
সঙ্কলন— অশোক সেনগুপ্ত
আমাদের ভারত, ২৫ ফেব্রুয়ারি: মহারাজা গিরিজানাথ রায়বাহাদুরের পালকপুত্র মহারাজা জগদীশনাথ (১৯১৯-৬২) ছিলেন দিনাজপুর এস্টেটের শেষ নৃপতি ও রায় বংশের শেষ রাজা। তিনি ছিলেন জমিদার, সমাজসেবক, বিদ্যোৎসাহী। ছিলেন দিনাজপুর রাজবংশের দশম উত্তরাধিকারী। জন্ম ১৮৬২ সালে, রাজা তারকনাথ (১৮৪১-১৮৬৫) এবং রাণী শ্যামামোহিনীর দত্তক পুত্র।
তাঁর বাল্যশিক্ষা শুরু হয় রাজবাড়ির একটি পাঠশালায় (বর্তমানে জুবিলি হাইস্কুল)। এরপর তিনি কলকাতায় এবং
মধ্যপ্রদেশের (ভূপাল) রাজকুমার কলেজে শিক্ষা লাভ করেন। গিরিজানাথ রায় কোর্ট অব ওয়ার্ডস-এর অধীনে দিনাজপুরের জমিদার হন। ১৮৮৩ সালে পূর্ণবয়স্ক হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত মাতা শ্যামামোহিনী জমিদারি পরিচালনা করেন।
গিরিজানাথ রায় রাজবাড়ির পাঠশালাকে ১৮৮৭ সালে মিডিল ভার্নাকুলার স্কুলে উন্নীত করে এবং মহারাণী ভিক্টোরিয়ার ৫০তম জন্ম জয়ন্তী পালন উপলক্ষে স্কুলটির নামকরণ করেন জুবিলি স্কুল। পরবর্তী সময়ে স্কুলটি মিডিল ইংলিশ স্কুলে উন্নীত হয়। দিনাজপুর শহরের বালুবাড়ি মৌজায় তিনি ১৯১৩ সালে প্রতিষ্ঠা করেন মহারাজা গিরিজানাথ স্কুল। রায়গঞ্জ হাইস্কুল (বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গে) নির্মাণে তিনি ১০ বিঘা জমি দান করেন। ১৯১২ সালে জিলা স্কুলের দক্ষিণ পাশে হিন্দু ছাত্রদের জন্য লিয়ন হোস্টেল তাঁর অনুদানে নির্মিত।
১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে ব্রিটিশ সরকারের ভূমিকা সমর্থন করায় ১৯০৬ সালে গিরিজানাথ রায় ‘মহারাজা বাহাদুর’ উপাধি এবং ১০০ সদস্যের একটি সশস্ত্র সেনাদল রাখার অধিকার পান। একজন বিশ্বস্ত ব্রিটিশ সামন্ত হিসেবে কলকাতা ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল নির্মাণে ২৫ হাজার, সপ্তম এডওয়ার্ডের স্মৃতিরক্ষার্থে ১০ হাজার টাকাসহ বহু সরকারি কাজে অর্থদান করেন। এ ছাড়াও তিনি শহরের ময়লা নিষ্কাষণের জন্য গিরিজা খাল তৈরিতে ৭৫ হাজার টাকা এবং ঘাঘেরা খাল সংস্কারের জন্য ৩০ হাজার টাকা দান করেন।
মহারাজা গিরিজানাথ বহু সমিতি সংস্থার সাথে জড়িত ছিলেন। এর মধ্যে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন, বেঙ্গল ল্যান্ড হোল্ডার্স অ্যাসোসিয়েশন, বেঙ্গল সঙ্গীত সমাজ, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ, রঙ্গপুর সাহিত্য পরিষদ, উত্তরবঙ্গ সাহিত্য সম্মিলনী উল্লেখযোগ্য। তিনি ১৯১৯ সালে নিখিল ভারত কায়স্থ সভার সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯১২ সালে তিনি কলকাতায় অনুষ্ঠিত কায়স্থ সভার অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।
১৯১৪ সালে অনুষ্ঠিত এলাহাবাদ সম্মেলনেও তিনি সভাপতিত্ব করেন। ১৯১৩ সালে উত্তরবঙ্গ সাহিত্য সম্মিলনীর ৬ষ্ঠ অধিবেশনে (দিনাজপুর) তিনি অভ্যর্থনা কমিটির সভাপতি ছিলেন। উক্ত অধিবেশনে বাংলা অসমের নামকরা সাহিত্যিক ও ইতিহাসবিদরা যোগদান করেন। তিনি ডায়মন্ড জুবিলি থিয়েটার কোম্পানি (১৮৮৫), দিনাজপুর নাট্য সমিতি (১৯১৩), দিনাজপুর স্পোর্টিং ক্লাব, আর্য পাঠাগার, দিনাজপুর সমিতি সহ বহু স্থানীয় সংস্থা সংগঠনের পৃষ্টপোষক ছিলেন।
গিরিজানাথ তিনবার জেলা বোর্ডের সদস্য, দু’বার অনারারি ম্যাজিস্ট্রেট এবং বড়লাটের দিল্লি কাউন্সিলের সদস্য ছিলেন। তিনি ছিলেন দিনাজপুর মিউনিসিপ্যালিটির মনোনীত কমিশনার (১৮৮৪) এবং তিনবার মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এ ছাড়াও তিনি দিনাজপুর জেলা বোর্ডের প্রথম নির্বাচিত চেয়ারম্যান ছিলেন। ভারত ভাগের পর তিনি সপরিবারে কলকাতায় চলে যান এবং সেখানেই ১৯১৯ সালে মারা যান।
‘বঙ্গভিটা’ ফেসবুক গ্রুপে আবু হানিফা (জেলা দিনাজপুর, থানা চিঠির বন্দর, মোবাইল:+৮৮01738373345 কৃতজ্ঞতা @beautiful Dinajpur) লিখেছেন, “দিনাজপুর রাজপরিবারের অধিকাংশ রাজাই পুত্রসন্তান লাভ করেননি, ছিলেন পালকপুত্র। এমনকি রায়বাহাদুর গিরিজানাথ নিজেও মহারাজা তারকনাথের পালকপুত্র ছিলেন৷ সেক্ষেত্রে, শাসনের সুযোগ পেলে রাজকুমার জলধিনাথ হয়তো রাজবংশে নজির গড়তে পারতেন। তাঁর জন্য নির্মিত কুমার ভবনটি এখনও বেদখল অবস্থায় আছে। দেশভাগের পর ১৯৫০ সালে জমিদারি বিলুপ্ত হয়। মহারাজা জগদীশনাথ সপরিবারে কলকাতায় পাড়ি জমান এবং সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন৷ রাজকুমারের অকালমৃত্যু হয়, বাকি সন্তানদের ভাগ্যে কি ঘটেছিল, তা জানা যায়নি।”
২৬/২/২৩-এ ফেসবুকে এই পোস্ট করার এক ঘন্টা বাদে ২৬টি প্রতিক্রিয়া এসেছে। জাকির হোসেন প্রতিক্রিয়ায় লিখেছেন, ”অসম্পূর্ণ ইতিহাস। সেই সময়কার পাকিস্তানি শাসন এই রাজবাড়িটি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবে সংরক্ষণ না করার কারণে জাতি বর্ণ নির্বিশেষে রাজবাড়িটির বেশিরভাগ অংশে লুটপাট, চুরি আর দখল প্রক্রিয়ায় অংশ নিয়ে এর মূল সৌন্দর্য ধ্বংস করে, যার পরিণতি আজকের এই ভগ্নদশার ছবিগুলি। আমার মনে আছে প্রায় ৩২ বছর আগে যখন এটি দেখতে গিয়েছিলাম তখনও এর কাঠামো বেশ ভালো ছিলো। আমি দোতলায় উঠে রাজ দরবারের অংশটুকু দেখছিলাম আর আমার দেখা রাজকীয় সিনেমার সাথে একে মেলাচ্ছিলাম! বেশ মিলে যাচ্ছিলো। কিন্তু কিছুদিন পূর্বে ঐ একই জায়গায় গিয়ে যা দেখে স্মৃতির পাতা উল্টিয়েও আর মেলাতে পারলাম না। মানুষ ইচ্ছে মতো ইট খুলে নিয়ে গেছে। অথচ বালিয়াটি জমিদার প্রাসাদটির (মানিকগঞ্জ) চেয়েও দিনাজপুর মহারাজার ইতিহাস ও নিদর্শন সেটা ভালো হোক আর মন্দ হোক ঐতিহ্য সম্বলিত ছিলো। পাকিস্তান সরকার বালিয়াটিকে প্রত্নসম্পদ হিসেবে একই সময় ঘোষণা করলেও দিনাজপুর রাজবাড়িকে তা করেনি। যার ফলে দিনাজপুরের এই ঐতিহ্য আজ ধুলোয় মিশে যেতে বসেছে। অথচ এই মহারাজার ইতিহাস এর সাক্ষী রামসাগর, সুখসাগর ও কান্তজিউ মন্দির পর্যটনের অংশ হিসেবে সংরক্ষণ করা হয়েছে। ইতিহাস মানুষকে শিক্ষা দেয় মহারাজার ইতিহাসকে সুরক্ষিত রাখলে জাতি হয়তো ইতিহাস থেকে কিছু শিক্ষা অর্জন করতে পারতো। ভালো মন্দের বিচার করতে পারতো। ধন্যবাদ।”
নাসরিন বানু লিখেছেন, ”দিনাজপুর আমার জন্মভূমি বলে নয়। এই দেশের প্রায় সবকটি পুরোনো স্থাপনা ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়া হয়েছে। অথচ যেখানে সরকারি ভাবে এগুলোর সংস্কার করা, রক্ষণাবেক্ষণ করা উচিৎ ছিল। এটা যেমন দর্শনীয় স্থান হিসেবে পরিচিত লাভ করতো তেমনি দেশও উপকৃত হতো। কিন্তু ঐ আমরা তো এই দেশটাকে কখনও ভালোইবাসিনি। প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগের দায়িত্ব দেশের এইসব প্রাচীন ঐতিহ্যের বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা। একটা সংশোধন করার আছে। ঠিকানা চিরির বন্দর হবে।