ফের দুর্ঘটনা, ফের প্রশ্নের মুখে বাংলার পরিযায়ী শ্রমিক

অশোক সেনগুপ্ত, আমাদের ভারত, ৩ জুন: মালদার গ্রামের পাঁচ শ্রমিক চেন্নাই যাচ্ছিলেন কাজে। তাঁদের মধ্যে দুই জনকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। বাকিরা গুরুতর জখম। খবর পৌঁছাতেই গ্রামজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। শনিবার ভোরে খবর আসে নিখোঁজ দুই জনের মধ্যে একজনের দেহ পাওয়া গিয়েছে। এমনকী পরিবারের লোকেদের মোবাইল ফোনের মাধ্যমে মৃতদেহের ছবি দেখানো হয়।

বালেশ্বরে ট্রেন দুর্ঘটনায় হতাহতদের একটা বড় অংশ পশ্চিমবঙ্গের পরিযায়ী শ্রমিক। স্বাভাবিকভাবেই ফের বেআব্রু হয়ে পড়েছে এ রাজ্যের অর্থনীতির অবস্থা। কারণ, লকডাউন ও সাম্প্রতিক নানা ঘটনায় দেখা গিয়েছে বিভিন্ন রাজ্যে তথাকথিত ‘অড জব’-এ একটা বড় অংশে পশ্চিমবঙ্গের ছেলেমেয়েরা।

বালেশ্বরের ট্রেন দুর্ঘটনায় বাসন্তীর পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে একই পরিবারের তিন সদস্যের মৃত্যুতে শোকস্তব্ধ হয়ে গিয়েছে সেই পরিবার। তিন ভাই হারান গায়েন, নিশিকান্ত গায়েন, দিবাকর গায়েনের মৃত্যু হয়েছে এই ট্রেন দুর্ঘটনায়। এরা সকলেই পরিযায়ী শ্রমিক বলে জানা গিয়েছে। অন্ধ্রপ্রদেশে ধান রোয়ার কাজে যাচ্ছিলেন এই তিনজন। এর আগেও একাধিকবার গিয়েছিলেন। কিন্তু গতকাল যাওয়ার পথেই ঘটে দুর্ঘটনা।

এই অবস্থায় উদ্ধারকাজ দেখার ফাঁকে শনিবার পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি সভাপতি সুকান্ত মজুমদার ফের পরিযায়ী শ্রমিকের নজির টেনে রাজ্য সরকারকে বিঁধেছেন, রাজ্যের কর্মসংস্থান তলানিতে চলে যাওয়ার অভিযোগ এনে। যে অভিযোগ তিনি ও দিলীপ ঘোষ-সহ বিজেপি নেতৃত্ব সাম্প্রতিক অতীতে তুলেছেন নানা সময়ে।

২০২২ এর ১৬ নভেম্বর। মিজোরামের নাহথিয়াল জেলায় পাথর খাদানে ধসে মৃত্যু হয় ১২ জন শ্রমিকের। তাঁদের মধ্যে ৮ জনের দেহ উদ্ধার হয়। ৫ জনই পশ্চিমবঙ্গের। তাতে রাজনৈতিক রঙও লাগতে শুরু করে। সেই সময় সুকান্ত মজুমদার প্রতিবাদে সরব হয়ে জানান, এ রাজ্যে কাজ নেই। তাই চাকরির টানে ভিন রাজ্যে যেতে হয়। মৃত তিন শ্রমিকের ছবি-সহ টুইট করেন সুকান্তবাবু। লেখেন, “মিজোরামে ৫ পরিযায়ী শ্রমিকের মৃত্যু। মুখ্যমন্ত্রীর ১.৫ কোটি চাকরির যদি সত্যতা থাকতো তাহলে তেহট্টের ৩, চাপরার ১ ও উত্তর ২৪ পরগনার ১ একজন বাঙালি যুবকের মৃত্যু হতো না। এর আগেও রাজ্যের যুবকরা পেটের টানে বাইরে গিয়ে মারা গেছেন। এই মৃত্যর দায় শিল্প ও চাকরি বিরোধী মুখ্যমন্ত্রীকেই নিতে হবে।”

করোনা পর্বেও বার বার উঠে এসেছে পশ্চিমবঙ্গের পরিযায়ী শ্রমিকদের দুর্দশার কথা। কাজ নেই। টাকা শেষ। জুটছে না খাবার। অথচ, বাড়ি থেকে বহু দূরে আটকে থাকতে হয়েছে। তাই সম্বল বলতে ক্ষোভ, রাগ আর প্রশ্ন। নবি মুম্বই থেকে ২৩ দিন ধরে সাইকেল চালিয়ে বাড়ি ফিরেছিলেন ছাপাখানার শ্রমিক হুগলির হরিপালের বরুণ মিত্র। খানাকুলের শঙ্কর অধিকারী পঞ্জাবের অমৃতসরে গয়না তৈরির কাজ করতেন। বহু দিন সেখানে আটকে থাকার পরে, তিনিও বহু কষ্টে ফিরেছিলেন। হায়দরাবাদে দিন মজুরি করতে যাওয়া পশ্চিম মেদিনীপুরের গড়বেতার সাহেব আলি খান, মোশারফ খানেরা সদ্য মাথাপিছু পাঁচ হাজার টাকারও বেশি বাস ভাড়া দিয়ে বাড়ি ফিরেছিলেন।

ছত্তিসগড়ের ভিলাইয়ে অনলাইন পোশাক কেনাবেচার সংস্থার ছয় তরুণ লকডাউনে আটকে পড়েছিলেন। ছত্তিসগঢ় পুলিশের সহযোগিতায় লরিতে তাঁদের ওড়িশা পর্যন্ত পাঠানো হয়। পরে বার কয়েক লরি বদলে তাঁরা ঝাড়গ্রামের লোধাশুলিতে পৌঁছান। তাঁদের অভিযোগ, রাতে আশ্রয় ও খাবারের জন্য ঝাড়গ্রাম থানার সহযোগিতা চাইতে গেলে, পুলিশ ‘দুর্ব্যবহার’ করে। শেষে স্থানীয়দের অর্থসাহায্যে গাড়ি ভাড়া করে পূর্ব বর্ধমান ও নদিয়ার বাড়িতে ফিরেছিলেন তাঁরা। দলে থাকা পূর্ব বর্ধমানের নাদনঘাটের অভিজিৎ দেবনাথ, নদিয়ার রানাঘাটের সুকান্ত বর্মনেরা বলেছিলেন, “ছত্তিসগঢ়, ওড়িশা ও ঝাড়খণ্ড রাজ্যের পুলিশ ও প্রশাসনের থেকে কিছুটা মানবিক সাহায্য পেয়েছি। অথচ, ঝাড়গ্রামে পৌঁছে জাতীয় সড়কের ধারে শুয়ে রাত কাটাতে হয়েছে। জঙ্গল মহলে আমাদের খুব তিক্ত অভিজ্ঞতা হল।”

এবার বালেশ্বরে ট্রেন দুর্ঘটনার পর পশ্চিমবঙ্গের অজস্র পরিযায়ী শ্রমিকের নাম ভেসে উঠছে নানাভাবে। সবাই যে প্রাণ হারিয়েছেন, তা অবশ্যই নয়। নদিয়ার বাসিন্দা সুনীল হালদারের ছেলে নবীন কেরলের পরিযায়ী শ্রমিক। ছুটি কাটিয়ে শুক্রবার করমণ্ডলে চেপে ফিরে যাচ্ছিলেন তিনি। কিন্তু ট্রেনে দুর্ঘটনার খবর আসার বেশ কয়েক ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও নবীনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেনি তাঁর পরিবার। দুর্ঘটনার খবরে বাড়িতে ভিড় জমাতে শুরু করেছিলেন পড়শি এবং আত্মীয়রাও। রাত ২টো ৪৫ মিনিট নাগাদ ফোন বেজে ওঠে সুনীলবাবুর। এক মুহূর্তও সময় নষ্ট না করে ‘হ্যালো’ বলতেই উল্টো দিক থেকে ভেসে আসে, নবীনের কণ্ঠস্বর। নবীন বলেন, ‘বেঁচে আছি বাবা’। দীর্ঘ উদ্বেগের পর স্বস্তির ফোনে কান্নায় ভেঙে পড়েন সুনীলবাবু।

শুক্রবার রাতেই দুর্ঘটনাস্থলে পৌছে গিয়েছিলেন সুকান্ত মজুমদার। শনিবার তাই সুকান্ত মজুমদার বলতে দ্বিধা করেননি, চাকরি নেই। কাজের সুযোগ নেই। যেটুকু আছে মজুরি যৎসামান্য। বাধ্য হয়ে এরাজ্যের ছেলেমেয়েরা শ্রমিকের ছোটখাটো কাজ করতে চলে যাচ্ছে ভিনরাজ্যে। এই এক একটা ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে সরল সত্যটা।

গত রাতে নদিয়ার হালদার পরিবারের উদ্বেগ কমলেও যোগাযোগ করা যায়নি, নদিয়ার করিমপুর থেকে কেরলে কাজ করতে যাওয়া চার পরিযায়ী শ্রমিকের সঙ্গে। উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠায় ফোন হাতে অপেক্ষায় তাঁদের পরিবারও।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *