শান্তিপুরের সেন বাড়ির মা দুর্গা ভাত খেতে চেয়েছিলেন

স্নেহাশীষ মুখার্জি, আমাদের ভারত, নদিয়া, ৩ অক্টোবর: ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে যখন পলাশীর যুদ্ধ হয় সেই সময় নবদ্বীপাধিপতি মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র নবাব সিরাজউদ্দৌলা’কে নানাভাবে সমর্থন করেছিলেন। পলাশীর যুদ্ধে নবাব হেরে গেলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রকে গৃহবন্দী করে। তাঁকে দুর্গাপুজোও করতে দেওয়া হয়নি।

সেই জন্য মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের যারা অনুগত প্রজা তারা ঠিক করলেন মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র যখন দুর্গা পূজা করতে পারেননি তখন আমরা করব। এদেরই মধ্যে একজন রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের অনুগত প্রজা ছিলেন এই সেন বাড়ির সদস্যরা। ১৭৫৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে সেন বাড়ির পূজা শুরু হয়। কৃষ্ণ কুমার সেন, রামকুমার সেন, মাধব চন্দ্র সেন, রাম গোপাল সেন, সন্তোষ কুমার সেন ও জয় নারায়ণ সেনের হাত ধরে এই পুজো এখনও পারিবারিক সূত্রে চলে আসছে।

এই পুজোর আরম্ভ হয়েছিল শান্তিপুর ব্রহ্মশ্মশনে। ম্যালেরিয়ার উপদ্রব হওয়ার কারণে সেন পরিবার সেই স্থান ত্যাগ করে শান্তিপুরের গঙ্গার পাড়ে মতিগঞ্জে চলে আসেন। সেখানে পুজো হতে থাকে। সেখানে আবার পরপর পাঁচ বছর গঙ্গার বন্যার কারণে দুর্গা পুজো করা হয়ে ওঠেনি। তাঁরা তখন মতিগঞ্জ থেকে বাইগাছিতে চলে আসেন। এরপর থেকে বাইরে আছিতে সেনপাড়ায় এই পুজো চলে আসছে। তার আর কোনো ছেদ পড়েনি।

১০০ বছর আগে শান্তিপুরের খ্যাতনামা পুরোহিত কৃষ্ণচন্দ্র বৈদিক পুরোহিত ছিলেন। তিনি পরলোকগত হলে তাঁর ছেলে অজুবাবু এই বাড়িতে পৌরহিত্য করেন। অজুবাবু ১৯৪৭ সালে গত হলে শচীন্দ্রমোহনের ছেলে গৌড়চন্দ্র ভট্টাচার্য ২০০৬ সাল পর্যন্ত এই বাড়িতে পুজো করেছেন। তারপরে কৃষ্ণেন্দু মুখোপাধ্যায় এই পূজার দায়িত্বে আছেন। তিনিও শান্তিপুরের একজন খ্যাতমান পুরোহিত।

সেন বাড়ির পুজোতে পশু বলি হয় না। পূজা মন্ডপের ছেলেদের প্যান্ট বা মেয়েদের সালোয়ার কামিজ পড়া কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। মেয়েদেরও সিল্কের শাড়ি পরা বাধ্যতামূলক। পাঁচ বছরের শিশু কন্যা–কেও সিল্কের শাড়ি পরতে হবে ঠাকুর দালানে ঢুকতে গেলে।

পরিবারের সদস্য জয় নারায়ণ সেন জানান, “আমার ঠাকুমা প্রভাবতী দেবীকে মাস্বপ্নাদেশ দিয়েছিলেন। তিনি আমার ঠাকুমাকে বলেছিলেন, “দু’বেলা লুচি খেতে ভালো লাগে? ভাত দিতে পারিস না।” তা করতে গেলে একটা ধারার পরিবর্তন হবে, সেজন্য আমরা মহাপুরুষের আশ্রয় নিলাম। তাঁকে বললাম মা’র স্বপ্নাদেশের কথা। তিনি বললেন আমাকে জিজ্ঞাসা করছিস কেন? মা’কে গিয়ে বল। এরপর আমরা গলবস্ত্র দিয়ে মা’কে জিজ্ঞাসা করলাম মা আমরা ধারার পরিবর্তন করব? অন্নপ্রসাদ দেব কি?” মা আমার ঠাকুমাকে জানালেন, “দে না।” সেই থেকেই আমাদের বাড়িতে পুষ্পান্ন চালু হলো। অনেকদিন পর আবার মায়ের দই খেতে ইচ্ছা হল। মা আবার ঠাকুমাকে স্বপ্নদেশ দিলেন। মা’র যখন যেটা খেতে ইচ্ছা হয় তিনি আমাদের স্বপ্নে আদেশ করেন, আমরা তাঁর আদেশ পালন করি।

ভোগ হিসাবে পুষ্পান্ন ছাড়াও খিচুড়ি, পায়েস, ফলপ্রসাদ, নানা রকম মশলা, সুক্ত, তরকারি, লুচি, নারকেল নাড়ু প্রভৃতি মা’র সামনে দেওয়া হয়। পুজোর কয়দিন আমরা খুব আনন্দ করি। পরিবারের সদস্যরা বাইরে যারা থাকেন তারা সবাই পুজোতে একত্রিত হই। মা’র কাছে প্রার্থনা করি সবাই যেন ভালো থাকে সবার যেন মঙ্গল হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *