একূল ওকূল হারিয়ে দুকূল, মাঝ দরিয়ায় ভাসছে মুকুল

রজত মুখার্জি

আমাদের ভারত, ১৫ জুন: বিনা ঝড়েই ঝরে গেল মুকুল। মুকুল বলতে আমি বিজেপির সদ্য প্রাক্তন হয়ে যাওয়া অন্যতম সর্বভারতীয় সহ সভাপতি সম্মাননীয় মুকুল রায়ের কথা বলছি। মুকুলবাবুর দাবি অনুযায়ী তিনি নাকি বিজেপিতে যথেষ্ট সম্মান পাননি। একটি সর্বভারতীয় দলের (বলা ভাল বিশ্বের সর্ববৃহৎ সংখ্যাগরিষ্ঠ দল) সর্বভারতীয় সহ সভাপতির দায়িত্ব তাঁর কাছে যথাযোগ্য সম্মানের মনে হল না, অথচ এ যাবৎ কাল আঞ্চলিক দল হিসেবে স্বীকৃতীপ্রাপ্ত তৃণমূল কংগ্রেসে তাঁর পুত্রবৎ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অধীনে কাজ করা নাকি অধিকতর সম্মানের। তা ওঁনার রাজনৈতিক জীবনের অভিমুখ উনি স্থির করবেন, এতে আমার বিশেষ কিছু বলার নেই। আমি মুকুলবাবুর সিদ্ধান্তকে সম্মানের সাথে স্বাগত জানাই।

বেশ কয়েক বছর ওঁনার নেতৃত্বে কাজ করার সুবাদে ব্যক্তিগত স্তরে একটা সুসম্পর্ক তৈরি হয়েছিল, তাই তথাগতবাবুর সুরে সুর মিলিয়ে আমি ওঁনাকে ট্রোজান হর্সও বলতে পারছি না আবার তথাগতবাবুর দাবিকে সম্পূর্ণ ভাবে নস্যাৎ করতেও মন চাইছে না। কারণ রাজনীতিতে কোনও সমীকরণই অসম্ভব নয়, বিশেষ করে ব্যক্তিটির নাম যখন মুকুল রায়।

যাইহোক, এই ঝরে যাওয়া মুকুল প্রমাণ করে দিলেন যে তাঁকে যদি কেউ নির্ভুল ভাবে চিনে থাকেন তাঁর নাম অবশ্যই দিলীপ ঘোষ। 

বছর ছয়েক পিছিয়ে যেতে হবে, বঙ্গ বিজেপি তখনও সেভাবে হালে পানি পায়নি। দেশ জুড়ে মানুষ মোদী ম্যানিয়ায় আচ্ছন্ন হলেও পশ্চিমবঙ্গে রীতিমত অস্তিত্বের সঙ্কটে ভুগছে বিজেপি। এ বঙ্গ থেকে মাত্র দুজন সাংসদ দিতে পেরেছি আমরা। এমতাবস্থায় ২০১৫ সালে বিজেপির রাজ্য সভাপতির আসন অলঙ্কৃত করলেন দিলীপ ঘোষ। এ হেন জনৈক অখ্যাত, অজ্ঞাতকুলশীল, রাজনীতিতে সম্পূর্ণ আনকোড়া মানুষকে কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ যখন রাজ্য বিজেপির সভাপতি মনোনীত করলেন, একশ্রেণির রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা গেল গেল রব তুলে  সংশয় প্রকাশ করেছিলেন বৈকি। দিকে দিকে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা নিয়ে হাজারো প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছিল। কিন্ত সহায় যখন থাকেন স্বয়ং ঈশ্বর তখন কোনও সংশয়ই দীর্ঘস্থায়ী হয় না। অতএব অসমসাহসী দিলীপ ঘোষ কালক্ষেপ করেননি তাদের যাবতীয় শঙ্কা হরণ করে নিতে। অমিতবিক্রম দিলীপবাবু সম্পূর্ণ অননুকরণীয় নিজস্ব কায়দায় জয় করে নিলেন রাজ্য ব্যাপী ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লক্ষ লক্ষ কর্মীর হৃদয়। 

২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে সদ্য দায়িত্বপ্রাপ্ত দিলীপবাবুর নেতৃত্বে দল লড়াই করে ভোট শতাংশে আগের সব রেকর্ড ভেঙ্গে জিতে নেয় তিনটি আসন। তিন জন বিধায়কের মধ্যে একজন দিলীপবাবু স্বয়ং যিনি খড়গপুর আসনে হেলায় পরাজিত করেন দীর্ঘ কয়েক দশকের হেভিওয়েট বিধায়ক বর্ষীয়ান নেতা জ্ঞানপাল সোহন সিং জী’কে। মানুষের আস্থা অর্জন করতে শুরু করলেন দিলীপ ঘোষ। কেন্দ্রে নরেন্দ্র মোদীর একটার পর একটা জনমুখী প্রকল্পের জেরে ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা আর রাজ্যে দিলীপ ঘোষের সামনের থেকে দেওয়া নেতৃত্বে ভর করে ক্রমাগত রাজ্য রাজনীতিতে বিজেপি তাদের সদর্প উপস্থিতির জানান দিতে শুরু করল। মানুষের মধ্যে পুঞ্জীভূত হল হার না মানা এক অদম্য জেদ। এদিকে শুরু হয়েছে তৃণমূলী সন্ত্রাসীদের ভয়ার্ত রক্তচক্ষুর চোখ রাঙানো আর দিকে দিকে রাজনৈতিক হিংসার বলি হতে শুরু হয়েছে নিষ্পাপ নিরীহ বিজেপি কর্মীরা। দিলীপদার সম্মুখ সারি থেকে নেতৃত্ব প্রদানের গুণে উজ্জীবিত কর্মীরা ততক্ষণে সমবেত কন্ঠে গাইতে শুরু করেছে:
এ লড়াই শেষের লড়াই, এ লড়াই বাঁচা মরার
এ লড়াই তোমার আমার, এ লড়াই সর্বহারার।।
এ লড়াই জিততে হবে, কঠিন বুকে শপথ নিলাম
এ লড়াই জিতবো বলে কত না প্রাণ বিলিয়ে দিলাম।।

২০১৭ সাল অক্টোবর মাস নাগাদ বঙ্গ বিজেপির ইতিহাসে সংযোজিত হল এক নতুন অনুচ্ছেদ, যখন জনৈক কেন্দ্রীয় নেতা রাজ্য নেতৃবৃন্দের কাছে অমিত শাহের  বার্তা নিয়ে আসলেন, মুকুল রায়কে রাজ্য দলের তরফ থেকে আন্তরিকতার সাথে বরণ করে নিতে হবে এবং মুকুলবাবু অসম্মানিত হন, এমন কোনও বিবৃতি দেওয়া চলবে না। অতি সহজেই অনুমেয় যে রাজ্য বিজেপির একাংশের তীব্র আপত্তি উপেক্ষা করেই দিল্লিতে মুকুল রায়কে কেন্দ্রীয় বিজেপির পক্ষ থেকে দলে বরণ করে নেওয়া হয়, যা নিঃসন্দেহে এটা একটা চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্ত ছিল।

বিজেপিতে যোগদান করা মাত্রই স্বভাবসুলভ বৈশিষ্ট্যে দলে প্রভাব বিস্তার করতে অতি সক্রিয় হয়ে ওঠেন মুকুল রায়। জনৈক কেন্দ্রীয় নেতার প্রশ্রয়ে মুকুল রায়ের সেই শুরু, লড়াকু নেতা রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষকে ক্ষমতাচ্যুত করে দেওয়ার প্রক্রিয়া। কৌশলী মুকুল রায় নতুন দলে ছলে বলে কৌশলে প্রভাব বাড়াতে সচেষ্ট হলেন বটে, কিন্ত অচিরেই সম্বিত ফেরে, যখন তিনি বুঝতে পারেন যে গণতান্ত্রিক দিক থেকে বিজেপি দলটি তৃণমূলের থেকে ভিন্ন। রাষ্ট্রবাদ ও হিন্দুত্ববাদের মন্ত্রে গড়ে ওঠা বিজেপিতে মতাদর্শের ভিত্তি অনেকটাই গভীর। তাই কর্মীরা নেতা বলতে সুদীর্ঘ ৩২ বছর সঙ্ঘের প্রচারকের দায়িত্বে থাকা দিলীপ ঘোষকেই মানেন, যার ত্যাগ তিতিক্ষা কৃচ্ছসাধন ইতিমধ্যেই সাধারণ কর্মীদের নজর কেড়েছে।

রাজ্য নেতাদের সেভাবে প্রভাবিত করতে না পেরে, মরিয়া মুকুল এবার অবলম্বন করলেন অন্য পন্থা। তাঁর চোখ গেল অবাঙালী কেন্দ্রীয় নেতাদের প্রতি। এমতাবস্থায় কৌশলী মুকুল রাজ্যে নিজের অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করে তুলতে, অবাঙালি কেন্দ্রীয় নেতাদের তুষ্ট করার জন্য ভীষণ ভাবে পরিক্রমা করা শুরু করলেন। দিল্লির নেতাদের ঘনিষ্ঠ বৃত্তে আবর্তিত হয়ে নিজের দখলে নিতে চাইলেন রাজ্য বিজেপির নিয়ন্ত্রণ এবং বলাই বাহুল্য, সেই লক্ষ্যে অনেকটাই সফল হলেন বিদগ্ধ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব মুকুল রায়।

এরপর এল সেমি ফাইনাল ম্যাচ অর্থাৎ ১০১৯ এর সেই মহারণ। লোকসভা নির্বাচন অর্থাৎ মোদী সরকারের অগ্নি পরীক্ষা। আরও বেশি শক্তি নিয়ে কেন্দ্রে ফিরল মোদী ২ সরকার। সারা দেশের সাথে সাযুয্য রেখেই, এক লপ্তে ১৮ টি সাংসদ জিতিয়ে এনে পশ্চিমবঙ্গেও  অভূতপূর্ব ফলাফল করল বিজেপি। নরেন্দ্র মোদীর বিপুল জনপ্রিয়তার পাশাপাশি দিলীপ ঘোষের সাহসী নেতৃত্ব ও মুকুল রায়ের মাষ্টার মাইন্ড ছিল এই জয়ের নেপথ্যে অন্যতম কারণ। 

লোকসভা নির্বাচনে এই বিপুল জয়ের অব্যবহিত পরে পরেই বঙ্গবাসী আরও একবার চাক্ষুষ করল দিলীপ মুকুল দ্বৈরথ। মুকুলবাবুর বিক্ষিপ্ত গতিবিধিতে মানুষের মনে দানা বাঁধল অন্তর্ঘাতের সন্দেহ। মুকুল রায় সম্পর্কে দলের অন্দরে ছড়িয়ে পড়ল নানান ধরনের বক্তব্য। পক্ষান্তরে সাফল্যের শিখরে আরোহণ করা রাজ্য সভাপতি দিলীপবাবুর দলের রাজনৈতিক জমি না ছাড়ার প্রবাহমান ধনুর্ভঙ্গ পণ। সাময়িক ভাবে জয়ী হলেন মুকুল। দায়িত্ব কাটছাঁট করে রাজ্য সভাপতিকে বেশ কিছুটা পেছনের সারিতে পাঠিয়ে দিয়ে মুকুল রায়কে চালকের আসনে বসালেন পশ্চিমবঙ্গের দায়িত্বপ্রাপ্ত কতিপয় কেন্দ্রীয় নেতা।

ঠিক এমন সময় রাজ্য রাজনীতিতে রীতিমত শোরগোল ফেলে বিজেপির মঞ্চে আবির্ভূত হলেন পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম শ্রেষ্ঠ জননেতা শুভেন্দু আধিকারী। পুণরায় শক্তিশালী হয়ে উঠলেন দিলীপ ঘোষ। দিলীপবাবু সহজেই শুভেন্দুবাবুকে আপন করে নিয়ে, পাল্টে দিতে চাইলেন রাজ্য বিজেপির পরিচিত সমীকরণ।

এগিয়ে এল ফাইনাল ম্যাচ অর্থাৎ ২০২১ এর বিধানসভা নির্বাচন। প্রার্থী নির্বাচন থেকে অন্যান্য যে কোনও ব্যাপারেই গুরুত্ব পেল না দিলীপবাবুর বক্তব্য। কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত বিশেষ কিছু নেতৃত্বের নির্দেশে ঘোষিত হল প্রার্থী তালিকা। তালিকা দেখা মাত্রই হতাশায় নিমজ্জিত হলেন অধিকাংশ নেতা কর্মী, যারা বছরের পর বছর বিভিন্ন নির্যাতনের শিকার হয়েও, অক্লান্ত পরিশ্রম করে এ বঙ্গে দাঁড় করিয়েছেন বিজেপি দলটিকে। এদিকে প্রার্থী তালিকা ঘোষিত হওয়া মাত্রই, দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ল অশান্তির আগুন, যার দায় কার্যত এসে পরে দিলীপ ঘোষের কাঁধে। এ হেন বিষম পরিস্থিতিতেও মানুষটি কিন্ত ময়দান ছেড়ে পালাননি, যা তাৎপর্যপূর্ণ। কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব হয়তো ততদিনে যা বোঝার বুঝে গিয়েছেন। বুঝে গিয়েছেন যে বিশাল বড় ক্ষতি হয়ে গেছে দলের, শুধুমাত্র মুকুল রায়কে অধিক মাত্রায় গুরুত্ব দিতে গিয়ে। বিলম্বিত বোধোদয়, তাই তো ড্যামেজ কন্ট্রোল করতে, হয়ত তাকে ভোট পরিচালনার বাইরে রেখে দূরের একটি আসনে প্রার্থী করে দেন। 

ভোট কেন্দ্রের রিগিং রুখে দিয়ে, গণনা কেন্দ্রে তলিয়ে গেল বিজেপি কর্মীদের দীর্ঘদিনের সযত্নে লালিত স্বপ্নের সম্ভার। এত এত নির্বাচন করে আসা অভিজ্ঞ মুকুল রায় গণনা কেন্দ্রের ছল চাতুরীর বিষয়টি জানতেন না, এটা হতে পারে না। আমি অন্তত এ তত্ত্ব মানতে নারাজ। আসল ব্যাপারটি হল সর্ষের (Source) মধ্যেই ভুত লুকিয়েছিল যা পরবর্তীতে মুকুলবাবুর দলত্যাগে প্রমাণিত হয়েছে।

সুতরাং বন্ধু, আজ না হোক কাল মুকুল ঝরতই, আদর্শগত ভাবে বিজেপি তাঁর জায়গা নয়। কথায় বলে বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে। কিন্ত এখন যেটা লাখ টাকার প্রশ্ন তা হল, মুকুলের উত্থান আর দিলীপ ঘোষকে বেলাইন করে দেওয়ার খেলায় কারা কারা সরাসরি যুক্ত ছিলেন, তা নিয়ে দলের অন্দরে অন্তর্তদন্ত হওয়া আশু প্রয়োজন। আদৌ হবে কি তদন্ত? উত্তরটা রয়ে গেল ভবিষ্যতের গর্ভে, যা সময় প্রমাণ করবে। 

তবে দিলীপ শুভেন্দুর যুগলবন্দীতে আশায় বুক বাঁধছেন বাংলার মানুষ, যা অত্যন্ত শুভ সঙ্কেত। মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীকে সম্মুখ সমরে পরাজিত করে বঙ্গ বিজেপির আপামর কার্যকর্তার হৃদয়ে পাকাপোক্ত ভাবে আসীন হয়েছেন শুভেন্দুবাবু, যা আশার সঞ্চার করে। আপাতত এই দুজনের দিকেই তাকিয়ে আছে সমগ্র পশ্চিমবঙ্গ। 

এ লড়াই সেই সে লড়াই, সকল লড়াই ঘুচিয়ে দেবার
এ লড়াই বহু দিনের বাকির হিসেব চুকিয়ে দেবার।
এ লড়াই আঁধার চিরে আলোর তোরণ পরশ করার
এ লড়াই তোমার আমার এ লড়াই সর্বহারার।
(তথ্য এবং মতামত প্রতিবেদকের নিজস্ব, এজন্য আমাদের ভারত দায়ি নয়।)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *