সুখলতা রাও এবং ‘নিজ পড়’-র স্মৃতিসুখ

কল্যাণ চক্রবর্তী
আমাদের ভারত, ২০ মার্চ: সেদিন (৯ ই জুলাই) সাহিত্যিক সুখলতা রাও (২৩ শে অক্টোবর, ১৮৮৬ — ৯ ই জুলাই, ১৯৬৯)-এর প্রয়াণ দিবস বলে তাঁকে স্মরণ করেছিলাম, তা নয়। ইদানীং তাঁকে প্রায়ই স্মরণ করি, কারণ আমরা হারিয়ে যাওয়া ছোটবেলা ফিরে পেতে চাই। ছোটবেলাকে মনে মনে ডেকে আনবার জন্য আমাদের হরেক স্মৃতির পর্বতমালা হিমালয়ের মতো জমে থাকে সবসময়। সুখলতা রাও-এর অনবদ্য শিশুপাঠ্য বইটি তারই এক অন্যতম চূড়া। তাই বারবার মনের পাতায় ভীড় করে আসে ‘নিজ পড়’। এখনও নিজেই পড়ছি।

কিন্তু তখন জানতাম না, এই সুখলতা রাও কে! পদবীর জন্য তাঁকে অবাঙালি ভাবতাম, হয়তো অনেকেই ভাবতেন। ভাবতাম এমন একজন অবাঙালি মহিলা কীভাবে মনের মত বাংলা লিখেছেন! তিনি যে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর কন্যা, তিনি যে কবি ও শিশু সাহিত্যিক সুকুমার রায়ের দিদি, তা জানতাম না তখন৷ তাঁর স্বামী ওড়িশার চিকিৎসক ও প্রখ্যাত সিভিল সার্জেন ডা. জয়ন্ত রাও। বিয়ের পর সুখলতা কটকে চলে যান। সেখানে এবং সামগ্রিক ওড়িশায় সমাজসেবায় বিশেষ অবদানের জন্য স্বামী-স্ত্রী যৌথভাবে ‘কাইজার-ই-হিন্দ’ পদক পেয়েছিলেন।

এবার আসি সুখলতা রাও-এর চিত্রকল্প নির্মাণের মুন্সীয়ানায়। শিশুপাঠে মুন্সীয়ানা দেখানোর সুযোগ বিশেষ থাকে না। আ-কার, উ-কার, ঊ-কার প্রভৃতির মধ্যে সীমাবদ্ধ শব্দের গণ্ডীর মধ্যেই ছোটো ছোটো শিশুবোধ্য গদ্য, পদ্য, সংলাপ লিখতে হয় সহজ সরল বাংলায়, যাতে শিশু উচ্চারণ করতে পারে, লিখতে পারে, শিখতে পারে। যেহেতু সুখলতা রায় (রাও) নিজে একজন অসাধারণ শিল্পী ছিলেন, পুরো পরিবারটিই ছবি আঁকায় পারদর্শী ছিল, তাই পাঠের সঙ্গে চিত্রপাঠ যোগ করেই তিনি পুরো বিষয়টাকে সুখপাঠ্য করে তুলেছিলেন। যারা একসময় এই বইটি ক্লাস ওয়ানে পড়েছেন, ছবিগুলি আজও মনে করতে পারবেন। কারণ লেখা ও আঁকা ভোলবার নয়।

কাক চড়াই ছানা ধরল।
কত চড়াই লড়াই করল।
তখন কাক বাছাধন ভাগল।

ছবি কথায় বিশেষ কথাগুলিকে ছবি দিয়ে রিপ্লেস করে শিশুর বোধকে ত্বরান্বিত করেছিলেন-
বিড়াল (ডিম) নিল। ধর ধর। কাল দিদির (মাছ) নিল। আমি (ছাতা)র বাড়ি মারলাম। দিদি (পাখা)র বাড়ি মারল। লাগল না। (বিড়াল) পালাল।

ময়রার ছবিটিও অসাধারণ। তখন আমাদের বিশ্বগ্রাসী খিদে। তারমধ্যে মণ্ডামিঠাই-এর ছবি থাকলে কার না জিভে জল আসে!
ময়রা খাবার বানায়।
খাজা গজা বানায়।
বরফি জিলিপি নিমকি
কত কি বানায়। কত
বিকি কিনি। আমরাও
খাবার কিনি। ময়রার
বড় উনান। বড় বড়
কড়া। বড় বড় থালা
ভরা ছানা চিনি।

বইরের মধ্যে রানীর ছবিটিও বেশ লেগেছিল। আর পরীর ছবি। হাতির পাল বন বাদাড় ছারখার করল, যে ছবিতে, সেটিও ভারী সুন্দর। একটি মজার ছবিতে দেখা যায় গ্রামের পথে অ্যাম্বাসাডারের মতো একটি গাড়ি চলে আসায় এবং হর্ণের আওয়াজে গরু ভয় পেয়ে খানায় গড়িয়ে পড়ছে —
হাওয়া গাড়ি যায়
গাই ভয় পায়।
বলদ পালায়,
গড়ায় খানায়।

একটি টিকটিকি-র বড় ছবি দিয়ে ছড়াটি ছিল, আমরা যে টিকটিকি দেখতে পেয়ে কতবার আবৃত্তি করেছি, তার ইয়ত্তা নেই —
টিকটিকি টিকটিক।
বল নাকি ঠিক ঠিক?
থাক ঘর দরজায়,
আলমারি আলনায়।
টিয়াও না, পায়রাও না
ডিম পাড়, হয় ছানা।

এক ঘুমন্ত পবিত্র খুকুমণি-র ছবি ছিল। নীচে লেখা —
দুধ খাও চুম চুম
খুকুমণি দাও ঘুম।

একটি কালোমুখ হনুমানের ছবি, পাশে গাছ ভর্তি ফল। আর পাশে লেখা ছড়া–
হনুমান লাফ দিল।
হুকু হুকু ডাক দিল।
গাছ ভরা আম ছিল।
খপাখপ হনু নিল।

‘ফানুস’ লেখাটির মাধ্যমেই আমি প্রথম ফানুসের সম্পর্কে জানতে পারি। এটা যে বিপজ্জনক একটি অগ্নিবাজি, তাও জানতে পারি —
পাড়ায় মাঠটায় সবাই ফানুস ওড়াল। খুব বড় ফানুস। হাওয়ায় ভাসল ফানুসটা। খানিক উড়ল। তারপর আগুন লাগল তার গায়। পড়ল চালাঘরটার উপর। সবাই ছুটল। জল ঢালা হ’ল চালাটায়। খড় কিনা তাই আগুন লাগবার ভয় ছিল।

হাফপ্যান্ট আর গেঞ্জি পড়ে চুল আঁচড়ে পড়তে বসেছে ঋষিপদ ঊষাদিদির ভাই। দেখা যাচ্ছে ঋষিপদ ‘ঋজুপাঠ’ পড়ছে।

যে ছড়াটি আমাকে কৃষিবিজ্ঞান সম্পর্কে বিশেষ আগ্রহী করে তুলেছিল, তা কৃষি কাজের মাধ্যমে প্রাপ্ত পৃথিবীর ফসল। কৃষকই এই কাজের সেরা শিল্পী।
কৃষি কর কৃষি কর কৃষি কর ভাই
পৃথিবীর মাটি কর চাষ।
কৃষির কৃপায় ধান মসুর কলাই
সকলি ত পাই বার মাস।

গ্রীষ্মের বিকেলে কালবৈশাখীর ঝড়েরছড়ার চিত্রটিও অনবদ্য। কালো মেঘের মধ্যে ডানামেলা সাদা বক ফিরছে বাসায়, আর তারই চিত্রকল্পের চমৎকার বর্ণনা —
চেয়ে দেখ ঘন মেঘ
ছেয়ে গেছে আকাশে।
পাখিরা বাসায় ফেরে
ডানা মেলে বাতাসে।

কৃষ্ণচূড়ার ফুলে-পাতায় বুলবুল পাখিরা ডানা ঝাপটানি প্রকৃতিতেও দেখি, দেখি বইয়ের পাতাতেও —
গাছে গাছে বুলবুল
নাচে দেখ চুলবুল,
ফুল নাড়ে বার বার,
ঝরে পড়ে পাতা তার।

বর্ষা বিষয়ক কয়েকটি লেখা আছে বইটির মধ্যে। যেমন —
আষাঢ় এল আষাঢ় এল
বরষা কাল পড়ল।
টাপুর টুপুর টাপুর টুপুর
বাদল ধারা ঝরল।
বর্ষার আরও একটি চিত্রকল্প ছবি হয়ে আমাদের পাঠ শেখাতে আসে। ছবিতে দেখা যায় দালান কোঠার দোতালার জানালার উপর এসে বসেছে আধভেজা পাখি। কালমেঘ থেকে বৃষ্টি পড়েই যাচ্ছে। ছড়াটির মধ্যে বালকবেলার বর্ষার বিকেল নিমেষে ধরা দিত —
বরষার পথ ঘাট
জল থৈ থৈ রে।
ভিজে কাক দেয় ডাক
জানালায় ঐ রে।
যাই আর কই বল
ঘরে বসে রই রে।
বৈকালে সবে মিলে
করি হৈ হৈ রে।

‘ঘুড়ি’ গদ্যটির মধ্যে ছবিসহ এমন একটি আবেদন, বারবার চেয়ে থাকতে হত বইটার দিকে।
দাদা একটা লাল ঘুড়ি ওড়াল। ঐ আবার একটা সাদা ঘুড়ি উড়ল। এই আবার নীল ঘুড়ি। লাল ঘুড়ির সূতা কাটা পড়ল। ঘুড়ি আটকাল জাম গাছটায়। ওটা এক বুড়ির বাড়ির জামগাছ। দাদা ঘুড়ি চাইল। বুড়ি দিল।

ছিল জাতীয় পতাকার সুন্দর ছবি সহ বর্ণনা। পতাকায় কোথায় কী রঙ আছে, কোথায় চক্র, সবই আমাদের মুখস্ত ছিল —
এই আমাদের দেশের পতাকা। এতে তিনটি রঙ আছে। ঘাসের মত সবুজ রঙ। দুধের মত সাদা রঙ। আর গেরি মাটির মত লাল রঙ। পতাকার মাঝখানে চাকার ছবি।

‘ভোলা’ নামে গদ্যটির সঙ্গে আঁকা ছবিটি অসাধারণ। ধুতি পাঞ্জাবি পড়া বয়স্ক ভদ্রলোকটি কেমন তার ধবধবে সাদা বিছানায় ভুল করে নিজের হাঁটবার লাঠিটি রেখে দাঁড়িয়ে রয়েছেন দরজার ধারে —
একজন লোক ভারি ভোলা ছিল। একদিন লাঠি নিয়ে বেড়াতে গিয়েছিল। বেড়িয়ে ফিরে সে নাকি লাঠিটাকে বিছানায় শুইয়ে দিল। আর নিজে ঘরের কোণে খাড়া হয়ে রইল ভুলে।

নদীতে নৌকা, তাতে বৈঠা হাতে এক মাঝি সদ্য বিবাহিত দম্পতিকে নিয়ে আসছেন —
নৌকা করে বৌ এল রে,
পাড়াপড়শী কই!
দৌড়ে হারু আনরে নাড়ু,
রাবড়ি মিঠাই দই।

‘খেলার ছড়া’-য় মা-ছেলের এক অনাবিল প্রশান্তির ছবি “ঘুঘু সই,/পুত কই?/হাটে গেছে।/হাট কই?/পুড়ে গেছে।/ছাই কই?/গোয়ালে আছে।/সোনা-কুড়ে পড়বি না/ছাই-কুড়ে পড়বি?”
বইটির পাতা আজও খুলে খুলে পড়তে ইচ্ছে করে। পড়াতে ইচ্ছে করে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *