দেশভাগের বেদনার স্মৃতিকে এবার মণ্ডপ সজ্জায় নতুন করে উসকে দিয়েছে নাকতলা উদয়ন সংঘ, কড়া প্রতিক্রিয়া মোহিত রায়ের

অশোক সেনগুপ্ত
আমাদের ভারত, ১৩ অক্টোবর: “ছায়াঢাকা ডোবার ধারে হিজল গাছে ঘুমভাঙা পাখিরা চেনা গলায় কিচিরমিচির করে উঠল। জানালা দিয়ে বাইরে একবার তাকাল সেই ছোট ছেলে, দেখল তার কাটা ঘুড়িটা এখনো গাছের মগডালে লটকে আছে, হাওয়ায় ঠোক্কর খাচ্ছে, তবুও কিছুতেই ছিঁড়ে পড়ছে না।“

আজও গায়ে কাঁটা দেয় অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তর ‘উদ্বাস্তু’-র কথাগুলো। প্রায় আট দশক আগে কোন পরিস্থিতিতে পূর্বপুরুষদের ভিটে ছেড়ে অনিশ্চিতের উদ্দেশে পাড়ি দিয়েছিল পূর্ববঙ্গের লক্ষ লক্ষ হিন্দু, আজ তা নিছকই ইতিহাস। বিষয়টি নিয়ে যাঁরা চর্চা করেন, তাঁরা জানেন এপার বাংলার হিন্দুদের একটা বড় অংশ এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ উদাসীন। ওই অংশে আছেন সেই ‘উদ্বাস্তু’দের উত্তরসূরীদের অনেকেই।

সাংবাদিক সুলগ্না সিংহের কথায়, “দক্ষিণ কলকাতার অতি পরিচিত, অতি জনপ্রিয় পুজোর এবারের থিম ‘চল্ চিত্র’। আরও খোলসা করে বললে, মুলুক বদলে ভিনদেশে পাড়ি দেওয়া মানুষদের চলমান ছবিই এবার নাকতলায় ফুটিয়ে তুলেছেন শিল্পী প্রদীপ দাস। তবে শুধু তো বর্তমান আফগানিস্তানের পরিস্থিতি নয়, যুগযুগান্ত ধরে এ যন্ত্রণার সাক্ষী বিশ্ব। ইতিহাসের পাতায় এমন বহু উদাহরণ রয়েছে। সাতচল্লিশের দেশভাগ হোক কিংবা একাত্তরের বিধ্বস্ত বাংলাদেশ- সর্বত্রই ভিটে-মাটি ছাড়ার হাহাকার। তালিবানি সন্ত্রাসের আমলে নতুন করে যে যন্ত্রণার কাহিনি নতুন করে উসকে গিয়েছে।“

ফেসবুকে চন্দন রুদ্র লিখেছেন, “দেশভাগের যন্ত্রণা আজও বয়ে চলেছে এ দেশের মানুষ। ব্রিটিশদের হাত থেকে ভারতবর্ষ মুক্তি পেলেও আজও উদ্বাস্তু সমস্যা থেকে মুক্তি পায়নি দেশ।

বাবা-ঠাকুরদার ভিটে ছেড়ে দেশভাগের ক্ষত বুকে নিয়ে তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের বরিশাল, ফরিদপুর, ঢাকা, সিলট, ময়মনসিংহ, নোয়াখালির মতো জেলাগুলি থেকে এ দেশে এসে আস্তানা গেড়েছিলেন অসংখ্য ছিন্নমূল মানুষ। পুকুর, দুর্গামণ্ডপ, চাষের জমি, বাড়ির উঠোনের ছোট্ট বাগানে লতনো লাউডগা, মাচায় বেড়ে ওঠা পুঁইশাক কিংবা প্রিয় বিড়াল ছানাকে রেখে ট্রেনের কামরায় উঠে পড়া সম্পন্ন পরিবারটিও এ দেশে এসে হয়েছিলেন শরণার্থী। আবার সিংহভাগই জায়গা নিয়েছিলেন এই পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে। দেশভাগের সেই কষ্টের স্মৃতিকেই এ বার তাদের মণ্ডপ সজ্জায় নতুন করে উসকে দিয়েছে দক্ষিণ কলকাতার নাকতলা উদয়ন সংঘ।

বিষয়টিতে অবশ্য কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন বিজেপি-র রাজ্য কমিটির সদস্য তথা দলের উদ্বাস্তু শাখার আহ্বায়ক মোহিত রায়। এই প্রতিবেদককে তিনি জানিয়েছেন, “উদ্বাস্তুদের নিয়ে এই শৈল্পিক রসিকতা আর কতদিন চলবে? এবার (২০২১) দুর্গা পূজায় দক্ষিণ কলকাতার একটি ক্লাবের থিম দেশভাগের যন্ত্রণা। ফেসবুকে এই পূজা মণ্ডপের ছবি অনেকে দিয়েছেন, অন্তত একজন থিমের বিষয়টি কিছুটা বর্ণনা করেছেন। দেশভাগের যন্ত্রণা বোঝাতে রাখা রয়েছে একটি ট্রেনের কামরা, এই ট্রেনে করেই উদ্বাস্তু পরিবাররা চলে এসেছিল। আর রাখা রয়েছে ফেলে আসা গৃহস্থালীর অনেক জিনিষপত্র, পোষ্য ইত্যাদি। বেশ বেদনা জাগানোর শুড়শুড়িতে ভরপুর। যেসব জায়গা থেকে উদ্বাস্তুরা এসেছিলেন, তার স্মৃতি জাগাতে রয়েছে পূর্ববঙ্গের (বাংলাদেশের) অনেক স্থানের নামের কিলোমিটার ফলক। এই দেশভাগের যন্ত্রণার স্মৃতিচারণ আসলে উদ্বাস্তুদের নিয়ে গত সাত দশক ধরে চলে আসা বাম-সেকুলার শৈল্পিক রসিকতা মাত্র।”

মোহিতবাবু বলেন, “যদি ন্যুনতম উদ্বাস্তু দরদ থাকত তবে পূজা প্রাঙ্গনে যে ট্রেনের কামরাটি রাখা আছে তার সারা গায়ে থাকত রক্তের দাগ। কামরার দরজায় থাকত ধুতি পরিহিত পুরুষের মৃতদেহ, থাকত লাল পাড় ছেঁড়া শাড়ি আর ভাঙ্গা শাঁখার স্তুপ। ১৯৫০, ভৈরব ব্রিজের উপর ছিল এই ত্রিপুরাগামী ট্রেনটি, তাঁর একটি কামরা এখন আপনার সামনে। পূর্ব পাকিস্তানে মুসলমানরা চালাচ্ছে হিন্দু হত্যা, লুণ্ঠন, নারী ধর্ষণ, পালাচ্ছে হিন্দুরা। বিশাল মেঘনা নদীর উপর ভৈরব ব্রিজের উপর থামানো হবে একের পর এক ট্রেন, সেখানে মুসলমানরা নির্মমভাবে হত্যা করবে হিন্দুদের, শ্লীলতাহানি করবে হিন্দু নারীদের। পূজা প্রাঙ্গনের ঐ ট্রেনের কামরাটি সেসব কথা বলে? না, বলে না।


ছবি: ফাইল ছবি।

উদ্বাস্তুদের কষ্টের অভিজ্ঞতা নিয়ে রসিকতার প্রধান শর্ত হচ্ছে যে কেন এই মানুষগুলো উদ্বাস্তু হল সে কথা বলা যাবে না, ঘুণাক্ষরে, সামান্য কোনও ইঙ্গিতেও বলা যাবে না এঁরা এসেছে মুসলামানদের নির্মম অত্যাচারে, নিজেদের ধর্ম, সংস্কৃতি বাঁচাতে। ইসলামী মৌলবাদকে রক্ষা করতে এটি বামপন্থীদের অনেক পুরানো লাইন সেজন্য উদ্বাস্তুদের নিয়ে এরকম রসিকতা করে গেছেন হেমাঙ্গ বিশ্বাস থেকে ঋত্বিক ঘটক। “মেঘে ঢাকা তারা” চলচ্চিত্রে জবজবে সেন্টিমেন্টে নায়িকা যখন বলে ‘দাদা আমি বাঁচতে চাই’ তখন দাদার বলা উচিত ছিল তোমাকে হত্যা করেছে কলোনি জীবনের দারিদ্র্য নয় ইসলামী নিপীড়নে পলায়নের অভিশাপ।

সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বিষয় হল যে উদ্বাস্তু নিয়ে এমন একটা ছবি তুলে ধরা হয় যে এ এক অনেক অতীতের ঘটনা। যে কথা উচ্চস্বরে বলা প্রয়োজন যে উদ্বাস্তু ব্যাপারটি কোনও অতীতের ঘটনা নয় তা একেবারে ঘটমান বর্তমান। পূর্ববঙ্গ, পূর্ব পাকিস্তান বা বাংলাদেশ থেকে গত সত্তর বছরে একদিনের জন্যও হিন্দু নিপীড়ন থেমে থাকেনি। গত সত্তর বছর ধরে পূর্ব পাকিস্তান ও পরে বাংলাদেশ থেকে হিন্দুরা চলে আসতে বাধ্য হচ্ছে, এই লেখাটির সময়ও কোনও হিন্দু পরিবার বাংলাদেশ থেকে চলে আসবার পরিকল্পনা করছেন।

স্বাধীনতাকালীন পূর্ববঙ্গের ৩০ শতাংশ হিন্দু আজ ৮% এসে দাঁড়িয়েছে। শান্তির সময়ে পৃথিবীর ইতিহাসে এত বড় জাতি বিতাড়ন হয়নি। ১৯৪৬-এর নোয়াখালি হিন্দু গণহত্যা থেকে শুরু করে একের পর এক হিন্দু গণহত্যা ও হিন্দু গণনিপীড়ন পূর্ব পাকিস্তান ও পরে বাংলাদেশে ঘটে চলেছে।আপনারা সেকুলার থাকুন, পশ্চিমবঙ্গকে পশ্চিম বাংলাদেশ বানান, শিল্প সংস্কৃতি করুন, দোহাই উদ্বাস্তুদের নিয়ে রসিকতা করবেন না।“

শিল্পী প্রদীপ দাসের কথায়, ”সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হয়তো ওপর ওপর সবটা সয়ে যায়। কিন্তু নিজের দেশত্যাগের ঘা অন্তরের অন্তঃস্থলে যেন চিরকাল দগদগে হয়ে থাকে।” এবার পুজোয় তাদের কথাই মনে করাবেন শিল্পী। তাঁর সৃষ্টিশীল এই ভাবনা পূর্ণতা পাবে প্রবাদপ্রতিম শিল্পী ভবতোষ সুতারের তৈরি প্রতিমাতে। পরিযায়ীদের গুটিয়ে যাওয়া মনের কথা শুনবেন দেবী দুর্গা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *