একই জবার পাপড়িতে দু’ধরনের রঙ, ব্যখ্যা দিলেন উদ্ভিদ বিজ্ঞানী ডঃ অমল কুমার মন্ডল

জে মাহাতো, আমাদের ভারত, মেদিনীপুর, ৭ অক্টোবর: গড়বেতা কলেজের অধ্যক্ষের নজরে পড়ল একই জবা ফুলের পাপড়িতে দুধরনের রঙ। ব্যখ্যা দিলেন উদ্ভিদ বিজ্ঞানী। প্রকৃতির খেলা কে বুঝতে পারে? অবশ্য প্রকৃতির খেলা বুঝতে শুধু চোখে দেখলেই হবে না, তাকে বিজ্ঞান সম্মত যুক্তি সহকারে উপস্থাপন করতে হবে। আর তবেই সেটা হবে সঠিক বিজ্ঞানের চর্চা।

কয়েকদিন আগে গড়বেতা কলেজের অধ্যক্ষ তথা বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ামক ডঃ হরিপ্রসাদ সরকার তাঁর মেদিনীপুর শহরের হবিবপুরের বাড়ির বাগানের জবা গাছে লক্ষ্য করেন একই জবা ফুলের পাপড়িতে দুরকম রঙের আর্বিভাব। ডঃ সরকার ৬-৭ বছর আগে তাঁর এক বন্ধুর বাড়ি থেকে ডাল নিয়ে এসে জবা গাছটি লাগিয়েছিলেন। যেখানে আগে একরঙা হলদেটে জবা ফুল ফুটলেও, তিনি হঠাৎ করে লক্ষ্য করলেন সেই এক রকম ভাবে ফুটতে থাকা ফুলে দুইরকম রঙের আর্বিভাব। ডঃ সরকার বিষয়টির কারণ জানতে শরণাপন্ন হলেন বিদ্যাসারগ বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক উদ্ভিদবিজ্ঞানী ড: অমলকুমার মন্ডলের। তিনি অমলবাবুর হোয়াটসঅ্যাপে দু’রঙা জবা ফুলের ছবি পাঠিয়ে, বিষয়টির কারণ জানতে চান। অমলবাবু জবাগাছটি ও তার ফুল সম্পর্কে তাঁর প্রয়োজনীয় জিজ্ঞাস্য তথ্য জেনে নিয়ে বিষয়টির বৈজ্ঞানিক কার্যকারণ খুঁজতে শুরু করেন।

অমলবাবুর মতে শঙ্কর প্রজাতির গাছের ক্ষেত্রে এমন ঘটনা ঘটে থাকে। গাছের কলাম করার ক্ষেত্রেও, এরকম ঘটে, যেমন গােলাপের একটা ডালে লাল, অন্য ডালে হলুদ, গােলাপী নানান রঙের খেলা, ইচ্ছে মতা করা যায় এবং এই নিয়ে বহুদেশ নানাভাবে বাণিজ্যিক রােজগারের পথ প্রস্তুত করেছে। কিন্তু এই জবাগাছটির ক্ষেত্রে বিষয়টি একটু আলাদা। ৫-৬ বছর ধরে স্বাভাবিকভাবে একরঙের ফুল দিতে দিতে এই বছরই একটা ফুলের দুরকম রঙের পাপড়ির আর্বিভাব ঘটেছে। অমলবাবুর মতে এই ঘটনার পিছনে বিভিন্ন কারণ থাকতে পরে। প্রথম যে কারণটা মনে হচ্ছে, তা হল উদ্ভিদের যে নানান রঙের বাহার বৈচিত্র্য দেখা যায় সেটা ক্রোমােফোর নামক রঞ্জকের কারণে হয়, যেটা আবার ক্লোরােপ্লাসটের আর একটা ভাইরাভাই আধিক্যের ক্রমবর্ধমান এবং ক্রমহ্রাসমানতার তারতম্যের উপর নির্ভরশীল। পরিবেশের আমূল পরিবর্তনও আর একটা কারণ হতে পারে। একটা ফুলের দুটো পাপড়ি হঠাৎ করে একটু হলদেটে বেশী দেখা গেল, মানেই হচ্ছে ফুলটার স্বাভাবিক যে রঙ বাকি পাপড়ি গুলিতে ঠিক আছে শুধু হেরফেরটা ঘটেছে অন্য দুটি পাপড়িতে এবং একটা অদ্ভুত ফুলের সৃষ্টি হয়েছে।

অন্য আর যে সম্ভাব্য কারণ মনে হচ্ছে তা হলা জীনের খেলা। প্রতিটি জীবের প্রতিটি বৈশিষ্টকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য রয়েছে জিনের প্রভাব বা বলা ভালাে জিনের দায়ভার, যা কোষের নিউক্লিয়াসের উপর অবস্থান করে। জন্মানাে থেকে মৃত্যু মানে গাছের বীজের অঙ্কুরােদন্ম থেকে সেনেসেন্স অর্থাৎ ঝরে যাওয়া পর্যন্ত এমন কি কখন ফুল ফুটবে, কোন ফুলের কি রঙ হবে, কি গন্ধ হবে “হীরে থেকে জিরে” পর্যন্ত সবটাই নিয়ন্ত্রনের মধ্যে রয়েছে জিনের খেলা। জীবজগতের গতিবিধির সবটাই ভিতরে ভিতরে প্রতিনিয়ত নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে জিন। বিজ্ঞানের এক যুগান্তকারী আবিস্কার হলা জিন এবং তার কার্যক্রম। এমনকি কোনওদিন বাদলা হলে উদ্ভিদের খাদ্য তৈরীতে সূর্যের অনুপস্থিতির জন্য কি ভাবে অন্য উপায়ে খাদ্য তৈরী করতে হবে তারও সঠিক সময়ে সঠিক সিগন্যাল পাঠিয়ে কার্যক্রম সমাধা করা, এও জিনের খেলা। অনেকটা সেই কিশাের কুমারের গানের কলির মতাে ‘ প্রেমের খেলা কে বুঝিতে পারে, বুঝবে যে জন প্রেম রােগেতে ধরেছে গাে যারে “। এই জিন খালি চোখে দেখা সম্ভব নয়, ইলেকট্রনমাইক্রোসকোপের দ্বারা দেখা সম্ভব। যেকোনও গাছে ফুলের রঙের নিয়ন্ত্রনের জন্য জিনকে দায়ী করা হয়েছে। উদ্ভিদের শরীরে প্রত্যেকটি জিনের হঠাৎ করে পরিবর্তন হয়ে যাবার অসাধারণ ক্ষমতা রয়েছে, তাও আবার বিভিন্ন কারণের জন্য হয়ে থাকে, অনেক কারণের মধ্যে পরিবেশের নানাবিধ পরিবর্তন ও একটা প্রধান কারণ। যার ফলে নতুন প্রজাতির সৃষ্টি হচ্ছে, নতুন নতুন চরিত্রের সৃষ্টি হচ্ছে প্রতিনিয়ত, কখনাে সেটা চোখে ধরা পড়ে আবার কখনাে চোখের আড়ালেই থেকে যায়। এই ঘটনাকে বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় মিউটেশান বা পরিব্যপ্তি। এই ফুলের রঙের যে পরিবর্তন হঠাৎ করে পরিলক্ষিত হলা এটাও অভিব্যক্তির ফলেই ঘটেছে বলে মত প্রকাশ করেন বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ ও বনবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক অমলকুমার মন্ডল এবং সহমত প্রকাশ করে অধ্যক্ষ মহাশয় ডঃ হরিপ্রসাদ সরকারও। যে চরিত্রটি প্রকাশিত হয় তাকে ডােমিনেন্ট চরিত্র আর যেটা অপ্রকাশিত থাকে সেই চরিত্রটাকে সুপ্ত বা রিসেসিভ চরিত্র বলে। এখানেও এই ঘটনাটাই ঘটেছে বলে মত প্রকাশ করেন অধ্যাপক মন্ডল। সন্ধ্যামণি উদ্ভিদেও এই রকম কান্ডকারখানা দেখা যায়, পিটুনিয়া উদ্ভিদের ক্ষেত্রেও দেখা যায়। উদ্ভিদের এই প্রকট এবং প্রচ্ছন্ন যে জিনের প্রভাব রয়েছে সেটা বিভেদ না থাকায় এমন ঘটনা ঘটে থাকতে পারে বলে মনে করেন। এই ধনের ঘটনাকে বলা হয় ইনকম্পপ্লিট কো- ডােমিনেন্স। যার ফলে সব রঙের প্রকাশ ঘটেছে বলে মনে করা হচ্ছে। এই ঘটনা সন্ধ্যামণি উদ্ভিদে সব চেয়ে বেশি দেখা যায়, জবাতে প্রায় দেখা যায় না বললেই হয়, কিন্তু তবুও দেখা দিল এবং এই জিনটাকে যদি সনাক্তকরণ করা যায় তাহলে এবং তার বিরাট ব্যবহারিক দিক রয়েছে হর্টিকালচারের ক্ষেত্রে। জিনের এই সংমিশ্রণের ফলেই এই ধরনের ঘটনা ঘটেছে।

এই ঘটনা কি প্রত্যহ ঘটা সম্ভব? কিছু কিছু উদ্ভিদের ক্ষেত্রে ঘটেছে তার কারণ এই মিউটেবল জিন বা পরিবর্তিত হতে পারা জিন থাকার ফলেই সম্ভব হয়েছে বলে জোরালো মত প্রকাশ করেন অধ্যাপক মন্ডল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *