খড়দহ ও বঙ্গসাহিত্যের দামী সম্পত্তি রমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়

ড. কল্যাণ চক্রবর্তী
খড়দহের ভূমিপুত্র তথা বিশিষ্ট অধ্যাপক ড. কল্যাণ চক্রবর্তী, এলাকার সাহিত্য-সংস্কৃতির উজ্জ্বল নক্ষত্রদের নিয়ে সাক্ষাৎকারধর্মী বিস্তারিত আলোচনা শুরু করেছেন। এটি তার প্রথম পর্ব। এই পর্বে আলোচিত হল স্বনামধন্য কবি, কথা সাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক শ্রী রমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় সম্পর্কে। এক এক করে খড়দহের সমস্ত সাহিত্যিকদের নিয়েই পরবর্তীকালে এমনতরো আলোচনা করবেন ড. চক্রবর্তী।)

আমাদের ভারত, ২১ জুন: খড়দহের মণিমাণিক্যকে কী বঙ্গসাহিত্য-সমাজ অনুপুঙ্খ দর্শন করেছে? যদি দেখবার দৃষ্টিতে আজও ঘাটতি থেকে যায়, তবে অবশ্যই তন্বিষ্ট পাঠ করে নিতে হবে রমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের সাহিত্য সম্ভারের। তিনি রমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়; ভরদ্বাজ ভট্ট, প্রসাদ মুখোপাধ্যায় — এই ছদ্মনামেও লিখেছেন বহু সাহিত্য সম্ভার। তাঁর জন্ম ১৯৩৭ সালের ১১ই এপ্রিল, বসিরহাট অখণ্ড চব্বিশ পরগনায় (আপন মাতুলালয়ে)। তাঁর পিতৃভূমি পাটকেলঘাটা সাতক্ষীরা, বাংলাদেশ। পিতা প্রয়াত দেবেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, মাতা হেম নলিনী মুখোপাধ্যায়। তিনি পিতামাতার ষষ্ঠ সন্তান হলেও, বর্তমানে একমাত্র জীবিত সন্তান।

রমাপ্রসাদের পড়াশোনা ও বেড়ে ওঠা
স্কুল — কুমিরা হাইস্কুল, পাটকেলঘাটা, সাতক্ষীরা বাংলাদেশ এবং পরবর্তীকালে মালঙ্গপাড়া কে সি বি ইন্সটিটিউশান, ২৪ পরগণা, স্বরূপনগর। কলেজ — আশুতোষ কলেজ, কলকাতা, এবং মহারাজা মনীন্দ্রচন্দ্র কলেজ, কলকাতা। স্নাতক স্পেশাল অনার্স (ইংরেজি) ডিপ্লোমা — হিন্দি ভাষায় প্রবোধ প্রধান এবং প্রাজ্ঞ।

বর্তমান ও অতীত পেশা
বর্তমানে তিনি অবসরপ্রাপ্ত বন্দর কর্মী। প্রথমে শিক্ষকতা, পরে কলকাতা বন্দর প্রতিষ্ঠানে (শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি বন্দর) কর্মী থেকে আধিকারিক। মাঝে প্রায় দশ বছর গৃহশিক্ষকতা, রহড়া রিজেন্ট পার্কে ‘জ্যেঠু স্যার’ নামে পরিচিত।

লেখার জগতে প্রবেশের প্রেরণা
বাবার সংগ্রহে থাকা প্রচুর বই এবং প্রবাসী, ভারতবর্ষ, মাসিক বসুমতী, শনিবারের চিঠি, সবুজপত্র ইত্যাদি এবং সাহিত্যিক ভবানী মুখোপাধ্যায়ের সান্নিধ্য, সর্বোপরি শিক্ষাগুরু ডঃ পুলিন দাসের উৎসাহ দান।

উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ(নাম, প্রকাশ সাল, প্রকাশক)
‘সাঁকো’ গল্পগ্রন্থ (১৯৭৭), ক্রান্তিক প্রকাশনী ‘কবিতা কালচেতনা’ কাব্যগ্রন্থ (১৯৮১), ক্রান্তিক প্রকাশনী ‘ভাবনা ইতস্তত’ নিবন্ধমালা (১৯৮২), ক্রান্তিক প্রকাশনী ‘দুই আমি’ কাব্যগ্রন্থ (১৯৮৬), ক্রান্তিক প্রকাশনী ‘অন্য আকাশ’ গল্পগ্রন্থ (২০০৩), মনোভূমি ‘সময় মাটি ও মানুষ’ কাব্যগ্রন্থ, (১৯৮২ এবং ২০০৩), মনোভূমি ‘যে দিকে তাকাই’ কাব্যগ্রন্থ, (২০১২), ইসক্রা ‘ঠিকানা’ কাব্যগ্রন্থ (২০১৩), ইসক্রা ‘এবং হরনাথ’ গল্পগ্রন্থ (২০১৩), ইসক্রা।

কোন কোন পত্রিকায়, সম্পাদিত গ্রন্থে কী ধরনের লেখা দৈনিক পত্রিকা — কেবলমাত্র সত্যযুগ এবং আজকাল শারদ সংখ্যাগুলিতে। সাময়িক পত্রিকা — প্রায় শতাধিক পত্রিকায় সম্পাদিত গ্রন্থ— ষাট সত্তরের গল্প, সম্পাদক সৌমেন বন্দ্যোপাধ্যায়, মহুয়া প্রকাশনী। ‘কবিতা সময় মনুষ্যত্ব’… কাব্যগ্রন্থ, সম্পাদক অমলেন্দু দত্ত, বসুধা প্রকাশনী। ‘শব্দপুরের ঘোড়সওয়ার’ কাব্যগ্রন্থ, সম্পাদক… সুদীপ্ত বন্দ্যোপাধ্যায়। ‘কথা কুঁড়ি কুসুম’ অণুগল্প, সম্পাদক নীলকন্ঠ মুখোপাধ্যায়। ‘অশীতি বলয়ে কবি অমলেন্দু দত্ত’, কাব্যগ্রন্থ, সম্পাদক, প্রদীপ দে। ‘দিগন্তে কার কালো আঁখি’ কব্য গ্রন্থ, সম্পাদক…সুদীপ্ত বন্দ্যোপাধ্যায়।

কোন বিশেষ সাহিত্য সভায় আমন্ত্রণ ও সন্মাননা
সোপান পাঠাগার বেহালায় অজন্তা প্রেক্ষাগৃহে আয়োজিত সাহিত্য সভায় সভাপতি হিসেবে উপস্থিতি, সাহিত্যিক নেপাল মজুমদার ছিলেন মুখ্য অতিথি। একতা সংঘ (পানশিলা) আয়োজিত সাহিত্য সভায় বিভূতিভূষণ-পত্নী রমাদেবীর পাশে উপবিষ্ট ও সম্মানিত ও বক্তৃতা প্রদান। রহড়া সংঘ প্রাঙ্গনে আয়োজিত সাহিত্যসভায় কথাসাহিত্যিক সাধন চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে সম্মানিত ও বক্তৃতা প্রদান। রতন শিকদার সম্পাদিত ‘অল্প কথার গল্প’ পত্রিকার দশ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে ইসক্রা আয়োজিত সাহিত্য সভায় বক্তব্য সহ অণুগল্প পাঠ।

কোন বিশেষ স্বীকৃতি ও পুরস্কার
১৯৮৪ সালে ‘প্রোগ্রেসিভ রাইটার্স গিল্ড’ প্রদত্ত সাহিত্যসেবী সন্মাননা হিসেবে পুষ্পস্তবক এবং এক হাজার টাকার চেক প্রদান করেন সাহিত্যিক ভবানী মুখোপাধ্যায় এবং গিল্ড সম্পাদক বিজয় চট্টোপাধ্যায়। ১৯৮৬ সালে বেহালা আর্যসমিতি মঞ্চে ‘সাঁকো’ গল্পগ্রন্থ রচনায় বিশেষ কৃতিত্বের জন্য লেখক সুশীল কুমার গুপ্ত ও লেখক হরপ্রসাদ মিত্র স্বাক্ষরিত অভিজ্ঞান পত্র এবং এক হাজার টাকার চেক প্রদান করা হয় লেখক ভবানী মুখোপাধ্যায়ের হাত দিয়ে। ১৯৯১ সালে কলকাতা বন্দর (বর্তমানে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি বন্দর) কতৃপক্ষ প্রদত্ত শ্রেষ্ঠ পুরস্কার মডেল এমপ্লয়ী (আদর্শ কর্মী) পদক পান রমাপ্রসাদ। শোনা যায় বন্দরের ১৫০ বছরের মধ্যে মাত্র দুজনকে এই পুরস্কার দেওয়া হয়েছে, রমাপ্রসাদ তাঁদের একজন। ১৯৯১ সালে Indian Institute of Port Management (IIPM) কতৃক আয়োজিত Ninth Management Development Programme হিসেবে এক মাস ব্যাপী সেমিনারে কলকাতা সহ ভারতের সকল প্রধান বন্দরের প্রতিনিধিদের সঙ্গে রমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় উপস্থিত ছিলেন। ১৯৯৪ সালে কলকাতা বন্দর প্রতিষ্ঠানের কেন্দ্রীয় সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় গল্পলিখন বিভাগে প্রশংসিত ‘সোনার হরিণ’ গল্পটির জন্য শংসাপত্র ও একগুচ্ছ পুষ্পস্তবক প্রদান করা হয়, বিচারক ছিলেন প্রখ্যাত সাহিত্যিক নারায়ণ সান্যাল। ২০১০ সালে নীলকন্ঠ মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘অনপেক্ষ’ পত্রিকার পক্ষ থেকে সাহিত্যিক রামকুমার মুখোপাধ্যায় ও সাহিত্যিক অমর মিত্র স্বাক্ষরিত সন্মানপত্র দেওয়া হয়। ২০১১ সালে ‘খড়দহ সংস্কৃতি অঙ্গন’ (মধ্যপাড়া) পক্ষ থেকে মাননীয় পুরপ্রধানের মাধ্যমে মানপত্র ও পুষ্পস্তবক দেওয়া হয় স্থানীয় সুরেন্দ্রনাথ প্রাথমিক বিদ্যালয় গৃহে। ২০১২ সালে ‘এখন রোদ্দুর’ সাহিত্য পরিষদ (সরশুনা), দুটি দৃষ্টিনন্দন উপহার সহ সন্মাননা দেয়। ২০১৩ সালে গোবিন্দপুর উত্তর চব্বিশ পরগণা ‘অনুরাগ’ সাহিত্য সংস্থার পক্ষে সংবর্ধনা এবং মানপত্র দেওয়া হয়। সভায় স্কুল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকমন্ডলী উপস্থিত ছিলেন। ২০১৫ সালে ‘বেহালা বইমেলা’ সন্মিলনী পরিচালিত সভায় ‘কবি চিত্ত ঘোষ স্মৃতি সন্মাননা’ দেওয়া হয় কবি হিসেবে। ২০১৫ সালে স্বামী পুণ্যানন্দ মুক্ত মঞ্চে অনুষ্ঠিত খড়দহ কবি লেখক ও শিল্পী সমন্বয় মঞ্চে আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানের উদ্বোধক ছিলেন রমাপ্রসাদ। ২০১৭ সালে (১২/০২/২০১৭) নাদব্রহ্ম সংগীত সেবাশ্রমের কর্ণধার বিনয় ভূষণ বণিক কর্তৃক সাহিত্যসেবী হিসেবে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন পত্র এক হাজার টাকা সন্মান দক্ষিণা এবং পুষ্পস্তবক দেওয়া হয়। ওই একই দিনে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিশিষ্ট সেতারশিল্পী শ্রীমতী শিশিরক্ণা ধর চৌধুরী মহাশয়াকেও সম্বর্ধনা দেওয়া হয় ওই একই অনুষ্ঠান মঞ্চে।

কোন পত্রিকা /সুভেনিরের সম্পাদক/সহ-সম্পাদক/সম্পাদক মন্ডলীর সদস্য
বেহালা থেকে প্রকাশিত ‘ঋক’ পত্রিকার প্রথমে সহ-সম্পাদক, পরে সম্পাদক ষাট দশকের শেষার্ধ থেকে সত্তর দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত আনুমানিক দশ বছর। সত্তর এবং আশির দশকে চেতলা আবাসনে শারদোৎসবের সুভেনির প্রকাশনার ও সম্পাদনার দায়িত্ববহন। রহড়ায় বিশ শতকের শেষের দিকে ‘মনোভূমি’-র পাঁচটি সংখ্যা প্রকাশ, এবং ‘ছোটদের মনোভূমি’-র দুটি সংখ্যার একটি সম্পাদক ছিলেন (অন্যটির সম্পাদনা করেন কন্যা রুচিরা চক্রবর্তী)।

সংসার জীবন
স্ত্রী বেলা মুখোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রাক্তন কর্মী ও তাঁর সমস্ত সাহিত্য গ্রন্থের সত্ত্বাধিকারিণী। জ্যেষ্ঠা কন্যা রুচিরা চক্রবর্তী পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কর্মী, কনিষ্ঠা কন্যা চয়িতা ভট্টাচার্য স্কুল শিক্ষিকা। জ্যেষ্ঠ জামাতা প্রয়াত, কনিষ্ঠ জামাতা কলেজের অধ্যাপক। জ্যেষ্ঠ দৌহিত্র ফার্টিলাইজার কোম্পানিতে চাকুরিরত এবং কনিষ্ঠ দৌহিত্র চিকিৎসা বিজ্ঞান পাঠরত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *