রিল সন্ধ্যায় তিনি চিরদিনের মতো চলে যান। চলে গেলেও মানুষের জন‍্য করা তাঁর সেবা তাঁকে চিরস্মরণীয় করে রাখবে।।

তথ্য ও চিত্র ঋণ – বঙ্গ ভিটা এবং মহঃ সাইফুল ইসলাম।
সঙ্কলন— অশোক সেনগুপ্ত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *