অশোক সেনগুপ্ত
আমাদের ভারত, কলকাতা, ৪ অক্টোবর: মঙ্গলবার রাত থেকেই শুরু হয়েছে মধ্য কলকাতার ‘তেলিরবাগ ভবনে’ দশমীর ব্যস্ততা। ঐতিহ্যের এই পরিবারের পুজোর সঙ্গে জড়িয়ে আছে অনেক স্মৃতি।
সকাল থেকে খেসারির ডালে শালুক/শাপলার নৈবেদ্য, পেতলের হাঁড়ি থেকে দর্পন উত্তোলন, এর পর রীতি মেনে ওই হাঁড়িতেই ফের সেই দর্পন বিসর্জন, আরতি-ঢাক-ঢোল। বিকেলে সিঁদুর খেলা। এর পর বাবুঘাটে বিসর্জন। গোটা প্রক্রিয়ার অনেকটাই মহিলা-নিয়ন্ত্রিত। গঙ্গা থেকে আনা ‘শান্তির জল’ বৃহস্পতিবার সকালে পরিবারের সদস্যদের মাথায় ছেটানো হবে। তার পর প্রণাম, বিজয়ার পর্ব।
গোটা কর্মকাণ্ড আর পারিবারিক ইতিহাসের কথা এই প্রতিবেদককে জানালেন প্রবীন সদস্য দেবরঞ্জন দাশগুপ্ত (৭৪)। তেলিরবাগ ছিল বিক্রমপুর ঢাকায় একটি গ্রাম। বহুকাল আগেই পদ্মার তলদেশে বিলীন হয়ে গেছে। এই পরিবারের সদস্য ছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, সুধী রঞ্জন দাশ (প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি), সরল রঞ্জন দাশ (নেপালের মহারানাদের চিকিৎসক এবং বিধান চন্দ্র রায়ের সহকর্মী) এবং অন্য কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তি।
তেলিরবাগে দাস পারিবারের দুর্গাপূজা প্রায় ৩০০ বছর আগের। সরল রঞ্জন দাশ গত শতকের ত্রিশের দশকে মধ্য কলকাতায় শশীভূষণ দে স্ট্রিটে তৈরি করেন ‘তেলিরবাগ ভবন’। চল্লিশের দশকের প্রথমার্দ্ধে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পুজোটিকে এই বাড়িতে নিয়ে আসেন। আজও তার বংশধররা তা বাঁচিয়ে রেখেছে।
দেবরঞ্জনবাবু জানান, পূর্ববঙ্গে আমাদের বাড়ির পুজোয় যাঁরা ঢাক বাজাতেন, পরে তাঁরাই কলকাতায় এই বাড়িতে ঢাক বাজাতে আসতেন। দেশভাগের ঠিক পরেও মহালয়ার সময় ওপার বাংলার অনেক ঢাকি দল বেঁধে ট্রেনে করে চলে আসতেন আমাদের বাড়িতে। তখন পুজোপ্রাঙ্গণ ছিল একতলায়। ওঁরাও এখানে ক’দিন থাকতেন। তারপর শহরের নানা স্থানে ছড়িয়ে পড়তেন ঢাক বাজানোর বরাত নিয়ে।
সরল রঞ্জন দাশ নেপাল থেকে একটি বড় দুর্গার পট নিয়ে আসেন। প্রথমদিকে ২-৩ বছর সেটায় পুজো হয়। পরে প্রতিমা তৈরি হত কুমোরটুলিতে। পরিবর্তনের কথা জানাতে গিয়ে দেবরঞ্জনবাবু জানান, “নবমীর দিন সকালে চালবাটা দিয়ে তৈরি পুতুলসদৃশ ‘শত্রু’-কে বলিদানের খড়্গ দিয়ে চেপে আগে যূপকাষ্ঠের গর্তে চেপে দেওয়া হত। তখন আমাদের উঠোনে মাটি ছিল। ১৯৭০ নাগাদ পুজোস্থল স্থানান্তরিত হয় এই ভবনের ছ’তলায়। এখানে মার্বেলের মেঝে। তাই গর্তের বদলে মাটির অস্থায়ী পিণ্ডে সেই ‘শত্রু’র বিনাশ হয়।
বিক্রমপুর পরগণার তেলিরবাগ গ্রামের এই বংশে বহু খ্যাতনামা ব্যক্তি জন্মেছিলেন। পরিবারের প্রবীন সদস্য কালীমোহন দাশ ছিলেন প্রসিদ্ধ ব্যবহারজীবী। ১৮৩৮ খ্রি. জুলাই মাসে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। দুর্গামোহন দাশ ছিলেন তাঁর কনিষ্ঠ সহোদর। দেশবন্ধু চিত্ত রঞ্জন দাশ তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র। অর্জিত সম্পত্তির অধিকাংশ দেবসেবা ও জনহিতকর কাজে দান করে যান। ১৮৮৭ খ্রীঃ অব্দে তাঁর মৃত্যু হয়। ‘রামতনু লাহিড়ি ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ’-এ গুরুত্ব পেয়েছেয় দুর্গামোহনের কথা (পৃ ৩৩২)।
পরিবারের অন্যতম সদস্য ছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের বোন উর্মিলা দেবী (১৮৮৩-১৯৫৬ খ্রী )। তাঁর কথা রয়েছে ‘ভারতকোষ’-এ (পৃ ৬৯৩)। বাবা ভুবনমোহন দাশ, মা নিস্তারিণী দেবী। অসহযোগ আন্দোলনে যে তিনজন বাঙালী মহিলা প্রথম আইন অমান্য করে স্বাধীনতা-সংগ্রামের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছেন, উর্মিলা দেবী তাঁদের অন্যতম। ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দের ৭ ডিসেম্বর উর্মিলা দেবী, সুনীতি দেবী ও দেশবন্ধুর সহধর্মিণী বাসন্তী দেবী সরকারি নিষেধ অমান্য করে রাজপথে খদ্দর বিক্রি করে তৎকালীন যুবরাজের আগমন উপলক্ষে ২৪ ডিসেম্বর হরতাল পালন করার আহ্বান জানান। পুলিশ তাঁদের গ্রেপ্তার করে। এর ফলে বিশেষ আলোড়ন তৈরি হয়। এই দৃষ্টান্তে উদ্বুদ্ধ হয়ে বাংলার অন্যত্র অনেক মহিলা অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেন। এই সময়ে উর্মিলা দেবী কলিকাতায় ‘নারী-কর্মমন্দির’ প্রতিষ্ঠা করেন। পরিবারের আরও কিছু বিশিষ্ট সদস্য বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রেখেছেন।
বহু পুরুষ ধরে পূর্ববঙ্গের স্মৃতিমাখা এই পরিবারের আর কোনও যোগাযোগ নেই সাত পুরুষের ভিটের সঙ্গে। নদীগর্ভে তেলিরবাগ গ্রাম নিশ্চিহ্ণ হয়ে যাওয়ার পর ফরিদপুরে দ্বিতল ভবন তৈরি করায় দাশ পরিবার। দেশভাগের আগে সেটি ছিল পরিবারের এক কাজের লোকের হেফাজতে। বাড়িটির আর কোনও খবর রাখেননি পরিবারের বর্তমান শরিকরা। তবে প্রত্যক্ষ স্মৃতি না থাকলেও পুজোর সময় পরিবারের প্রবীন সদস্যদের কারও কারও মনে পড়ে যায় ওপার বাংলার কথা। সেই সীমাহীন সমৃদ্ধি, প্রাচীন পেল্লাই বসতবাড়ি— কালের কড়াল গ্রাসে অন্তর্হিত। কিন্তু ভবন আর পুজোর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে গিয়েছে তেলিরবাগ স্থাননাম। ইতিহাস এভাবেই বুঝি চিরস্থায়ী হয়ে ওঠে।
ইতিহাস সর্বদাই গোড়ার কথা জানায় তা যদি হয় নিজেদের পরিবারের তা জানার আগ্রহ দ্বিগুণ হয় । ছোড়দাদা ( দেবরঞ্জন দাশগুপ্ত ) সুন্দর ভাবে এ সম্পদ লিপিবদ্ধ করায় আমরা তার কাছে কৃতজ্ঞ।
আমি আগের মন্তব্যটি ঠিক করতে পারলাম না , তাই আবারএই মন্তব্যতে ভুল স্বীকার করে লিখছি এই লেখার লিপিবদ্ধকার অশোকবাবু, দেবরঞ্জন দাশগুপ্ত এখানে কথকের ভূমিকা পালন করেছেন । অশোক সেনগুপ্ত মহাশয়কে এই লেখার জন্য ধন্যবাদ জানাই । 🙏🏻
Thnx.