পূর্ববঙ্গে হিন্দুদের স্মৃতি (৭৯) নবাবগঞ্জের কলাকোপার’ব্রজ নিকেতন’

আমাদের ভারত, ২২ মার্চ: বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন সময়ে অনেক প্রতাপশালী জমিদারদের জমিদারি ছিল। জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হবার পর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক জমিদার পরিবার পার্শ্ববর্তী দেশে পাড়ি জমিয়েছেন। কালের আবর্তে বেশীরভাগ জমিদারবাড়ি দখলদারদের হাতে (দখলদার কোনো নির্দিষ্ট ধর্ম/ বর্ণ/ রাজনৈতিক দলের নয় )। বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর কিছু জমিদারবাড়ি নিজেদের হস্তগত করেছে – কিছু সংস্কার করেছে আর বাকীগুলো পড়ে আছে অতল গহ্বরে।অধিগ্রহণকৃত বাড়িগুলোর শতকরা এক ভাগেরও কম বাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ চমৎকার, বাকীগুলোর অবস্থা তথৈবচ।

অনেকদিন পর একটা জমিদারবাড়ি আমার নজর কেড়েছে। নবাবগঞ্জ এর কলাকোপার অন্যতম নান্দনিক স্থাপনা ‘ব্রজ নিকেতন’। একটা বড় এলাকার ভেতর অনেকগুলো স্থাপনা আমরা দেখতে পাই। জমিদারবাড়ি, পুকুর, মন্দির, স্কুল, নদীর পাশে বাধানো ঘাট….. কী নেই এখানে!!

প্রায় ১৫০ বছরের পুরানো ১.৫৫ একর এলাকা নিয়ে এই প্রাসাদ নির্মাণ করেন জমিদার ব্রজেন রায় (সুদর্শন রায়)। প্রাসাদের নাম দেন ‘ব্রজ নিকেতন’। কারুকার্য শোভিত পিলার…টানা বারান্দা দেওয়া দোতলা শ্বেতশুভ্র বাড়িটি দেখে মন ভরে যায়। বিশাল গেট পেরলে লম্বা পায়ে হাঁটা পথ। দুইপাশে ফুলের বাগান। অনেকগুলো সিঁড়ি বেয়ে বাড়িটির নীচতলায় যেতে হয়।

বালিয়াটি জমিদারবাড়ির সাথে আকৃতিগত মিল রয়েছে। বাড়িটির দুই দিকেই মনোরম ফুলের বাগান। ফোয়ারা ও দোলনা রয়েছে বাগানে। পেছনে নারকেল, সুপারির বাগান। লোহার গ্রিল দেওয়া ছোট ঘর, যেখানে একসময় পোষা হরিণের খামার ছিল বলে জানা যায়। সারা বাড়ি জুড়ে এখন অনেকগুলো রাজহাঁস আর তিতির ঘুরে বেড়াচ্ছে।

বাড়ির একপাশে তিন স্তরের সবুজাভ ছাউনি। কৌতুহল নিয়ে এগিয়ে দেখি, কী সুন্দর একটা শান বাধানো পুকুরঘাট ! বিশাল পুকুর। এই ঘাট দেখলেই জমিদার সাহেবের রুচি সম্পর্কে ধারণা হয়ে যায়। এত সুন্দর পুকুরঘাট আমি খুব কম জমিদারবাড়িতে দেখেছি! অল্প কিছুদিন আগেই ব্রজ নিকেতন দখলদার মুক্ত হয়ে প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদপ্তরের আওতাধীন হয়েছে।

এই প্রাসাদের পাশেই রয়েছে একটি জমিদারবাড়ি (এই বাড়ির প্রকৃত নাম পাওয়া যায়নি)। কয়েক বছর আগে সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউট এর আমরা একদল সহপাঠী এখানে এসেছিলাম। এটিও বিশাল জায়গা নিয়ে নান্দনিকভাবে নির্মিত। সাদা রঙের দোতলা বাড়ি, দুইপাশে বাগান ও সামনের দিকে বিশাল শান বাধানো পুকুরপাড়। চওড়া সিঁড়ির দুইপাশে সাদা-লাল রঙ করা টবে বিভিন্ন গাছ শোভা বর্ধন করছে। এখানে আবার সুন্দর সিঁড়ি দেওয়া দোতলা একটা হাওয়া মহলও আছে।

বর্তমানে বাড়িটিতে একটি রেস্টুরেন্ট উদ্বোধন করা হয়েছে। আমি যেদিন গিয়েছিলাম, তখন সংস্কার কাজ চলমান ছিল।

এর পাশেই আছে কোকিলপ্যারি জমিদারবাড়ি, এটিও দোতলা। সংস্কারের অভাবে ভগ্নপ্রায়। কাঠের টানা বারান্দার কিছু অংশ এখনো দৃশ্যমান৷ রাস্তার অপরপ্রান্তে অবস্থিত কোকিলপ্যারি বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আবাসন হিসেবে এই বাড়িটি ব্যবহৃত হচ্ছে। সামনে বিশাল মাঠ ও ভাঙ্গা মন্দির। কয়েকবছর আগেও মন্দিরটি ব্যবহার যোগ্য ছিল; এইবার একেবারেই ধ্বংসস্তুপ হিসেবে পেলাম। আগে এই মাঠে মেলা বসতো। এইবার দেখলাম, অস্থায়ী বাউন্ডারি দিয়ে বাড়িটিকে সুরক্ষিত করা হয়েছে।

রাস্তার অপর দিকে রয়েছে আনন্দ কুটির। কাস্ট আয়রনের কারুকার্য করা পিলার দেওয়া টানা বারান্দা রয়েছে এই বাড়িতে। এই বাড়ির ইতিহাস জানা যায়নি।

পাশের সরু রাস্তা দিয়ে কিছুটা এগোলেই আনসার ও ভিডিপির সংরক্ষিত এলাকা। এখানেই রয়েছে আরও কয়েকটি জমিদারবাড়ি, যা তেলিবাড়ী / মঠবাড়ি নামে পরিচিত। মূলতঃ এটি জমিদারবাবু লোকনাথ সাহার বাড়ি। প্রতিটি বাড়ি পুকুর বেষ্টিত। আছে সাজানো বাগান। প্রতিটি বাড়িরই রয়েছে নজরকাড়া সৌন্দর্য! রয়েছে অজানা ইতিহাস।

এর এক পাশে বয়ে চলেছে ইছামতী নদী। এগিয়ে যেতেই দেখলাম অপূর্ব নদীর ঘাট। সিঁড়িগুলো ভেঙ্গে গেলেও কী আভিজাত্য সেখানে! নদীর এক পাড়ের বেশ খানিকটা অংশ ইট দিয়ে বাঁধের মতো করে দেওয়া, যা এখন ভগ্নপ্রায়। ভেঙ্গে যাওয়া সিঁড়িতে বসে স্রোতস্বিনী ইছামতীর মৃদু ঢেউ তুলে বয়ে যাওয়া দেখলাম বেশ খানিকটা সময় ধরে। ইছামতী নদীর উতল হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে ফিরে এলাম ব্রজ নিকেতন থেকে নিজ নিকেতনে।

বি:দ্র: ব্রজ নিকেতন এর ইতিহাস নিয়ে তেমন কোনো তথ্য পাইনি। এই অঞ্চলে যদুনাথ সাহা, লোকনাথ সাহা, মধুবাবু, রাধানাথ সাহার বাড়ি সহ আরও কয়েকটি দৃষ্টি নন্দন প্রাচীন বাড়ি রয়েছে। ব্রজ নিকেতন বাড়িটি সরকার অধিগ্রহণ করার পর জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়নি বলে সেখানে এখন ঢোকা যায় না।

সোনিয়া রহমানের লেখা, ‘সেভ দি হেরিটেজেস অফ বাংলাদেশ’ ফেসবুক গ্রুপ থেকে।
সঙ্কলন— অশোক সেনগুপ্ত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *