ফিরে দেখা! চারিদিকে সিপিএমের ধমকানি চমকানিতে পড়াশোনা করা মানুষ ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকত: ড. কল্যাণ চক্রবর্তী

(খড়দার ভূমিপুত্র কৃষিবিজ্ঞানী ড. কল্যাণ চক্রবর্তী খড়দায় একাদিক্রমে ৩৫ বছর অবস্থান করেছেন। তার সঙ্গে খড়দার মানুষের দীর্ঘ সাংস্কৃতিক-সাহিত্যিক-সামাজিক যোগসূত্র আজও বিনষ্ট হয় নি। তিনি আপন-চারণায় সমকালীন সময়ের অভিজ্ঞতা শেয়ার করছেন, তার মধ্যে সেই সময়ের স্থানীয় ইতিহাস কিছুটা ফুটে উঠবে এই আশায় তা পরিবেশিত হল। তিনি ব্যক্তিবিশেষকে আক্রমণ করার লক্ষ্যে এই ধারাবাহিক নিবন্ধ লিখছেন না, লিখছেন নিজেকে অবিরত জানতে, নিজের ফেলে আসা পথটির স্বরূপসন্ধান করতে, যাতে আগামীদিনে আরো নির্মল ভাবে সকলকে সঙ্গে নিয়ে পথ চলতে পারেন। প্রস্তুত প্রতিবেদনটি তার চতুর্থ পর্ব)

ড. কল্যাণ চক্রবর্তী

আমাদের ভারত, ২২ ডিসেম্বর: ২০০০ সাল, আবারও পত্রিকা সম্পাদনা, আবারও খড়দহের রাজনৈতিক তাপ-উত্তাপের আঁচ এসে পড়ল আমার উপর। স্থানীয় সংবাদপত্র প্রকাশিত হল খড়দহ থেকে। সংবাদপত্রের নাম ‘সংবাদ এখন’, পরে বদল করে ‘রোজনামচা’।

তখন কেন্দ্রে বিজেপির শাসন, রাজ্যে শাসকদলের মধ্যে পোয়াল কোঁড়কের মতো বিদ্রোহী ব্যক্তিত্বের অভ্যুদ্বয়, বামপন্থার ভাঙ্গন অব্যাহত। সিপিএমের বিরুদ্ধে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতি মানুষের আগ্রহের চোরাস্রোত, পাশাপাশি বিজেপি রাজনীতির বর্ণময় বোধন। খড়দহেও তার প্রবল স্রোত। এরই মধ্যে আরএসএস ক্রমেই সক্রিয় হচ্ছে খড়দার মাটিতে। রহড়া-খড়দা যে লোকসভার অন্তর্ভুক্ত, তা ভারতীয় জনতা পার্টির দখলে চলে এসেছে নয়ের দশকের শেষে। সিপিএমের প্রার্থী ‘কমরেড’ নির্মল কান্তি চ্যাটার্জিকে পরাজিত করে সাংসদ হয়েছেন ভারতীয় জনতা পার্টির শ্রী তপন সিকদার। খড়দার মাটিতে ভারতমাতার জয় ধ্বনিত হচ্ছে। পত্রিকা প্রকাশ যখন হল তখন তিনি কেন্দ্রে যোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি দপ্তরের রাষ্ট্রমন্ত্রী।

এদিকে সিপিএমের মধ্যে শুরু হয়েছে অভূতপূর্ব অন্তর্দলীয় কোন্দল, গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, খুন-খারাপির রাজনীতি। চারপাশে মানুষ হাঁসফাঁস করছে। শাসকদলের অন্যায় কাজকর্ম থেকে মুক্ত হয়ে বেরোতে চাইছেন, স্বাধীন স্বপ্ন দেখতে চাইছেন, কিন্তু গণতান্ত্রিক পথে তা সংগঠিত করার সাহস পাচ্ছেন না, চারিদিকে ধমকানি চমকানি চলছে। তাই স্থানীয় পত্রিকার পাতায় খড়দহ ও নিকটবর্তী এলাকার সংবাদ নিত্য প্রকাশ করার একটা দাবি অনুভূত হল। “লাও তো বটে, কিন্তু আনে কে!” পড়াশোনা করা মানুষ ভয়ে কাঁটা। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু প্রাজ্ঞ-পন্ডিত খড়দহের বাসিন্দা, বহু বুদ্ধিজীবী খড়দহের সম্পদ হলেও সিপিএমের নামে রা-কাটতেন না। দুই একটি রাজনীতির লোকজন লুকিয়ে চুরিয়ে মানুষের হাতে লিফলেট ধরাতে পারতেন, বাকী সব বিরোধী রাজনৈতিক দলের লিটারেচার খড়দহের রাস্তায় গড়াগড়ি খেতো। কাজেই সংবাদপত্রের সম্পাদক খুঁজে পাওয়া গেল না। অপশাসনের বিরুদ্ধে কলম ধরাবেন এবং নিজেও ধরবেন এমন মানুষ তখন খড়দাতে ছিল না।

এদিকে ঘটমান-বর্তমান যাবতীয় কাজে সিলমোহর দিতে শাসকদলের ইচ্ছায় একটি সংবাদপত্র প্রকাশিত হল, যা তাদেরই স্তব স্তুতিতে পরিপূর্ণ থাকত, সেই কাগজটার নাম আর নিচ্ছি না। খড়দহের সচেতন মানুষ জানাতেন, পত্রিকার পাতা খুললেই আলিম স্ট্রিটের আতরের গন্ধ সোজা নাকে এসে লাগে। তার পরতে পরতে লোহিতাভ বর্ণমালা চিরকালের জন্য যেন জাঁকিয়ে বসেছে।

১৯৯৮ সাল থেকেই নানান মানুষের কাছ থেকে দাবি আসছিল, আমি যেন একটি নির্ভীক সংবাদপত্রের নেতৃত্ব দিই। সেই সময় মালদায় কাজ করছি, ছুটির দিনে খড়দায় ফিরি, তাই দায়িত্ব নিতে চাইছিলাম না, ফিরিয়ে দিলাম অনুরোধ। ১৯৯৯ সালের শেষে কর্মসূত্রে কাছাকাছি চলে আসার সুবাদে আবারও অনুরোধ এলো। শাসক দলের আনুকুল্যে প্রকাশিত পত্রিকা হাতে এলো, সাধারণ মানুষের হাসিকান্নার দিকটা একেবারেই দেখতে পেলাম না। খড়দহের সমাজ-সংস্কৃতি-রাজনীতি একেবারেই শাসকপূজার উপাসনালয় হয়ে উঠেছে। এইবার আমি রাজি হলাম পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব নিতে। ‘সোনাইবার্তা’-র পর রহড়া-খড়দহের ‘সংবাদ-এখন’। এখন মনে হয়, গণতন্ত্রের পূজায় এক পুরোহিতের আসন পেতে বসা! কল্যাণমন্ত্র কতটা সঠিকভাবে উচ্চারণ করতে পেরেছি, তা কালই বিচার করবে।

সরকারি আনুকুল্যে পত্রিকা চালানো সহজ, কারণ ঘরে বসে বিজ্ঞাপন ও উপঢৌকন পাওয়া যায়। রাশি রাশি সম্মানও দিগন্তরেখায় অধরা বলে মনে হয় না। কিন্তু মানুষের পত্রিকা, মানবতার পত্রিকায় এমন সুযোগ তো আসেই না, বরং ‘ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো’-র মতো ব্যাপার হয়। উল্টে পত্রিকা চালানোর অনেক খরচ এবং নানান দায়বদ্ধতাও এসে হাজির হয়। পত্রিকার দাম বেশি করা চলবে না, বিক্রি যারা করবেন তাদের কমিশন দিতে হবে, তাহলে এত খরচ উঠবে কোথা থেকে? পত্রিকার সংবাদ সংগ্রহ করতে ও করাতে হবে, ফিচার রচনা করে পাঠককে টানতে হবে, সম্পাদনা, প্রুফ দেখা থেকে শুরু করে বিপণনের বহুবিধ ব্যবস্থা নিজেকেই করতে হবে। অবশ্য পত্রিকা-বান্ধবদের সহযোগিতা ছিল, নতুবা এতবড় দায়িত্ব সামলানো কঠিন হত।

২০০০ সালের প্রথম দিকে পত্রিকা প্রকাশ হল। সংখ্যা বেরোতেই শাসকদলের সরাসরি বিরোধিতা, অবুঝ স্থানীয় মানুষরা (কথ্য ভাষায় এদের নাম ‘পার্টি দরদী’) না জেনেই গালাগাল শুরু হল। কারণ প্রথম সংখ্যায় খড়দহ পুরসভার দুর্নীতির সংবাদ ছবিসহ ছাপানো হয়েছিল, ছিল ‘খড়দায় সিপিএমের ভাঙনের উৎস সন্ধানে’ শীর্ষক একটি ধারাবাহিক প্রতিবেদন। একদম ‘ত্রাহি মধুসূদন’ অবস্থা। সাধারণ মানুষ ভয়ে আমার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিলেন, আমার সঙ্গে মিশলেই তাদের অনবরত চোখে চোখে রাখা হত। তাই অনেকে সেই সময় আমায় চিনতে পারতেন না!

পত্রিকা বন্ধ করাতেই হবে, শাসকদল রেওয়াত করবে না। সে যে কী দিন গেছে, আমি জানি। খড়দহের একজন চিকিৎসক-রাজনীতিবিদ প্রায় একশো মানুষকে বাইরে রেখে সপার্ষদ কয়েকজন এলেন আমার বাড়িতে আলোচনায় বসতে। মূল বিষয়, পত্রিকার সম্পাদক হিসাবে আমার থাকা চলবে না। আমি সবিনয়ে তাদের জিজ্ঞেস করলাম, “দাদা, এটা বলতে এত মানুষ চারপাশে কেন? আমাকে কী হুমকি দেওয়া হচ্ছে? আপনি একলাই তো বার্তাবহ হয়ে আসতে পারতেন! তাছাড়া একটি সংবাদপত্র সম্পাদনা করা কোনো অগণতান্ত্রিক কাজ নয়। সকল মানুষের একটি নির্দিষ্ট জীবনদর্শন থাকে, আমারও আছে। আমার বিবেচনায় মনে হয়েছে সত্যান্বেষী, নিরপেক্ষ একটি সংবাদপত্র খড়দার মানুষের কাছে Unfelt Need, সেই কাজটিই আমি সাধন করছি, আমার কর্মক্ষেত্রের কোনোরূপ অবহেলা না করে। আমি অন্যায় করিনি। আমাকে বাধা দিয়ে গণতন্ত্রের অমর্যাদা করবেন না। সব মানুষেরই গণতান্ত্রিক পথে শুভঙ্করী কাজে সামিল হওয়ার অধিকার আছে। ভয় দেখিয়ে তা বন্ধ করা যায় না।”

আমার উত্তর তাদের ক্রোধানলে ঘৃতাহুতি পড়ল। চোয়াল শক্ত করে প্রায় ফুঁসতে ফুঁসতে সকলে সেদিনের মতো বেরিয়ে গেলেন। তারপরই দুই এক দিনের মধ্যে কোর্টের সমন এলো, খড়দহ মিউনিসিপালিটি আমার বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করেছে। মামলার খবরও ফলাও করে পত্রিকার পরের সংখ্যায় প্রথম পাতায় ছাপালাম। খড়দার মানুষ নড়েচড়ে বসলেন, সাহস পেলেন, আমার মনোবল বাড়াতে অনেকে এগিয়ে এলেন। বললেন, এ অন্যায়, মুখ বন্ধ করানোর অপচেষ্টা। কোর্টে সাক্ষী হিসাবে পুরসভা যাদের তুলেছে, তারা সকলেই আমার পূর্ব পরিচিত। পুরসভার চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে এক এক করে সাক্ষীর দল আদালতের কাছে আমার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি তুলছে। বুঝতে পারলাম, সোজা পথে থামাতে না পেরে এবার আইনীপথে আমাকে বাঁধা দেবে শাসকদল। চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলাম। বুঝলাম আইনী লড়াইয়ে আইনজীবী নিয়োগের খরচ এবার পত্রিকার খরচের সঙ্গে যোগ হতে চলছে, তার আর্থিক দায় অনেকাংশ আমাকেই বহন করতে হবে। করতেও হয়েছিল। গণতন্ত্রের জন্য লড়াইয়ে আপোষ চলে না, শেষ দেখতে হবে, আইনের শুভঙ্করী পথেই এগিয়ে চললাম। শুরু হল খড়দার বুকে গণতন্ত্র রক্ষা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতার জন্য এক সম্পাদকের আইনী ও সংবাদ-প্রবাহের লড়াই।

আজকের দিনে দাঁড়িয়ে সেদিনের গুরুত্ব উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। ঢাল নেই, তলোয়ার নেই, কিন্তু ‘নিধিরাম সর্দার’-ও আমি নই। ঈশ্বর আমার সহায় ছিলেন সেদিন, মনের জোরে কখনও ঘাটতি দেখা যায়নি। পুরসভা ও শাসক দল চেয়েছিল আমি যেন জামিন না পাই, আচ্ছা করে কড়কে দেওয়ার সব বন্দোবস্তই তারা করেছিল। কিন্তু এক প্রবল মানসিক শক্তিধর অ্যাডভোকেট আমার এবং আমাদের হয়ে লড়লেন। আমি এবং প্রকাশক শুভব্রত রায় চৌধুরী সেদিন জামিন পেলাম। দ্বিতীয় দিনের সওয়ালে আমাদের পক্ষের উকিল আদালতকে বোঝাতে সক্ষম হলেন, পত্রিকার সংবাদের সত্যতা। তৃতীয় সওয়াল থেকে ওদের পক্ষ হাল্কা হতে শুরু করল। বুঝতে পারল তাদের কেস জেতার কোনো সম্ভাবনা নেই। আইন আইনের মতোই এগোতে লাগল। পত্রিকার নতুন নাম নিয়ে ইতোমধ্যেই আমরা সংবাদ প্রকাশ করতে শুরু করে দিয়েছিলাম। সে কাজ চলল। এই পত্রিকা থেকে সেই সময় যারা রাজনৈতিক ভাবে সবচেয়ে সুবিধা পেয়েছিল, তারা আজকের শাসকদল। আজ অনুকূল পরিস্থিতিতে যতটা বীরদর্প তারা দেখাতে সমর্থ, তখন খড়দহের রাজনৈতিক-মঞ্চে ততটাই দূরবীন দিয়ে তাদের দেখতে হত। আজকের দাপুটেরা সেদিনের ঝড়ে ভেজা পাখি। পরে পুরসভা লাভ করে এই অন্যায্য কোর্টকেস তোলার সৌজন্যটুকুও তারা দেখাতে পারেননি। মর্যাদা দিলে পাছে কারও গ্রহণযোগ্যতা বেড়ে যায়!

এই দীনতা তাদের সম্মানিত করবে না কখনও। মুদ্রার দু’টি পিঠে চিত্রলিপি যাই থাকুক, তা আদতে একটাই মুদ্রা — শাসনের অহংকার। অগণতন্ত্রের করন্যাস, অঙ্গন্যাস ও মুদ্রা নিয়ে যারা তন্বিষ্ট গবেষণা করবেন, তারা ঠিকই টের পাবেন, এ রোগের সৃষ্টি কোন পথে! কোথায় এর শেষ! কোথায় নবযুগ অপেক্ষা করে আছে! –ক্রমশ

আপনাদের মতামত জানান

Please enter your comment!
Please enter your name here