একটার পর একটা পুজো মণ্ডপে অগ্নিসংযোগ, হিন্দুদের দেবদেবীর প্রতিমা চুর্ণবিচুর্ণ করে, ঠিক কতটা পৈশাচিক আনন্দ উপভোগ করা যায়: রজত মুখার্জি

রজত মুখার্জি, পশ্চিমবঙ্গ বিজেপি প্রদেশ পরিষদীয় সদস্য
আমাদের ভারত, ১৮ অক্টোবর: অত্যন্ত ব্যথিত ও ভারাক্রান্ত হৃদয়ে বিজয়া দশমীর পারস্পরিক শ্রদ্ধা, ভালবাসা, প্রণাম ও শুভেচ্ছা বিনিময়ের সনাতনী হিন্দুদের চিরাচরিত প্রথাগত পরম্পরার ছক ভেঙে আমার আজকের এই বক্তব্য শুধুই একরাশ অভিমান, আক্ষেপ, ক্রোধ ও ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ মাত্র। মা কৈলাসে ফিরে গিয়েছেন মহাষ্টমীর রাতেই, বলা ভাল ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছেন। তাই হৃদয় বিদীর্ণ করা এবারের বিজয়া বিবর্ণ, এবারের বিজয়া রক্তাক্ত। ১৯৪৬ এর নোয়াখালী দাঙ্গার রক্ত প্রবাহের ভয়ার্ত স্মৃতি আবার ফিরে এসেছিল শারদোৎসবের নবমী ও দশমীর দিনগুলিতে। এ যেন নোয়াখালী দাঙ্গা হিন্দু নিধন যজ্ঞের দ্বিতীয় অধ্যায়। পার্থক্য একটাই সেবারের দিনটি ছিল কোজাগরী লক্ষী পূজার দিন, আর এবারে দুর্গাপূজার সময়। সুদীর্ঘ ৭৫ বছরের একটা সুবিশাল ব্যবধান থাকলেও আবহ, প্রেক্ষাপট, চিত্রনাট্য ও উদ্দেশ্য ছিল সম্পূর্ণ অপরিবর্তিত।

আমি বরাবরই সর্বধর্ম সমন্বয়ের নীতিতে বিশ্বাসী। পরম নিষ্ঠা সহকারে নিজের ধর্মাচরনের পাশাপাশি অপরের ধর্মে শ্রদ্ধা প্রদর্শনে বিন্দুমাত্র কার্পণ্য বা কুন্ঠিত বোধ করি না। কিন্ত ধর্মীয় উন্মত্ততা সহ মৌলবাদের বিরুদ্ধে একরাশ ঘৃণা আমার হৃদয়ে আশৈশব চরম বিতৃষ্ণার সাথে লালিত হয়। প্রণিধানযোগ্য যে, সকলের নিজ নিজ ধর্ম পালনের অধিকার আছে এবং এই অধিকার কারো দয়া বা ভিক্ষায় অর্জিত নয় বরঞ্চ ভারত বা বাংলাদেশের মত গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্রে নিজ নিজ ধর্মাচরনের অধিকার সংবিধান প্রদত্ত ও স্বীকৃত। তাহলে প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দুদের ওপর নেমে আসা একটার পর একটা পাশবিক আক্রমণ সংঘটিত হয় কোন অধিকার বলে? কেন দিনের পর দিন ইসলামিক মৌলবাদের রোষানলের শিকার হতে হয় সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায় কে? সুপরিকল্পিত ভাবে একটার পর একটা মন্দিরে ধ্বংসলীলা সাধিত হচ্ছে কাদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ মদতে, এই প্রশ্নের জবাবদিহি করতেই হবে প্রতিবেশী রাষ্ট্র লকে। একটার পর একটা পুজো মণ্ডপে অগ্নিসংযোগ, হিন্দুদের আরাধ্য দেবদেবীর প্রতিমা চুর্ণবিচুর্ণ করে, ঠিক কতটা পৈশাচিক আনন্দ উপভোগ করা যায়, এ প্রশ্নের উত্তর আমার আজও অজানা।

আরও পড়ুন

নিশ্চিন্তে ঘরে বসে থাকলে জানবেন, আপনার বাড়ির মেয়েও আগামী দিনে সুরক্ষিত নয়, বাংলাদেশের ঘটনার পর সতর্ক করলেন বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার

ইসলামিক রাষ্ট্র হলেও আমাদের প্রতিবেশী বন্ধু রাষ্ট্র বাংলাদেশ তো সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির স্বঘোষিত পীঠস্থান। বাংলাদেশে বসবাসরত অগণিত হিন্দু, মুসলমান বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে বিভিন্ন সময়ে সে দেশে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের আখ্যান শুনেছি। তাহলে আজ কেন এই দ্বিচারিতা? কেন সংখ্যালঘু হিন্দুদের সাথে এ হেন বৈমাতৃসুলভ আচরণ? ইন্টারনেটের সুবাদে যে কোনও প্রশংসনীয় বা নিন্দনীয় ঘটনাই আজকাল আর গোপন রাখা যায় না, সীমান্তের কাঁটা তারের বেড়াজাল অতিক্রম করে মুহূর্তের ব্যবধানে তা ছড়িয়ে পড়ে দেশ হতে দেশান্তরে, সমগ্র বিশ্ব ব্রহ্মান্ডে। বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন গণমাধ্যমে ভেসে আসা অগণিত ভিডিও ফুটেজ মারফত নির্বিচারে হিন্দুদের ওপর নেমে আসা পাশবিক আক্রমণ, খুন, একই পরিবারের মা, মেয়ে সহ নয়’বছরের অবোধ বালিকার গণধর্ষণ, সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের আবাস ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগের মত ক্রমাগত প্রবাহমান নারকীয়, নির্মমতার অগণিত ঘটনাবলীর পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ আজও অব্যাহত। আজ ভীষণ বেদনাক্লিষ্ট হৃদয়ে বলতে বাধ্য হচ্ছি, আসলে মুর্খের অশেষ দোষ, আর পাকিস্তান, বাংলাদেশের মত অনগ্রসর রাষ্ট্রে এখনও স্বল্প শিক্ষিত, অশিক্ষিত মানুষের সংখ্যাধিক্য, তাই উন্মত্ত ধর্মান্ধতার এতটা বাড়বাড়ন্ত। তা না হলে নির্বিচারে হিন্দুদের আস্থার স্থল মন্দির বা দেবদেবীর প্রতিকৃতি অবলীলায় ধ্বংস করে, বিশ্বজয়ের আনন্দে উল্লাসিত হয়ে উদ্বাহু নৃত্য করার দৃশ্য বারবার দেখা যেত না। অপরের কষ্ট কাতরতার দৃশ্যে মোটেই কোনও নান্দনিকতার পরশ নেই, এই সহজ সত্য মৌলবাদের পৃষ্ঠপোষকদের কে বোঝাবে? কার ধরে দুটো মাথা আছে?

মুষ্টিমেয় কতিপয় মুসলিম মৌলবাদীদের উগ্রবাদ যে আজকে বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশকে নিন্দিত ধিকৃত করে তুলছে, এই সামান্য বোধবুদ্ধি টুকু যদি তাদের থাকত তারা সর্বদাই এ হেন ঘৃণ্য আচরণ থেকে বিরত থাকতেন। এখন প্রশ্ন হল যে, শান্তিপূর্ণ বাংলাদেশে শান্তি বিঘ্নিত করার লক্ষ্যে যে বিষবৃক্ষের রোপন করলেন মৌলবাদের ঠিকাদাররা, তাতে লাভ হল কার? ক্ষতিটাই বা কাদের? কারা জয়ী হল? পরাজিতই বা কোন পক্ষ? আসলে সারা বিশ্ব যখন উল্কার গতিতে উন্নয়নের পথে ধাবমান, ঠিক সে সময় দাঁড়িয়ে কট্টর মৌলবাদের এ হেন ধর্মীয় উন্মাদনা নিজের মাতৃভূমিকেই পশ্চাদবর্তী করে তোলে, যা আখেরে নিজেদেরই ক্ষতি, নিজেদের ধ্বংসকেই তরান্বিত করে। অতএব ধর্মাচরনের এ যুদ্ধে যদি কারও পরাজয় হয়ে থাকে, তা হল মানবতার পরাজয়, মানবিকতার পরাজয়, স্বাধীনতার পরাজয়, স্বাভিমানের পরাজয়, নীতি নৈতিকতার পরাজয়। এই দাঙ্গায় পরাজিত হয়েছে, আত্মীয়তা, প্রেম, ভাতৃত্ববোধ, সম্পর্কের উষ্ণতা, একাত্মতা, আলিঙ্গণ, একে অপরের পরিপূরক হয়ে ওঠার মানসিকতার। যা দেশের ক্ষতি, জাতির ক্ষতি। দাঙ্গাকারীদের সচেতন করি, আপনাদের বপন করা বিষবৃক্ষের সুদুর প্রসারিত শাখা প্রশাখা কলুষিত করবে আপনাদেরই বাংলাদেশের আকাশ বাতাস বায়ুমন্ডল। কথায় বলে what goes around comes around. অতএব সাধু সাবধান। যাইহোক আজকের এই রক্তরঞ্জিত বাংলাদেশের বেদনাক্লিষ্ট এবং তমসাচ্ছন্ন কালখন্ডের পরিপ্রেক্ষিতে দাঁড়িয়ে ভূপেন হাজারিকার এই কালজয়ী অমর গানটা যেন আরও বেশি প্রাসঙ্গিকতা ফিরে পেয়েছে, “বিস্তীর্ণ দুপারের, অসংখ্য মানুষের হাহাকার শুনেও, নিঃশব্দে নীরবে ও গঙ্গা (পড়ুন পদ্মা) তুমি, ও গঙ্গা বইছ কেন?”


ছবি: প্রতিবেদকের ছবি।

রাষ্ট্রের বিচার ব্যবস্থার ওপর শ্রদ্ধাশীল ও আস্থাবান হওয়া একজন দায়িত্বশীল সুনাগরিকের কর্তব্য ও দায়বদ্ধতা। ভগবান হনুমানজীর প্রতিমার পাদদেশে পবিত্র কোরান রাখা মোটেই সমীচীন নয় বা তা কখনোই কাঙ্খিত নয়। কিন্ত যেটা বোঝার বিষয় তা হল, এই দুর্মতি কখনোই সমষ্টিগত নয় কারণ বাংলাদেশে বসবাসরত হিন্দু সমাজ কখনোই এই দুঃসাহস দেখাবে না, যেহেতু তারা সেদেশে সংখ্যালঘু। তাছাড়া কোনও সনাতনী হিন্দুর পক্ষে পবিত্র গীতার পরিবর্তে পবিত্র কোরানের পূজার্চনা নিজের ধর্মের প্রতিই অবমাননাকর। যতদূর জেনেছি কুমিল্লার এই পুজোটির ঐতিহ্য ও পরম্পরা দীর্ঘদিনের, সুতরাং পুজো আয়োজকদের পক্ষে এমন গর্হিত কাজ প্রায় অসম্ভবেরই নামান্তর মাত্র। অত্যন্ত সুচতুর মস্তিষ্কের কোনও কুচক্রীর ইন্ধনে সুকৌশলে এবং সুপরিকল্পিত ভাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারকে বদনাম করার গভীর চক্রান্তও হতে পারে। রহস্যের নিরসন না হওয়া অবধি কোনও তত্ত্বই খারিজ করে দেওয়া যাচ্ছে না। বাংলাদেশের রাজনীতি সম্পর্কে আমার প্রজ্ঞা নিতান্তই কম। তবুও যেটুকু জেনেছি, একজন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে উনি জাতি, ধর্ম, বর্ণ, রাজনৈতিক মতাদর্শ নির্বিশেষে সকল নাগরিকদের প্রতি সমপরিমাণ স্নেহপ্রবন ও ন্যায় পরায়ন। ওদেশের সংখ্যালঘুদের ভাষ্য অনুযায়ীই, হিন্দুদের যাবতীয় আশা ভরসা ওনাকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়। সর্বোপরি আওয়ামী লীগ সরকারের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ, উন্নয়নের সাফল্যের নিরিখে বিশ্বের প্রবল উন্নয়নশীল দেশগুলোর অন্যতম, যা সরকার পক্ষকে খ্যাতির শিরোনামে উপস্থাপিত করেছে। অতএব দেশের অভ্যন্তরে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হাঙ্গামার বিষবাষ্প ছড়িয়ে দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারকে বিশ্ববাসীর সমীপে অপদস্থ করার, বিরোধীদের এই সুগভীর চক্রান্তের তত্ত্ব কোনওভাবেই সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়। যদিও অপ্রত্যাশিত ঘটনা প্রবাহের অব্যবহিত পরে পরেই শান্তিপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সরকারের তৎপরতা প্রশংসনীয়। দাঙ্গাকারীদের বিরুদ্ধে মাননীয়া প্রধানমন্ত্রী ও সেদেশের সড়ক পরিবহণ মন্ত্রী মাননীয় ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্য আতঙ্কগ্রস্ত সংখ্যালঘুদের আস্থা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছে, যা আশার সঞ্চার করে।

আমার কিছু কিছু বন্ধুমহল মনে করতে পারেন যে, বাংলাদেশে ক্রমাগত ঘটে চলা বর্বরোচিত আক্রমণের বিরুদ্ধে কলম ধরলে, সেটা হতে পারে ‘সাম্প্রদায়িক উস্কানি’ তাদের আমি স্বতঃস্ফূর্তভাবে ও স্বচ্ছন্দে আমার বন্ধুবৃত্ত ত্যাগ করতে অনুরোধ করব। আত্মকেন্দ্রিকতা ও সঙ্কীর্ণ স্বার্থ চরিতার্থের মানসিকতাকে আমি চিরকালই ঘৃণা করে এসেছি, সেই ঘৃণার আগুনে দয়াপূর্বক আর ঘৃতাহুতি দেবেন না। এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য যে ভারতবর্ষের পাশাপাশি বাংলাদেশেও আমার অসংখ্য মুসলিম ভাই বন্ধুবান্ধব ও শুভানুধ্যায়ী রয়েছেন যাদের সাথে আমার রীতিমত নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে। তাদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক রীতিমত আত্মিক, পারিবারিক ও পারস্পরিক ভালবাসা ও শ্রদ্ধাবোধের। আমি প্রত্যয়ী যে, আমার এই বক্তব্যের সাথে বেশিরভাগ শিক্ষিত মানুষ একমত হবেন, তিনি যে ধর্মেরই অনুসারী হোন না কেন।

উপসংহারে বলব, বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যের বার্তাই তো গনতন্ত্রের মুল বৈশিষ্ট্য। শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের আবহই তো গণতন্ত্রের একমাত্র উপজীব্য। প্রার্থনা করি বাংলাদেশের গণতন্ত্র দীর্ঘজীবি হোক। ধার্মিক বিভেদকে দুরে সরিয়ে রেখে হিন্দু মুসলমানের সাম্যবাদের ছবিই হয়ে উঠুক উন্নয়নশীল, প্রগতিশীল মানবিক বাংলাদেশের সেরা বিজ্ঞাপণ।
(বক্তব্য লেখকের নিজস্ব, এর জন্য আমাদের ভারত দায়ী নয়।)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *