কল্পতরু দিবসে নববর্ষকেও ছাপিয়ে গেছেন পরমহংসদেব

ড. কল্যাণ চক্রবর্তী

আমাদের ভারত, ১ জানুয়ারি : ১ লা জানুয়ারি শ্রীরামকৃষ্ণ-সম্পৃক্ত। দিনটি কল্পতরু দিবস রূপে চিহ্নিত। যেন ইংরেজি নববর্ষ গৌণ ব্যাপার, শ্রীরামকৃষ্ণ মাহাত্ম্যই ভারতবর্ষে মুখ্যস্থান অধিকার করে আছেন। রামরূপে শ্রীবিষ্ণু ‘বারোয়ানা’, কৃষ্ণরূপে ‘ষোলোয়ানা’ অবতারত্ব নিয়ে এসেছিলেন। অবতাররূপে এবার তিনি ‘সর্ব অবতারী’ হলেন, এবার তিনি ‘অবতার-বরিষ্ঠ’ হলেন। নরদেহী শ্রীরামকৃষ্ণ যদি অবতার-বরিষ্ঠ, তাহলে প্রশ্ন, অবতার কাকে বলে?

গীতায় রয়েছে “অজোহপি সন্নব্যয়াত্মা ভূতানামীশ্বরোহপিসন্।/প্রকৃতিং স্বামধিষ্ঠায় সম্ভবাম্যাত্মমায়য়া।” আমি জন্মরহিত, আমার চিন্ময় দেহ যদিও অব্যয়; যদিও আমি সর্বভূতের ঈশ্বর; তবুও আদি চিন্ময়রূপে আমার অন্তরঙ্গা শক্তিকে আশ্রয় করি এবং যুগে যুগে আবির্ভূত হই। ঈশ্বরের এই আবির্ভূত সত্তাই হলেন অবতার। “যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত।/অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্।।” যখনই ধর্মের অধঃপতন হয় এবং অধর্মের অভ্যুত্থান হয়, তখন অবতার হয়ে নিজেকে প্রকাশ করেন শ্রীবিষ্ণু। ধর্ম সংস্থাপনের জন্য যুগে যুগে অবতীর্ণ হন।

কর্মফলের জন্য তাঁকে বাধ্য হয়ে ধরাধামে আসতে হয়, তা নয়। তিনি কৃপা করতে আসেন, তিনি মানব কল্যাণের জন্য আসেন, নরদেহী হয়ে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। মায়াডোর তাঁকে বেঁধে রাখতে পারে না, তিনি ‘মায়াধিপতি’ হন। এ ‘সাধক’-এর আবির্ভাব নয়, এ ‘অবতার’-এর আবির্ভাব। দুই আবির্ভাব সমার্থক নয়।

শ্রীরামকৃষ্ণ কেন অবতার? কারণ তাঁর মধ্যে ত্যাগের অপরিসীম শক্তি ছিল। তাঁর মধ্যে মৃত্যুতুল্য সমাধিস্থ থাকার অসামান্য ক্ষমতা ছিল। তাঁর মধ্যে স্পর্শ আবেশে অপরকে আধ্যাত্মিক উপলব্ধিতে জারিত করার ক্ষমতা ছিল। সতত দেবত্বের উপলব্ধি ছিল তাঁর। বারে বারে সাধন-শিখরে পৌঁছানোর নজির ছিল। ভারতবর্ষে যখন খ্রিস্টীয় প্রভাব সমানে বাড়ছে, যুগের এমন বিশেষ প্রয়োজনে তিনি মর্তে এলেন। প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান-রহিত গ্রাম্যযুবক হলেও তাঁর ছিল শাস্ত্রবিচারের অনন্য জ্ঞানভাণ্ডার। ছিল অনন্ত-অমৃতলোকের চাবিকাঠি। ছিল দুই কাঁধে বিবেক-বৈরাগ্যের নিত্য ঝোলা।

ভৈরবী ব্রাহ্মণী দক্ষিণেশ্বরের নাটমঞ্চে একদিন তাঁকে উন্মোচন করেছিলেন। প্রথিতযশা পণ্ডিতদের মাঝখানে সেদিন নানান প্রমাণসহ ব্যাখ্যা করে ব্রাহ্মণী বলেছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ অবতার। সেদিনও কিন্তু সমকাল বোঝেনি, তাঁর সংজ্ঞা স্বরূপ বৈশিষ্ট্য। দ্ব্যর্থহীনভাবে মানুষ বুঝলো, যেদিন তিনি নিজে আত্মপ্রকাশ করে অভয়দান করলেন। যেদিন অহৈতুকী কৃপাসিন্ধু হলেন। যেদিন পতিতপাবন রূপে নিজেকে শীতের এক বিকেলে অনাবৃত করে ফেললেন। কিন্তু ভক্তরা আরও দেখতে চান তাঁকে। দেখতে চান তাঁর ঐশী রূপমাধুরী। “মনে হয় অঙ্গবাস সব দিয়া খুলি।/নয়ন ভরিয়া দেখি রূপের পুতুলি।” সেটা ১৮৮৬ সালের ১ লা জানুয়ারি। কলকাতার কাশীপুর উদ্যানবাটিতে। যেদিন তিনি অন্তরঙ্গ-পার্ষদ আর ভক্তমণ্ডলীর কাছে স্বরূপে আত্মপ্রকাশ করলেন।

কল্পতরু-লীলা বর্ণনা নানান গ্রন্থে সন্নিবেশিত হয়েছে। যেমন স্বামী সারদানন্দ রচিত ‘লীলাপ্রসঙ্গ’-এ, কবি অক্ষয়কুমার সেন বিরচিত ‘শ্রীরামকৃষ্ণ পুঁথি’-তে, শ্রীম কথিত ‘শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত’-এ। প্রস্তুত নিবন্ধে স্বামী অভেদানন্দ রচিত ‘আমার জীবনকথা’ গ্রন্থের বিবরণ কিয়দংশ উদ্ধৃত করা হচ্ছে। শ্রীরামকৃষ্ণ তখন গলায় দুরারোগ্য কর্কট রোগে আক্রান্ত। সেদিন অফিস ছুটির দিন। বিকেলে বাগানবাটিতে এসেছেন গিরিশ ঘোষ সহ গৃহস্থ ভক্তরা। সেবক-পার্ষদরাও রয়েছেন। শ্রীরামকৃষ্ণ এদিন কিছুটা সুস্থ অনুভব করে দোতালা থেকে নীচে নেমে বাগানে হাঁটছেন। এরই মধ্যে গিরিশ ঘোষের সঙ্গে কথা হল। ঐশী সংলাপে ঠাকুর বাহ্যজ্ঞানশূণ্য হলেন। ভাবাবিষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন তিনি। সংজ্ঞালাভ করে সবাইকে আশীর্বাণী দিলেন, ‘তোমাদের চৈতন্য হোক্’। সকলকে স্পর্শ করলেন, তাদের অধ্যাত্ম-আঁখি খুলে দিলেন, সকলের সকল প্রার্থনা পূরণ করলেন। “ভাই ভূপতি সমাধি প্রার্থনা করিয়াছিল। তাহাকে শ্রীশ্রীঠাকুর কৃপা করিয়া বলিয়াছিলেন, ‘তোর সমাধি হবে’। উপেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় অত্যন্ত গরিব অবস্থায় অর্থাভাবে কষ্ট পাইতেছিলেন বলিয়া অর্থ প্রার্থনা করিয়াছিল। শ্রীশ্রীঠাকুর তাহাকে কৃপা করিয়া বলিলেন, ‘তোর অর্থ হবে।’ রামলালদাদা, বৈকুন্ঠ সান্যাল প্রভৃতি গৃহস্থ-ভক্তদিগকে তাহাদের যাহা যাহা প্রার্থনা ছিল, তাহা তিনি আশ্বাস দিয়া ‘পূর্ণ হবে’ বলিয়া কৃপা করিলেন।”

এখন হিন্দুসমাজের কাছে কল্পতরু উৎসব কেন তাৎপর্যপূর্ণ? কারণ এটি খ্রিস্টীয় ক্যালেণ্ডারের প্রথম দিবস, বড়দিন থেকে শুরু হওয়া উইন্টার ফেস্টিভ্যালের এক গুরুত্বপূর্ণ দিন। বর্ষবরণের দিন। আর প্রথম দিনেই কলোনিয়াল ফেস্টিভ্যাল বোল্ড আউট হয়ে গেল হিন্দুয়ানীর পবিত্র ছোঁয়ায়। রক্তপাতহীন নীরব এক আধ্যাত্মিক যুদ্ধ। এরই নাম স্পিরিচুয়াল রেভোলিউশন। এটা যে কত বড় জয়, তা যতই সময় পেরোবে, ততই অনুভূত হবে। (ছবি এঁকেছেন শীর্ষ আচার্য)

আপনাদের মতামত জানান

Please enter your comment!
Please enter your name here