ধর্ম ও কুসংস্কার! হিন্দু আচার হলেই কি বিরোধিতা করতে হবে?

এই লেখা টি ইতিমধ্যেই সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল লেখকের মূল বক্তব্য, হিন্দু ধর্মে বহু সংস্কার রয়েছে যেগুলো পালনে অনেক রোগ-ব্যধি দূরে থাকে,নশরীর স্বাস্থ্য ভালো থাকে। যুগ যুগ ধরে ধর্মপ্রাণ হিন্দুরা সেগুলো পালন করে আসছে– ধর্মের মোড়কে। কিন্তু সে গুলোকে একশ্রেণির মানুষ কুসংস্কার বলে এতদিন উড়িয়ে দিয়েছে। এখন এই করোনা অতিমারিতে সেইসব সংস্কারই আবার ফিরে আসছে– সেগুলো আবার কদর বাড়ছে।
আমাদের ভারত, ২০ নভেম্বর: মূর্খ না হলে বুঝি কেউ গাছকে পূজো করে? আমার মূর্খ ঠাকুমাকে দেখতাম লালশালু জড়ানো বট গাছটার নিচে মোমবাতি, ধুপকাঠি জ্বালিয়ে পূজো করতে, এমনকি পূজো করতে দেখতাম নদীকেও। কী মূর্খ, কী মূর্খ! ছোট বেলায় চৈত্র সংক্রান্তির আগের দিন, যেটাকে আমাদের এখানে ‘হাড় বিষু’ বলা হয় – সেদিন এবং আরো বিশেষ কিছু দিন আমার নিরক্ষর ঠাকুমার চাপাচাপিতে নিম–হলুদ এর রস খেতে হতো। কী মূর্খতা! সর্দি–কাশি হলেই তুলসী আর বাসক পাতার তেতো রস! আর ওঁনার কয়লা, নুন দিয়ে দাঁত মাজা..? ছিঃ ছিঃ! আমরা হাসাহাসি করতাম। তখনকার নতুন স্টিলের বাসন থাকতেও ঠাকুমা কেন জানি পুরোনো তামার পাত্রেই জল খেতেন।

বাইরে থেকে এসে হাত পা না ধুয়ে ঘরেই ঢুকতে দিতো না বুড়ি। মড়া পুড়িয়ে শ্মশান বা হাসপাতাল থেকে এলে তো কথাই নেই। কী কুসংস্কার বলুন তো! কিন্তু এখন কেন জানি সব গুলিয়ে যায় – আমার নিরক্ষর মূর্খ ঠাকুমার কিছু না জেনেই পরম্পরা গত ভাবে মেনে আসা ঐ ‘মূর্খতা’ গুলি আসলে কী ছিলো? আর বিচার না করেই সেগুলিকে অস্বীকার করে উড়িয়ে দেওয়ার নামই কি আধুনিকতা, প্রগতিশীলতা, বিজ্ঞান মনষ্কতা? হলুদ বা নীমের যতো গুণই থাকুক, আধুনিক বিজ্ঞানও নানা ভাবে পরীক্ষা করে সেটা স্বীকার করুক – এইসব ভেষজের উপকারিতা আজ আমাকে অস্বীকার করতেই হবে – কারণ এগুলি প্রাচীন হিন্দু শাস্ত্র আয়ুর্বেদ এর আবিষ্কার। যতোই সারা বিশ্ব স্বীকৃতি দিক, যোগ যেহেতু প্রাচীন হিন্দু সংস্কৃতির অংশ – এর বিরোধিতা করতেই হবে, এর উপযোগীতাকে অস্বীকার করতেই হবে। ধ্যান খুব ভালো জিনিস, কিন্তু যোগব্যায়াম ভীষণ খারাপ ! শরীর মন দুইকেই সুস্থ রাখতে ভীষণ উপযোগী আমাদের প্রাচীন ঐতিহ্য যোগ–ধ্যানকে আমরা এতদিন পাত্তাই দিইনি। কিন্তু যেই না বিলেত থেকে ‘মেডিটেশন’ নাম নিয়ে আমাদেরই জিনিস আমাদের কাছে এলো – গলিতে গলিতে মেডিটেশান ক্লাব!

ছ্যা ছ্যা, ঘৃতকুমারী আবার কী জিনিস?–অ্যালোভেরা খুব ভালো। ভেষজ শব্দটার মধ্যেই কেমন যেন ঘাস ঘাস গন্ধ। কিন্তু হার্বাল শব্দটা কী কিউট! ‘কবিরাজী ওষুধ’ নামটার মধ্যেই কেমন একটা বোঁটকা গন্ধ! তাই নিজেদের এতো উন্নত প্রাচীন আয়ুর্বেদ চিকিৎসাকে পাত্তাই দিইনি আমরা, অথচ সেই একই কবিরাজী ওষুধ বিদেশ থেকে স্বীকৃতি নিয়ে এলে আয়ুর্বেদ নিয়ে আমরা পাগল। রবীন্দ্রনাথকেও কেউ পাত্তা দেয়নি, বিলেত থেকে নোবেল পাওয়ার পর, বিলাত স্বীকৃতি দেবার পর মাথায় তুলে সে কী নাচানাচি!

বড় বড় কোম্পানির টুথপেস্টের বিজ্ঞাপনে অ্যাক্টিভ কোল, অ্যাক্টিভ সল্টের চমক দেখে, ওয়াটার পিউরিফাইয়ারের বিজ্ঞাপনে মাধুরীর মুখে অ্যাক্টিভ কপারের কথা শুনে মনে পড়ে যায় আমার নিরক্ষর সেই ঠাকুমার কথা। অনেক আগে এদেশে গাছের সঙ্গে মেয়েদের বিয়েও দেওয়া হত অনুষ্ঠান করে। কি কুসংস্কার বলুন তো ! তাই উঠে গেছে। এখন আবার মেক্সিকো, জাপান সহ বিভিন্ন দেশে দেখতে পাচ্ছি, এখন এটা পরিবেশ প্রেম! আগে আমরা গাছ পুঁতে জন্ম দিন পালন করতাম, কি প্রকৃতি ও সংস্কারবাদী চিন্তা! আবার ছোট ইলিশ যাতে ধরা না পড়ে, বংশ না শেষ হয়, তাই সরস্বতী পূজার আগে ইলিশ খাওয়া ছিল বারণ। এখনও বট গাছ কেউ কাটতে চায় না, সরকারি কাজের জন্য কাটতে হলে অন্য সম্প্রদায়ের লোক দিয়ে কাটাতে হয়। কী প্ৰকৃতিবাদী চিন্তা ! আইন করতে হয়নি, ‘পাপ’ শব্দটা দিয়ে সংস্কার হিসাবে মনে গেঁথে দেওয়া হয়েছে।

আমার ঠাকুমাকে দেখতাম পিঠে করলে প্রথম পিঠেটা পাখিদের জন্য চালের উপর ছিটিয়ে দিতেন। পাখি বা পরিবেশ প্রেম ট্রেম কিছু নয়, এটা নাকি নিয়ম। এটা পরম্পরা গত চলে আসা সংস্কার! পরিবেশ প্রেম, মানবিকতা সব ধর্মের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার! হ্যাঁ, হিন্দুরা গাছকে লাল শালু জড়িয়ে পূজো করে, পূজো করে গরুকে, এমনকি নদীকেও। কিন্তু কেন করে, সেটা বুঝতে গেলে যে উপলব্ধির দরকার, যে উন্নত দর্শন দরকার, সেটা সবার থাকে না। বিশেষ করে যাদের মধ্যে বিন্দুমাত্র কৃতজ্ঞতা বোধ নেই।

কন্যা সন্তানের সম্প্রদান অর্থাৎ বিয়ে না দিলে পিতার হাত শুদ্ধ হয় না – গোঁড়ামি–কুসংস্কার..? নাকি কন্যা সন্তানের জন্মে উৎসাহ দান? আর একই গোত্রের মধ্যে বিয়ের নিষেধাজ্ঞা..? ধর্মই আইন, আইনই ধর্ম ! কী জানি বলছিলাম…., ও হ্যাঁ, বিজ্ঞান দিয়ে ধর্ম ! আমার ঠাম্মা একেবারেই নিরক্ষর, কালো রং তাপ শোষক জানারই কথা নয়। কিন্তু ছোটবেলায় দেখতাম ভাতের হাঁড়ির নিচে মাটি দিয়ে প্রলেপ দিতে। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলে উত্তর পেতাম এতে রান্না তাড়াতাড়ি হয়। কয়েক দিন পর কাঁচা উনুনের আগুনে হাঁড়ির নিচের দিকটা কালো হয়ে যেত। ধাতুর সঙ্গে অ্যাসিডের রাসায়নিক বিক্রিয়ার কথা তো ঐ নিরক্ষর মহিলার জানার কথাই নয়! কিন্তু কাঁসা বা অন্য কোনো ধাতব পাত্রে টক বা চাটনি জাতীয় খাবার কেন জানি রাখতেন না। হিন্দুদের প্রত্যেক আচার অনুষ্ঠানে হলুদ, নিম অপরিহার্য অঙ্গ। বংশ পরম্পরায় এগুলি চলে এসেছে, যুক্তি পূর্ণ হয়েও কোন যুক্তি তর্কের দরকার পড়েনি।

বিজ্ঞান দিয়ে বুঝতে পারবে না বলেই কি ধর্ম বা সংস্কারের প্রচলন? বিজ্ঞান হজম হবে না বলেই কি ধর্ম ভীরুতাকে কাজে লাগিয়ে ধর্ম মিশিয়ে দেওয়া? কে জানে…! এই ঠাকুমাকেই দেখতাম, একাদশীর উপোসের পরের দিন খুব সহজ পাচ্য খেতেন, এই দিনটারও একটা নাম ছিলো – যতটুকু মনে পড়ে আমরা ‘পারণা’ বলতাম। আমরা সেদিন মুখিয়ে থাকতাম সাগুর খিচুড়ি আর মিষ্টি আলু সেদ্ধ বা পোড়া খাওয়ার জন্য। বড় হয়ে শুনলাম, চিকিৎসা বিজ্ঞান বলে যে উপোসের পর ভারী খাওয়া ঠিক নয়। আমার ঠাকুমা কিন্তু পড়াশোনা জানতেন না।

বুড়ি কপালে দুই ভ্রূর মাঝখানে তিলক কাটতো, আমরা বলতাম বগার ইয়ে। কিন্তু দুই ভ্রূর মাঝখানে আঙুল ঘোরালে শিরশিরে অনুভূতি, দুই ভ্রূর মাঝখানে মনোযোগ এনে ধ্যান, প্রাচীন কাল থেকে সনাতন ধর্মে কপালে ফোঁটা, তিলক বা মহিলাদের সিঁদুর, হিন্দু দেবদেবীদের ত্রিনয়ন বা তৃতীয় চোখ – এখন শুনি বিজ্ঞান বলছে এ সবই রহস্যময় পাইনাল(Pineal) গ্ল্যান্ডের কারসাজি।

নিখুঁত তিথি অনুযায়ী অমাবস্যা, পূর্ণিমা, জোয়ার ভাটা, চন্দ্র গ্রহণ, সূর্য গ্রহণ! পৌষ বা মকর সংক্রান্তি সূর্যের উত্তরায়ন, কৃষি নির্ভর দেশে ফসলের বীজ রোপণ সব একাকার। ধর্ম, প্রকৃতি, জীবন বিধান সব একাকার। যুগে যুগে এই পৃথিবী কম তো মহামারী দেখেনি। জন্মলগ্ন থেকেই হয়তো সঙ্গী, সঙ্গী সাবধানতাও। ‘আধুনিক’ ‘সভ্য’দের মতো নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট স্থানে জড়ো হয়ে সবাই প্রার্থনা করার বাধ্যবাধকতা যে প্রাচীন ‘কুসংস্কারাচ্ছন্ন’ হিন্দুদের নেই, বহু যুগ ধরে নিজের নিজের ঘরেই ব্যবস্থা – সেটা কি এজন্যই?

কী জানি বাবা – হাত না মিলিয়ে নমস্কার, কবর না দিয়ে মৃতদেহ দাহ, মৃতদেহের সঙ্গে মৃতের ব্যবহার করা বিছানা পোড়ানো, দাহ করে বা হাসপাতাল থেকে এসে কাপড় ছেড়ে স্নান, মৃতের পরিবারকে আলাদা রাখতে অশৌচ পালন, অশৌচের সময় যাতে বাজার করতে বাইরে বেরোতে না হয় – তার জন্য জ্ঞাতি বা আত্মীয়দের পক্ষ থেকে হবিষ্যির জিনিস এনে দেওয়া এবং মৃতের বাড়ি থেকে ফিরে চান করে বাড়ি ঢোকা, ক্ষৌর কর্ম থেকে সংক্রমণ ছড়াতে পারে বলে অশৌচের সময় চুল দাড়ি না কাটা, বাইরে বেরোলে অপরিচিতরা যাতে ছুঁয়ে না দেয় বা ছোঁয়া লেগে গেলেও যাতে স্নান করে – তার জন্য ঐ সময় আলাদা ড্রেস কোড। সবই কুসংস্কার…? ঘরে ঢোকার আগে হাত পা ধোয়া, খাদ্যাভাস, যোগ, খাদ্যে অ্যান্টিবায়োটিক নিম হলুদ মেথি, কালো জিরে – সবই তো নাকি কুসংস্কার। কিন্তু এখন দেখছি অতি সভ্য জগৎ আরো বেশি কুসংস্কারাচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে। এমনকি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা WHO পর্যন্ত! ছিঃ ছিঃ!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *