(খড়দার ভূমিপুত্র কৃষিবিজ্ঞানী ড. কল্যাণ চক্রবর্তী খড়দায় একাদিক্রমে ৩৫ বছর অবস্থান করেছেন। তার সঙ্গে খড়দার মানুষের দীর্ঘ সাংস্কৃতিক-সাহিত্যিক-সামাজিক যোগসূত্র আজও বিনষ্ট হয়নি। তিনি আপন-চারণায় সমকালীন সময়ের অভিজ্ঞতা শেয়ার করছেন, তার মধ্যে সেই সময়ের স্থানীয় ইতিহাস কিছুটা ফুটে উঠবে এই আশায় তা পরিবেশিত হল। প্রস্তুত প্রতিবেদনটি তার ৯ম পর্ব)
ড. কল্যাণ চক্রবর্তী
আমাদের ভারত, ২৭ ডিসেম্বর: ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে বাৎসরিক পরীক্ষা শেষ হয়ে যায়। তারপর একটা লম্বা সময় পাই হিমেল-আনন্দ উপভোগ করার। চারিদিকে ‘মাটির ঘটি কাঠের গাই’। খেজুর গাছ কাটা হয়েছে চারিদিকে; গাছ-হাঁড়ি যেন গাই-বাছুর। বরিশালে ভিটেমাটি হারানো পাড়াতুতো এক দাদু বলতেন,
‘ঝাকড় মাকড় মাথা/তার কোবা কোবা গা/ট্যাঙ্গে দড়ি গলা কাডি/গিল্লা গিল্লা খা।” –তিনি রসের কথা বলছেন। এগুলো সব wild datepalm, _Phoenix sylvestris_। শুধু রহড়া খড়দা নয়, পশ্চিমবঙ্গ- বাংলাদেশের মাটিতে যত্রতত্র জন্মায় এই গাছ। এরই রস অতি উপাদেয় পানীয়, কেউ কেউ বলেন ‘নীরা’। যে লৌকিক সমাজে খেজুর, তাল, নারকেল গাছ কাটা, ঝরা ও গুড় তৈরির জ্ঞানভাণ্ডার ছিল, তাদের বলা হত ‘সিউলি’ বা ‘গাছি’। আমার সঙ্গে পরিচয় ছিল রহড়ার শরৎ বসু কলোনির নিমাই বর্মন কাকুর, রহড়া সুদ্ধ সবাই তাকে ‘নিমাই দা’ বলেই ডাকতেন।
সাতের দশক পর্যন্ত পুরো রহড়া জুড়েই শীতকালে খেজুর গাছে হাঁড়ি পড়তো। বন্দীপুর, পাতুলিয়া, দোপেড়িয়া, রুইয়া, বিলকান্দায় হাঁড়ি বাঁধা পড়েছে তারপরও কয়েক দশক। এখন এই পেশায় লোকজন তেমন নেই, গাছও কাটা পড়েছে হাজার হাজার। পুকুরপাড়ে এক ঠ্যাঙ্গা খেজুর গাছগুলো কোথায় গেল? আলের উপর অযত্নে বেড়ে ওঠা সব খেজুর গাছ? সেই চিরল চিরল পাতা, সেই সোনার মতো গা-ফল?
গাছের আগায় হইলো সোনা/পাকলে আনে মজলে খা না! মন্দির পাড়ায় থাকতেন এক বৃদ্ধ হোমিওপ্যাথি ডাক্তার, শ্রী উমাপদ চট্টোপাধ্যায়। স্বামী অভেদানন্দ চ্যারিটেবল ইউনিটে তিনি বসতেন। তাঁর বাড়ির কাছে খেজুর গাছে শীতকালে হাঁড়ি পড়তো। একদিন শীতের সকালে তাঁর বাড়ি গেছি। সেদিন তিনি শোনালেন রসের নান্দনিকতা।
“কাঁটা ভরা অঙ্গ হেরি সুদীর্ঘ আকার/প্রাণ আছে শিরে তার কেশের সম্ভার/জিহ্বার অগ্রেতে মধু বিন্দু বিন্দু ঝরে/জুড়ায় রসনা খানি পান করি নরে।” এই বলে তিনি এক গ্লাস টাটকা খেজুরের রস খেতে দিলেন। ওই রসের মেজাজ আজও ভুলিনি। সিউলি নিমাই দা ছিলেন রসিক মানুষ। যাদের বাড়িতে খেজুর গাছ থাকতো, তিনি কার্তিক মাসে বাড়ি বাড়ি ঘুরতেন। আমাদের বাড়িওয়ালাকেও সুর করে বলতেন, “ওরে বেটা কালাচাঁদ/দুধ খাবি তো বাছুর বাঁধ।” আমি বলতাম, ব্যাপারটা কী হল! হেসে বলতেন, কাঠের গাই/বিকালে পানায়/সকালে দোয়াই। এরকম ‘ছেদে মেদে’ গাছ দুইতেন ভদ্রেশ্বর জোয়ার্দার বাবুও। তাঁর বয়স হয়ে গিয়েছিল তখন, ছেলেরা সেই পেশায় যাননি।
গাছি ভাইয়ের সঙ্গে চুক্তি হত মালিকের। রসের অর্ধেকটা তার, বাকিটা গৃহস্থের। গাছ কাটা, ঝোরা, হাঁড়ি বসানো, রস নামানো — পুরো কাজটাই গাছির। তার বাড়িতে শীতকাল জুড়ে রস জ্বালের দো-আখা জ্বলতো। বড় কড়াইতে রস জ্বাল হত সকাল সকাল। বিকেলে হত চিটেগুড়। খেজুর গাছের শুকনো পাতা অবিরামভাবে আখায় ঠেলে দেন গাছি-বউ। ধীরে ধীরে টলটলে রসে রঙ ধরে, তখন কী মিষ্টি গন্ধ! আমি তন্ময় হয়ে দেখতাম নিমাই দার বাড়ি। গুড়ে পাক ধরলে পর মাটিতে ছোটো গর্তে কাপড় ঢাকা দিয়ে নারকেল মালার হাতা দিয়ে গরম রস তুলে চটপট ঢালা হতো। শীতের ঠান্ডায় রস দ্রুত জমে জমে পাটালি হয়। তা কাপড় থেকে ছাড়িয়ে দ্রুত তুলে নিলে আবারও গর্তে ঘন রস পড়ে। সোনার মতো সে গুড়ের রঙ, আজ ওই কোয়ালিটি কোথায়! যত গ্রামের দিকে যাই, ততই দেখি। খড়দার গ্রাম এলাকার স্থানে স্থানে অপরূপ শিল্প গড়ে উঠতো তখন। আজ সেসব কোথায় গেল? এখন পাঁচশো টাকা ফেললেও এক কিলো খাঁটি পাটালি পাওয়া যাবে না। রাইমোহনবাবুর ছোট্ট ডোবার পাড় ঘেঁষে ধনুকের মতো বেঁকে উঠে গেছে এক পুরুষ খেজুর। খেজুরে স্ত্রী আর পুরুষ গাছ আলাদা। মোচার গড়ন নিয়ে মাথা থেকে বের হয় পুষ্পবিন্যাস; গাছি ভাইয়ের ভাষায় নাম ‘বাদি’। রেণুর কাজ শেষ হয়ে গেলে তা ঝরে ঝরে পুকুরময় ছড়ায়। স্থির জলে একটি স্বচ্ছ ওড়না মনে হয়।
শীত আসার আগে নিমাই দা আসেন। কোমরে তার মোটা দড়ি, পিঠে গোঁজা কাস্তে-কাটারি। কার্তিক-অঘ্রাণ মাসে পুরনো আর শুকনো ডাল কেটে প্রথমে সাফা করে দেন। গাছের সঙ্গে কৌণিক দূরত্বে দাঁড়িয়ে, নিজেকে দড়িতে বেঁধে শক্ত কাঁটা-পাতা ছাঁটেন। তারপর বেরিয়ে আসে ছাকনির মতো বাদামী জালতি। সব সরিয়ে পাতার গোঁড়া কেটে চাঁছ দিতে হয়। কেমন ব্যাটিং ক্রিজের মতো সাদা চৌকো অংশ বেরিয়ে আসে তখন। সেখানে রসের ধারা বেরোনোর নলি লাগানো হয়। টপটপ করে রস এসে জমা হয় বাঁধা হাঁড়িতে। হাঁড়ি বাঁধার জন্য আলাদা গুঁজি থাকে। রস যাতে বাদুড়ে না চোষে, তাই একটি মেঠো ঢাকনি দেওয়া হয়। খুব ভোরে নিমাই দা হাজির হন। গাছে তড়তড় করে উঠে রসের হাঁড়ি পেড়ে আনেন। কোনো কোনো দিন ভাড়াটিয়াদের মধ্যে আমার ভাগ্যেও এক আধটু রস জোটে। কাঁসার বাটিতে ঠান্ডা রস চুমুক দিয়ে খাই। এক বুনো ভেজা গন্ধ। হাঁড়ি শোধন করার জন্য মাঝে মাঝে ভেতরে খড় পুড়িয়ে নেন নিমাই দা। সেই পোড়া গন্ধটুকুর অবশেষ মিলেমিশে এক অব্যক্ত রসসিক্ত মেজাজ রচনা হয়। আজও ভুলতে পারিনি।