১৯ মে আর ভুলে যেতে বসা দুই বোন

অশোক সেনগুপ্ত
আমাদের ভারত, ১৯ মে: ২১ ফেব্রুয়ারি শুরুর আগে থেকেই ভাষাপ্রেমের জেরে আমাদের মাতামাতি শুরু হয়। কেউ মনে রাখিনা ১৯ মে-র কথা। অনেকের সাথে দুই বঙ্গললনা কমলা আর মঙ্গলার অবদানের কথা আজ লোকে ভুলে যেতে বসেছে।

১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় বিতর্কিত গণভোটের মাধ্যমে অসমে সিলেট (শ্রীহট্ট) জেলা পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়। কমলারা পাকিস্তানেই থেকে যান। কিন্তু ১৯৫০ সালে পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দুদের সার্বিক গণহত্যা আরম্ভ হলে তার রেশ সিলেটে(শ্রীহট্টে)-ও এসে পড়ে। কমলার পরিবার শরণার্থী হিসেবে অসমে চলে আসতে বাধ্য হন। তাঁরা সিলেট(শ্রীহট্টের) পার্শ্ববর্তী অসমের কাছাড় জেলার শিলচরে এসে আশ্রয় নেন।

১৯৬১ সালে কমলা ম্যাট্রিক পরীক্ষায় বসেন। ম্যাট্রিক পরীক্ষা শেষ হওয়ার ঠিক পরের দিন শিলচর রেল স্টেশনে মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষার দাবিতে টি পিকেটিং-এর ডাক দেওয়া হয়। সেদিন সকালে, অর্থাৎ‌ ১৯শে মে সকালে কমলাও পিকেটিং-এ যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেন। সকালে স্নান করে মেজদিদির জন্য রাখা শাড়িটা পড়ে নেন কমলা। মেজদিদি পিকেটিং-এ যেতে বারণ করলেও শোনেন না কমলা। এমন সময় ২০-২২ জনের মেয়েদের একটি দল কমলাদের বাড়িতে আসে কমলাকে নেওয়ার জন্য। কমলার মা উদ্বেগ প্রকাশ করলে তারা কমলার মাকে বুঝিয়ে রাজি করেন।

কমলার মা কমলাকে টুকরো কাপড় দেন কাঁদানে গ্যাস থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য। কমলার সাথে বেড়িয়ে পড়ে তাঁর ছোট বোন মঙ্গলা, ছোট ভাই বকুল ও বড়দির ছেলে বাপ্পা। দুপুরবেলা কমলার মা দুশ্চিন্তা করতে করতে নিজেই চলে যান রেল স্টেশনে। বকুল ও বাপ্পাকে পুলিশে ধরেছিল আবার ছেড়েও দিয়েছে। মাকে দেখতে পেয়েই ছুটে আসেন কমলা, মায়ের ধূলিধূসরিত পা ধুয়ে দিয়ে, শরবত খেতে দেন। মায়ের সমস্ত দুশ্চিন্তা দূর করে মাকে বাড়ি পাঠিয়ে দেন।

সেদিন সকালে রেল অবরোধ কর্মসূচি শান্তিপূর্ণভাবেই হয়। দুপুরের পর থেকেই অসম রাইফেল্‌সের জওয়ানরা জায়গাটাকে ঘিরে ফেলতে শুরু করে। বেলা ২-৩৫টা নাগাদ বিনা প্ররোচনায় তারা অবস্থানকারী ছাত্রছাত্রীদের নির্মমভাবে লাঠি ও বন্দুকের কুঁদো দিয়ে পেটাতে থাকে। এলোপাথারি লাঠিচার্জে অবস্থানকারী জনতা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় ও দিকবিদিকজ্ঞানশুন্য হয়ে যে যেদিকে পারে পালাতে থাকে। কমলার ছোটবোন মঙ্গলা পুলিশের লাঠির ঘায়ে মাটিতে পড়ে যান, সাহায্যের জন্য কমলার উদ্দেশ্যে চিত্কার করতে থাকেন। অসম রাইফেল্‌সের জওয়ানরা পলায়নরত জনতার উপর গুলিবৃষ্টি শুরু করে।

মঙ্গলাকে বাঁচাতে কমলা ছুটে গেলে একটি গুলি তার চোখ ভেদ করে মাথা চুরমার করে দেয়। অন্যন্য আহত ও গুলিবিদ্ধ অবস্থানকারীদের সাথে কমলাকেও হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে সেখনেই তাঁর মৃত্যু হয়। মঙ্গলাকে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। একমাস বাদে তার জ্ঞান ফিরলেও বাকি জীবনটা তিনি শারীরিক ও মানসিকভাবে পঙ্গু হয়ে যান।

১৯৬০ সালে আসামের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী (Chief Minister) বিমলা প্রসাদ চালিহার সিদ্ধান্তে এবং মন্ত্রিসভায় অসমিয়া জনপ্রতিনিধির সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে অসমিয়া ভাষাকে বরাক উপত্যকা সহ সমগ্র আসামের সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে পাশ হয় ‘Assam Official (Language) Act, 1960’।

শচীন্দ্রমোহন পাল, কানাইলাল নিয়োগী, কুমুদ দাস, তরণী দেবনাথ, হীতেশ বিশ্বাস, চণ্ডীচরণ সূত্রধর, সুনীল সরকার, সুকোমল পুরকায়স্থ, বীরেন্দ্র সূত্রধর এবং সত্যেন্দ্রকুমার দেবের সঙ্গে সবার প্রথমে বরাকের ভাষা শহিদ হিসেবে উচ্চারিত হয় কমলা ভট্টাচার্যের নাম। আজও সেই শিলচর পাবলিক স্কুল রোডে গেলে দেখা যাবে সেই রাস্তার নাম পালটে করা হয়েছে কমলা ভট্টাচার্য রোড। কমলার সেই স্কুল ছোটেলাল শেঠ ইন্সটিটিউটে বসেছে তাঁর আবক্ষ মূর্তি।

না, আজ ফেসবুকের দেওয়াল ভরে ওঠেনি সেই ভাষাশহীদদের স্মৃতিতে। অর্ধেক ইংরেজি-সহ বাংলা কথা বলে এবং লিখে আমরা আত্মতৃপ্তি বোধ করি। কমলা-মঙ্গলা দুই বোন বুঝি হারিয়ে গিয়েছেন বিস্মৃতির গহ্বরে।

ঋণ— উইকিপিডিয়া, সিমন রায় (বঙ্গদর্পন)।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *