‘নীরবিন্দু’— নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী

অশোক সেনগুপ্ত
আমাদের ভারত, কলকাতা, ২৯ এপ্রিল: “তার কয়েক দিন বাদেই ঘটল এক তাজ্জব ঘটনা। হস্টেলের পাশেই নদী। হঠাৎ একদিন মাঝরাত্তিরে কেউ হেড মাস্টারমশাইয়ের ঘরে ঢুকে বিছানা থেকে তাঁকে তুলে নিয়ে সেই নদীর মধ্যে ছুড়ে ফেলে দেয়। তো প্রাণে তিনি মারা যাননি, ঘাটের কাছেই জলের মধ্যে পড়েছিলেন, হাবুডুবু খেতে-খেতেই তিনি পাড়ে এসে ওঠেন। পরের দিন গোটা গঞ্জ তোলপাড়! কী, না হেড মাস্টারমশাইকে জলে ডুবিয়ে মারার চেষ্টা হয়েছিল। কাজটা কার, স্কুল-কর্তৃপক্ষকে তাও জানিয়ে দিলেন তিনি। আততায়ীকে তিনি চিনতে পেরেছিলেন। সে আর কেউ নয়, তাঁরই সেরা ছাত্র জিতেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী।”

পরবর্তীকালে ইংরেজি সাহিত্যের বিখ্যাত অধ্যাপক এই জিতেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর পুত্র নীরেন্দ্রনাথ এ রকম সহজ সরল ভাষাতেই লিখেছেন আত্মজীবনী ‘নিরবিন্দু’। বাংলা ভাষায় এত আকর্ষণীয় আত্মকথন সত্যিই বুঝি বিরল। বইয়ের প্রস্তাবনায় লেখা— “এ-বই শুধু আত্মজীবনী নয়। একালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এক কবির আপনকথা অবশ্যই। তার সঙ্গে সঙ্গে সমকালীন সমাজের এক চলমান ছবি। কবি এখানে ফুটিয়ে তুলেছেন তাঁর ফেলে আসা পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের এক নিপুণ আলোকচিত্র। দক্ষ শিল্পীর মুন্সিয়ানায় বুনেছেন জীবনস্মৃতির কথকতা, যা আমাদের হাতছানি দেয়; বড়ো উতলা করে তোলে। লেখক দীর্ঘ জীবনে দেখা নানা ঘটনা বলে চলেছেন, যা সত্যি হলেও গল্পের মতো। সেই পুরনো কলকাতা, তার মানুষজন, তাদের নানা কর্মকাণ্ড আমাদের মোহিত করে রাখে। আমরা আক্রান্ত হই এক পরম রমণীয় নস্ট্যালজিয়ায়। যে জীবনবিন্যাসকে আমরা হারিয়ে ফেলেছি, নীরবিন্দু তারই এক হারানো অ্যালবাম। লেখক সেই অ্যালবামের ধূসর পৃষ্ঠাগুলো উল্টে চলেছেন আমাদের সামনে। দেখিয়ে দিচ্ছেন সেই দিনগুলোকে, যাদের আর কোনওদিন ফিরে পাওয়া যাবে না।”

কেবল দাবি নয়, আক্ষরিক অর্থেই তিন সত্যি এই প্রস্তাবনা। পড়াশোনার আদিপর্বের কথা জানাতে গিয়ে লিখেছেন, “একেবারে অজ-পাড়াগাঁ বলতে যা বোঝায়, আমাদের চান্দ্রা গ্রাম তো সত্যি তা-ই। সেখানে একটা মাইনর ইস্কুল পর্যন্ত ছিল না। থাকবার মধ্যে ছিল একটা পাঠশালা। সেটা আবার বেশির ভাগ সময়েই বন্ধ থাকত। খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। কেননা, যে পণ্ডিতমশাইটি সেখানে তালের পাতায় অ-আ-ক-খ লিখতে আর শুভঙ্করের আর্যা মুখস্থ করতে শেখাতেন, তিনি ছিলেন প্রতিবন্ধী। শৈশবেই সম্ভবত পোলিওতে আক্রান্ত হয়েছিলেন, তাঁর পা দুটি তার ফলে শুকিয়ে যায়। হামাগুড়ি দিয়ে তিনি পাঠশালায় আসতেন। কণ্ঠস্বরও ছিল বিকৃত। সরু আর মোটা দু’রকম গলায় তিনি কথা বলতেন, কিন্তু কী যে বলতেন, সবসময়ে তা ঠিক বোঝাও যেত না। তো তাঁর কাছে যেটুকু শেখার, সেটুকু না হয় শিখে নেওয়া গেল। তারপরে কী হবে? পাঠশালার পোড়োরা সেখান থেকে কোথায় যাবে?

সকলকে নিয়ে এই প্রশ্ন অবশ্য উঠত না। সত্যি বলতে কী, অধিকাংশ পোড়োর ছাত্রজীবন এই পাঠশালাতেই খতম হয়ে যেত। যাদের হত না, তাদের যেতে হত কাইচালে কি আলগিতে। এ দুটি গ্রামের প্রথমটি আমাদের গ্রাম থেকে দু’মাইল উত্তরে, আর দ্বিতীয়টি দু’মাইল দক্ষিণে। সেখানে মাইনর ইস্কুল আছে।”

আত্মকথার প্রথম বেশ কয়েকটা পাতায় ফরিদপুরের চান্দ্রা গ্রামের কথা। কথা তো নয়, লেখার মধ্যে দিয়ে ছবি— কেমন ছিল জীবনযাত্রার মান? “গ্রীষ্মকালে ভদ্দরলোকেরা তা হলে করবেটা কী? কী আর করবে, ইঁদারাও যখন খোঁড়া যাচ্ছে না, টিউবওয়েল বসাবার পয়সাও যখন নেই, তখন শুকিয়ে-যাওয়া ওই পুকুরের কাদাজলই তারা খাবে। কিন্তু না, তারা তো আর গরিব-গুর্বো ভাগচাষি নয়, স্বাস্থ্যরক্ষার প্রাথমিক নিয়মকানুনগুলোও তারা ভালই জানে, তাই সরাসরি ওই কাদাজল তারা খাবে না, পুকুর থেকে তুলবার পরে ওটাকে তারা একফালি ন্যাকড়া দিয়ে ছেঁকে নেবে, চাই কী ফুটিয়েও নিতে পারে।”

ঠাকুর্দার গল্প করতে গিয়ে জানিয়েছেন, দশ টাকা মাসমাইনেয় সেকালের এক নামজাদা প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের কনিষ্ঠ কর্মচারী হয়ে কাজে ঢুকেছিলেন। “পরে তাঁর মাইনে হয় তিরিশ টাকা। ….হয়তো কর্মনিষ্ঠাও ছিল আর-পাঁচজনের চেয়ে অনেক, বেশি। তা যদি না-ই থাকবে, তা হলে বাল্যবয়সে সেখানে যিনি সর্বকনিষ্ঠ কর্মী হয়ে ঢুকেছিলেন, ক্রমে-ক্রমে একদিন সেই প্রতিষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্ব নিশ্চয়ই তাঁরই হাতে তুলে দেওয়া হত না।”

এ সব জানিয়ে নীরেন্দ্রনাথ লিখছেন, “খুব কম? মনে রাখতে হবে, টাকাটা তখনও টাকাই ছিল, পয়সা হয়ে যায়নি। ১৯৪০ সালেও তিরিশ টাকা মাস-মাইনেয় অনেককে আমরা সংসার চালাতে দেখেছি। আর এ হল গিয়ে প্রথম মহাযুদ্ধের সময়কার কথা, তিরিশ টাকার ক্রয়-ক্ষমতা তখন ছিল এখনকার অন্তত তিন-চার হাজার টাকার সমান। তা সেই টাকাতেও ঠাকুর্দা যে তখন সংসার চালাতে হিমসিম খেয়ে যেতেন, তার কারণ আর কিছু নয়, তাঁর সংসারটাই ইতিমধ্যে অনেক বড় হয়ে গিয়েছিল।”

কথার সুতো ছাড়তে ছাড়তে কখনও এগিয়েছেন। কখনও পিছিয়েছেন। লাহোর জেলে যতীন দাসের অনশনে মৃত্যুবরণের পরবর্তী সময়ের বিশদ ছবি যেমন নিপুন ফুটিয়ে তুলেছেন, তেমনই বর্ষাকালে বড়কাকার বিয়ে, বাবার ১৯১৮ সালে এমএ পরীক্ষায় পাশ করার আগেই কলেজে পড়াবার কাজ পাওয়া, পরিবারের বিভিন্ন সদস্যের গল্প পড়তে পড়তে প্রায় ১০০ বছর আগের এক শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত পরিবারের অন্দরে ঢুকে পড়া যায়।

পুজোর সময় মধুপুর, গিরিডি, ঝাঁঝাঁ, দেওঘর, শিমূলতলার মতো রাজেন্দ্রানীর বেশে সেজে ওঠা জায়গাগুলোর বর্ননা শুনতে শুনতে যেন পাঠকের মানসভ্রমণ হয়ে যায় ঘরে বসে। ফেরিওয়ালা, কলকাতার ট্রাম, ট্যাক্সি, ঘোড়ার গাড়ি, ছ্যাকড়া গাড়ি, বড়লোকদের নানা রকম মোটর গাড়ি প্রভৃতির বিশদ গল্প করতে করতে লিখেছেন, “কখনও কখনও চার-চাকাওয়ালা একটা বাক্সগাড়ির মতন জিনিস নিয়ে যে লোকটা আমাদের গলিতে এসে ঢুকত, কোনো একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে গিয়ে খানিকক্ষণ ধরে একটা ঘণ্টা বাজিয়ে সে লোক জোগাড় করত, তারপর ছড়ার মতন করে বলতে শুরু করত : “দেখো দেখো দেখো দেখো/দিল্লিকা মিনার দেখো/আগ্রাকা তাজমহল দেখো/কালীঘাটকা মন্দির দেখো/শের দেখো ভাল দেখো/হাঁথি দেখো বান্দল্ দেখো/অওর হল্যানজিকো দেখো/দেখো দেখো দেখো দেখো।” বাক্সের গায়ে গোল-গোল গর্ত, তাতে লাল নীল কাঁচ বসানো। তাতে চোখ রাখলে ভিতরের ছবি দেখা যায়। লোকটা যেমন-যেমন একটা হাতল ঘোরায়, তেমন-তেমন পালটে যায় ছবি। সে-সব দেখতে পয়সা লাগে একটা মাত্র।

বাক্সের কাচে আমিও চোখ রেখেছিলুম একদিন। কুতুব মিনার, তাজমহল ইত্যাদির সঙ্গে বিবস্ত্রা কিছু নারীর ছবিও দেখতে পাই। অমন ছবিও যে দেখা যাবে, তা অবশ্য ছড়ায় বলা হয়নি। অস্যার্থ এই যে, পণ্যের প্রকৃত পরিচয় গোপন করার চেষ্টা সেকালেও অল্পবিস্তর চলত। দোষ শুধু একালের নয়।”

সাংবাদিকতায় যেখানে হাতেখড়ি, সেই ‘প্রত্যহ’ থেকে ‘মাতৃভূমি’— অভিজ্ঞতার নানা গল্প শুনিয়ে নীরেন্দ্রনাথের এই বইয়ের ৩১ নম্বর অধ্যায়ে প্রবেশ করলাম চল্লিশের দশকে। ব্যাঙ্ক ফেলে উদ্ভুত পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির বিশদ জানাতে গিয়ে তিনি এটাও লিখতে ভোলেননি যে কবি অজিত দত্ত, কথাসাহিত্যিক নরেন্দ্রনাথ মিত্র ও হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়ও কর্মহীন হয়ে পড়েন এই ব্যাঙ্ক ফেল-এর জেরে। নোয়াখালির দাঙ্গার বর্ণনা পাঠক যখন পুরোপুরি আত্মস্থ করে উঠতে পারেননি, তখনই পাঠক সতর্ক হয়ে ওঠেন এক যুবতীকে নিয়ে নীরেন্দ্রনাথের চর্চায়— “আমার ভাবনা শুধু চাকরি নিয়ে নয়, বছরের গোড়ায় যিনি ‘শ্রীহর্ষ’ পত্রিকায় যোগ দিয়েছেন, সেই সুষমা দেবীকে নিয়েও।

কীর্তিবতী এই যুবতী এবং কলকাতার দাঙ্গা নিয়ে অসংখ্য বর্ণনার পর আত্মকথার ৩৮ নম্বর অধ্যায়ে আমরা জানলাম নীরেন-সুষমার বিয়ের কথা। ৪২ নম্বর অধ্যায়ে ‘স্বরাজ’ পত্রিকায় নীরেন্দ্রনাথের কাজে যোগ দেওয়ার নানা কথার মধ্যে আকর্ষণীয় লাগল তিনি কবি জীবনানন্দ দাসকে সহকর্মী হিসাবে কীভাবে পেলেন, সেই আখ্যান। এর পরের চাকরি ‘দৈনিক ভারত’-এ। ৪৯, ৫০ নম্বর অধ্যায়ে স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস, স্বায়ত্বশাসন, জিন্নার পাকিস্তানের দাবি, দেশভাগের নানা কথা। ৫১, ৫২-তে দেশভাগ পরবর্তী ছিন্নমূল হিন্দুদের দূরবস্থা। ৫৪ নম্বর অধ্যায়ে বাবার চলে যাওয়ার দৃশ্য, ৫৬-তে গান্ধীজীর হত্যাকাণ্ড। ৫৮-৬০, মানে শেষ তিনটি অধ্যায়ে ‘সত্যযুগ’-এ নিজের অভিজ্ঞতার নানা গল্প উপহার দিয়েছেন পাঠকদের।

বইয়ের ফ্ল্যাপের ইনার (ব্যাক) জ্যাকেটে নীরেন্দ্রনাথের সংক্ষিপ্ত পরিচয়—
শিক্ষা : গ্রামে ও কলকাতায়।
পেশা : সাংবাদিকতা। কবি হিসাবে পরিচিত কলেজ-জীবন থেকেই। কবিতার বই ‘উলঙ্গ রাজা’র জন্য আকাদমি পুরস্কারে (১৯৭৪) সম্মানিত। কবিতা বিষয়ক গ্রন্থও লিখেছেন বেশ কয়েকটি। তার মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য ‘কবিতার ক্লাস’, ‘কবিতার কী ও কেন’ ও ‘কবিতার দিকে’। বড়দের জন্য রচিত প্রথম উপন্যাস ‘পিতৃপুরুষ’। ছোটদের জন্য কয়েকটি ছড়ার বই। এছাড়াও লিখেছেন বেশ কয়েকটি রহস্য-উপন্যাস । সার্বিক কবিকৃতির জন্য আনন্দ পুরস্কার- এ সম্মানিত হন ১৯৭৬ সালে।
অন্যান্য পুরস্কার : তারাশঙ্কর, শিরোমণি, বিদ্যাসাগর-স্মারক, ভারতীয় ভাষা পরিষদের স্বর্ণাঞ্চল এছাড়া কলকাতা, বর্ধমান ও কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পেয়েছেন সাম্মানিক ডি.লিট। ১৯৯০ সালে লিয়েজে বিশ্বকবি-সম্মেলনে একমাত্র ভারতীয় প্রতিনিধি।
শখ : ব্রিজ খেলা ও ভ্রমণ ।

বইয়ের পৃষ্ঠা ৫১০। প্রতি পৃষ্ঠায় আনু শব্দসংখ্যা ৪১৫। মূল্য ৫০০/-। প্রকাশক দে’জ পাবলিশিং।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *